Select Page

ছক্কা হাঁকিয়েছে ‘অপারেশন সুন্দরবন’

ছক্কা হাঁকিয়েছে ‘অপারেশন সুন্দরবন’

কোনো প্রত্যাশা না নিয়ে সিনেমা দেখার সবচেয়ে মজার বিষয় হলো মন্দ লাগলে খুব বেশি খারাপ লাগে না আবার যদি ভালো লাগে তবে সেই আনন্দের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়। ‘অপারেশন সুন্দরবন’ তেমনি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাপকাঠিতে অনেক বেশি পাওয়া।

একে তো বিশাল ক্যানভাস, সঙ্গে র‍্যাবের অভিযানের কাহিনীই সিনেমার মূল ভিত্তি; তাই স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যিক সিনেমার মোড়কে কতটা শক্তিশালী হবে তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাজ করছিল। সুন্দরবনের মতো রহস্য ঘেরা গহীন বনে ডকুমেন্টারি ঘরানার বাইরে এসে কীভাবে চিত্রায়িত হলো সেটাও ভাবনায় ছিল অল্পবিস্তর। তবে দীপংকর দীপন প্রথম সিনেমা ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এ যদি চার মেরে থাকেন তাহলে এবার ছক্কা হাঁকিয়েছেন।

সিনেমার প্রথমেই অ্যানিমেশনে সুন্দরবন এবং জেলেদের অপহরণ, অস্ত্র ব্যবসা, জলদস্যু প্রভাবিত আতঙ্কজনক পরিবেশ সম্পর্কে আইডিয়া দেয়া হয়। যা সহজেই গল্পের সাথে রিলেট করতে সাহায্য করে। এরপর গল্প এগোয় ভয়ংকর জলদস্যুদের ভয়াল থাবা থেকে সুন্দরবন রক্ষায় র‍্যাবের অভিযান উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। বাণিজ্যিক সিনেমার উপকরণ হিসেবে গল্পে মানবতা, দেশপ্রেম, সম্পর্কের টানা-পোড়েনসহ আরো অনেক কিছুই উঠে এসেছে; যা সিনেমাটি বোরিং করেনি।

প্রথম দৃশ্য থেকে অভিনয়শিল্পীরা পরিমিত অভিনয় করে গেছেন। সংলাপ ডিপার্টমেন্টও পাল্লা দিয়েছে পুরোপুরি। স্ক্রিপ রাইটার নাজিম-উদ-দৌলার জন্য শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা না জানিয়ে উপায় নাই। অকল্পনীয় বেশকিছু টুইস্ট এমনভাবে হাজির করেছেন। অন্যদিকে  সিনেমাটোগ্রাফি বিশাল ক্যানভাসের এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ পিলার। মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্যতে আপস-ডাউন হলেও সেই পিলার সাপোর্ট দিয়ে গেছে প্রায় পুরোটা সময়। সৌমদীপ্ত ভিকি গুইন ও রম্যদীপ সাহার জন্য হাততালি জানিয়ে রাখলাম।

কিছু কিছু ড্রোনশট তো মনোমুগ্ধকর ছিল। আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কথা। প্রেম-ভালোবাসা যখন পর্দায় হাজির সেই সময়ে ডিমান্ড অনুযায়ী ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর কানে মধু ঢেলেছে তেমনি আবার র‍্যাবের অ্যাকশন, ডাকাতদের ভয়াবহতা বোঝানোর সময় ভয়াবহ স্কোরও উপস্থাপিত হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। ভিএফএক্স কিছু কিছু জায়গায় আরো ভালো হওয়া উচিত ছিল। বাঘের কিছু দৃশ্য নিয়ে একটা অপ্রাপ্তি রয়েই যাবে। কালার গ্রেডিং নিয়েও একটু খুঁতখুঁতানি রয়ে যায়।

সিনেমার গানগুলো ইউটিউবে শুনতে যতটা ভালো লেগেছিল দেখতে অতটা লাগেনি; তবে প্রেক্ষাগৃহে দেখতে অসাধারণ লেগেছে। বিশেষ করে সিয়াম ও ফারিয়ার রোমান্টিক গানটি ম্যাজিক্যাল মনে হয়েছে। কস্টিউম ডিজাইনার নিজের কাজটা খুব ভালোভাবেই সামাল দিয়েছেন।

সিনেমার প্রথম ভাগ স্টোরি ও ক্যারেক্টার বিল্ডআপে সময় নিয়েছে। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একের পর এক হাজির হয়েছে দৃশ্যপটে এবং প্রতিটা সুতো জোড়া লাগানোর কাজটা প্রথমার্ধ বেশ ভালোভাবেই করেছে, যা দর্শকদের সিনেমার সাথে বেধে ফেলতে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয় ভাগে গতি প্রথমে একটু ঢিলেঢালাভাবে আগালেও পরে তাল ফিরে পায়। একটা সময় একের পর এক টুইস্ট সিনেমার শেষে কিছুটা সময় ‘এইটা কী হলো’ টাইপ অবস্থার মধ্যে নিয়ে যাবে।

সিনেমার আরেকটি বড় ইউএসপি একঝাঁক দক্ষ অভিনেতা। যাদের নিয়ে তালগোল না পাকিয়ে প্রতিটা চরিত্রই সিনেমা শেষে একটা সুত্রে যেভাবে মিলিত হয়েছে সেটা প্রশংসনীয়।

রিয়াজকে বড়পর্দায় দেখা গেল বছর ছয় পরে। আহামরি ভালো করেছেন সেটা বলা না গেলেও বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ চরিত্রে তিনি অনেক পরিপক্ক সেটার প্রমাণ দিয়েছেন। সিয়াম আহমেদ নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন আরো অনেকটাই। সায়েম চরিত্রে সিয়ামের সাবলীল অভিনয় দেখে আগের অনেক সিনেমার নানা দূর্বলতার কথা বলেছেন তারা নিঃসন্দেহে পরিবর্তন দেখতে পাবেন।

অবাক করেছেন মনোজ প্রামাণিক। অল্প সময়ের হলেও তার চরিত্রে ছিল একাধিক শেড। তিনি ভীষণ মুগ্ধ করে গেছেন। রোশানের এই পর্যন্ত যে কয়টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে তার মধ্যে সেরা পারফরম্যান্স এ ছবির রিশান চরিত্রে। সামনে তার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে বলেই আশা রাখি।

তাসকিন রহমান টাইপডকাস্ট হয়ে যাচ্ছেন যা তার ক্যারিয়ারের জন্য হতাশাজনক। শতাব্দী ওয়াদুদ এই সিনেমাতেও শক্তিমত্তার ছাপ রেখেছেন। রওনক হাসানের ক্ষেত্রেও একই কথা শতভাগ সত্য। আরমান পারভেজ ও রাইদুল ইসলাম আসাদ তাদের কাজটুকু করে গেছেন সফলতার সাথে। দীপু ইমামের কমেডি এই সিনেমার অন্যতম আলোচিত দিক হয়ে রইবে। উনি যতবারই হাজির হয়েছেন দর্শকরা হেসেছেন মন খুলে। নবাগত তানজিল তুহিন র‍্যাব সদস্য হিসেবে যতটুকু স্পেস পেয়েছেন তাতে সম্ভবনা দেখিয়েছেন।

নুসরাত ফারিয়াকে বাঘ গবেষক হিসেবে মানিয়েছে ভালোই। বিদেশ থেকে আসা বাঙালি তরুণী হিসেবে তার লুক, কস্টিউম বা সংলাপ ডেলিভারি মানানসই ছিল। সিয়ামের সাথে দেখতে ভালো লেগেছে। অন্যদিকে কলকাতার দর্শনা বণিক পাশের বাড়ির মিষ্টি মেয়ে হিসেবে নতুনত্ব নিয়ে বাংলাদেশে হাজির হয়েছেন। তার গ্ল্যামার ও কিউটনেস ছবিতে আলাদা মাত্রা যোগ করার পাশাপাশি রোশানের সাথে কেমেস্ট্রিও দারুণ। স্বল্প সময়ে নিজের কাজের ছাপ রেখেছেন তুয়া চক্রবর্তী। তার অভিনয় মুগ্ধ করার মতোই।

র‍্যাবের অঢেল সহযোগিতার প্রমাণ পুরো সিনেমা জুড়েই লক্ষ্য করা গেছে। আধুনিক অস্ত্র হোক বা হেলিকপ্টার, স্পিডবোট ফ্যাসিলিটি প্রতিটা ক্ষেত্রেই কোনো কমতি রাখা হয় নাই। স্বাভাবিকভাবেই এই বিশাল ক্যানভাসের সিনেমায় দেখানো টেকনিক্যাল অ্যাসপেক্ট এবং রিয়েল লোকেশনে শুট করা দৃশ্য অবাস্তব মনে হয়নি। দীপংকর দীপন ও তার টিমের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ভালো কিছু উপহার দেবার প্রচেষ্টা আক্ষরিক অর্থে একটি উদাহরণ রাখতে যাচ্ছে।

ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে সুসময়ের যে হাওয়া বইছে তাতে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন দেশীয় চলচ্চিত্র নিয়ে। এই হাওয়া ধরে রাখতেই প্রতি সপ্তাহেই সুস্থধারার ভিন্নধর্মী গল্পের বাণিজ্যিক সিনেমা মুক্তি দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শিল্পী ও কলাকুশলীরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘অপারেশন সুন্দরবন’ তালিকায় নতুন সংযোজন হতে পারবে কিনা তা সময় বলে দেবে। তবে বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে সব ধরনের দর্শকদের ভালো লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আফজালুর ফেরদৌস রুমন

শখের বশে চলচ্চিত্র ও নাটক নিয়ে লিখি

মন্তব্য করুন