Select Page

চোখে লেগে থাকা সিকোয়েন্স – ২ঃ মান্নাপর্ব

চোখে লেগে থাকা সিকোয়েন্স – ২ঃ মান্নাপর্ব

mannaআজ ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক/অভিনেতা মান্নার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। মান্নাভাইকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।তাঁর অসংখ্য সিনেমার মধ্যে নির্বাচিত আমার প্রিয় কিছু সিনেমার সিকোয়েন্স সবার জন্য শেয়ার করছি।বাণিজ্যিক ও এক্সপেরিমেন্টাল দুই ধরনের সিনেমাতেই মান্নাভাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী তাই দুই ক্যাটাগরিকেই নির্বাচন করলাম।

যন্ত্রণা
শেষ সিকোয়েন্স।দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মান্না ও তার বন্ধুরা ফাঁসির জন্য প্রস্তুত।সবাই সবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।প্রায় মিনিট খানেক কোনো সংলাপ নেই কারো।মান্না তখন চোখে চাপা অশ্রু নিয়ে চেয়ে থাকে বন্ধুদের দিকে।বাণিজ্যিক সিনেমাতে এরকম সাইলেন্ট অ্যাকটিং দেখা যায় না। স্রেফ অসাধারণ!

Film Poster of Danga by manna

দাঙ্গা
১. কবি নজরুলের ভাস্কর্যের সামনে মান্না দাঁড়ায়।এখানেও এক দৃষ্টিতে তাকায় কিছুক্ষণ।চোখ দুটো তখন বড় বড়।কোনো সংলাপ নেই।সুপার সাইলেন্ট অ্যাকটিং।তারপর ব্যাকগ্রাউন্ডে ভেসে আসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি।আর গায়ে আগুন ধরানো সংলাপ- ‘এই কবি, আর একটা কবিতা লিখতে পারো না? আর একবার বিদ্রোহী হতে পারো না? শুধু তাকিয়ে থাকতে পারো?’… গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় দেখতে দেখতে!

২. রাজিব হাত কেটে নেয় মান্নার।তখনই স্ত্রী সুচরিতা প্রসব বেদনায় কাতরায়।তারপর বৃষ্টির মধ্যেই বাচ্চা প্রসব করে।বাচ্চা প্রসবের রিয়েলিস্টিক শট দেখাতে সুচরিতার দুই পায়ের মাঝামাঝি বাচ্চার জন্ম দেখানো হয়।এমন দৃশ্য আমি কোনো সিনেমায় দেখিনি … মর্মান্তিক!

Film Poster of Ammajan with manna dipjol

আম্মাজান
১. ধর্ষককে মেরে মান্না মেয়ের বাসায় যায়।তারপর মেয়ের বাবা-মার আহাজারি দেখে বলে- ‘আত্মহত্যা করছে ভালো করছে, বাঁইচা থাকলে খুব কলঙ্ক হইত।অনেক কষ্ট’…তারপর আরো সংলাপ- ‘মেয়েরা হইল … মেয়েরা হইল আম্মা, মায়ের জাত, এ ঘটনার পরে তাদের বুক দিয়া আগলায় রাখতে হয়’…জীবন্ত অভিনয়!

২.ধর্ষককে খুন করার পরে তারই জানাজা করার জন্য যায় মান্না।ডিপজল ততক্ষণে হাজির।আজহারুল ইসলাম খান ডিপজলকে বিচার দেয়।তারপর খাটিয়া ধরতে গেলে মান্না বলে ‘আমি খুন করছি’।ডিপজল অবাক হয়।তারপর খাটিয়া তুলে ঘাড়ে নিতে নিতে মান্না বলে- ‘কলেমা শাহাদৎ পড়তো’।নিজে খুন করে নিজেই গেছে জানাজা করতে।ভয়ংকর সে সিকোয়েন্স!

৩. মান্নার আম্মাজান শবনমকে মান্নার ছোটবেলায় যে মালিক অসম্মান করেছিল সেই মালিকের সহহকারীকে পায় মান্না।জ্যোতিষীর কাজ করে সে।মান্না হাত দেখাতে যায় বলে- ‘দ্যাখেন তো, আজ থেকে অনেক বছর আগে যে শনির গ্রহটা আপনার ছিল সেটা এখন কোথায় অবস্থান করতেছে’..তারপর সব ঘটনা বলে।জ্যোতিষী সব অস্বীকার করে।মালিককে সাহায্য করা সে লোক সে ছিল না দাবি করে।তারপর মান্না জ্যোতিষীর মুখ চেপে ধরে বলে -‘খানকির পোলা, তরে আমি খুঁইজা বেড়াইতেছি..আমার মা বিশ বছর আমার লগে কথা কয় না শূয়রের বাচ্চা’..বিশ বছরের যন্ত্রণা তুই বুঝবি না’…তখন মান্নার রক্তচক্ষু আর অ্যাঙ্গার এক্সপ্রেশনের সাথে মুখের ভঙ্গি দেখে মুগ্ধতা ছাড়া আর কিছুই কাজ করে না..

কষ্ট (২০০০)
মান্নার অনেক কষ্ট তাই স্ত্রী মৌসুমী আর ভাই শাকিলকে বলছে ছোটবেলার কথা।বাবা কাজী হায়াৎ প্যারালাইস্ট ছিল।মান্না সেজন্য ভয় পেত সন্তান নিতে।সে কথা মৌসুমীকে বলে- ‘আমার বাবা প্যারালাইস্ট ছিল..খালি আ আ করত..আমাদের সন্তান যদি প্যারালাইস্ট হয় আর বাবার মত আ আ করে’..তখন ‘আ আ’ বলার সময় মান্না হাত দুটো নেড়ে বুঝিয়ে দেয় বাবা কিভাবে ‘আ আ’ করত..অ্যামেজিং অ্যাকটিং..

[su_box title=”রহমান মতি’র চোখে লেগে থাকা সিকোয়েন্স” box_color=”#0f86de”]চোখে লেগে থাকা সিকোয়েন্স এর সকল পর্বের জন্য দেখুনলিংক [/su_box]

আমি জেল থেকে বলছি
মাথাভর্তি জটা চুল আর মুখভর্তি দাড়িতে মান্না আসামী চরিত্রে জাস্ট সুপার লুকিং এ সিনেমায়।একটা সিকোয়েন্সে মওলানা ওমর সানী মান্নাকে বোঝাচ্ছে খুন করে সে ভালো করেনি আর মান্না ভারী ভয়েসে তার কথার জবাব দিচ্ছে শব্দ করে।এখানেও সাইলেন্ট অ্যাকটিং আছে যা ছিল গলার কারসাজিতে..

ভাইয়া (২০০২)
জমজ মান্না।ছোটভাই মান্নার ফাঁসি হচ্ছে অন্যায়ভাবে।বড়ভাই জেলের বাইরে তখন।ফাঁসি হচ্ছে ঠিক দেয়ালের এপার ওপার ব্যবধানে।ফাঁসির সময় জমজ হবার কারণে গলাটা ধরে এল বড়ভাইয়ের।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।গলায় হাত দিয়ে বারবার শ্বাস পরীক্ষা করছিল মান্না।অভিনয়টা সুপার।টাচি সিকোয়েন্স..

শান্ত কেন মাস্তান (১৯৯৮)
বোনের সাথে বেয়াদবির পরে মান্না বখাটেকে মারতে যায়।পেছনে আসে মা ডলি জহুর।বখাটেকে মারতে মারতে হাতটা ধরে টান দিতে থাকে।হঠাৎ বখাটের হাত উপড়ে আসে।ভয়ংকর সিকোয়েন্স।মান্নার অভিনয় তখন সাক্ষাৎ বাঘ যেন।সেই থেকে নাম হল ‘হাত কাটা শান্ত’..

বর্তমান
বেকারত্ব থেকে বাঁচতে টাকা খাটিয়ে মুরগির ব্যবসায় নামে মান্না।কলেজের টিচারের বাড়িতে গেলে টিচার জানতে চায় এ কাজ করছে।মান্না সহজ সরল রোলে বলে – ‘ম্যাডাম, আপনেই কইছেন, কোনো কাজই ছোট না..তাই বেকার না থাইকা এ ব্যবসায় নামছি’..ম্যাডাম খুশি হয়..চমৎকার সিকোয়েন্স..

উত্তরের খেপ
১. মান্নার ডিভোর্স হয় চম্পার সাথে।তারপর মাঝে মাঝে দেখা হয়।ট্রাক ড্রাইভারির ফাঁকে একদিন এক চায়ের দোকানের সামনে সিগারেটে টান দিতে দিতে জানালার ফাঁক দিয়ে চোখ টড়ে চম্পার দিকে।মান্নার খোঁচা খোঁচা দাড়ির সাথে মলিন মুখের স্যাড এক্সসপ্রেশনটি ছিল অসাধারণ!

২. শেষ সিকোয়েন্সে মান্না বিদায় নিতে এসেছে চম্পার কাছে।যাবার সময় ছেলেটা দৌড়ে এসে হাত ধরে বলে -‘বাবা, আমি যাব তোমার সঙ্গে’..মান্না হাঁটু গেড়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরা গলায় বলে ‘তুমি সত্যিই যাবে বাবা?’ – সংলাপটি দেবার সময় মান্নার এক্সপ্রেশন ভোলা যায় না!

manna dighi and subrata in kabuliwala bangladeshi film

কাবুলিওয়ালা
মিনির বিয়ের দিন জেল খাটা শেষে কাবুলিওয়ালা মান্না এসেছে।মিনির খোঁজ করলে তার বাবা সুব্রত তাকে নিয়ে আসে।বড় মিনিকে মান্না চিনতে পারে না।তাই আগের মতই ডাকতে থাকে- ‘খুকী, খুকী..এই দেখো তোমার জন্য আখরোট আছে..আখরোট লেবে, কিসমিস লেবে’..সুব্রত জানায় মিনি বড় হয়েছে আর আজ তার বিয়ে।মান্না তখন নিজের দেশের বাড়িতে থাকা মেয়ের কথা ভাবে আর বলে- ‘হামার মেয়ে বড় হয়ে গেল!’
সে অভিনয় দেখলে মনটা জুড়িয়ে যায়..

এমনি আরো অনেক সিকোয়েন্স রাতভর বলা যাবে যেগুলো শুধুই অসাধারণ..মান্নাভাই আমাদের গর্ব..

মান্নাভাই,
তুমি ভালো থেকো অন্য কোনো ভুবনে…


Leave a reply