ছায়া মরিচের বনে: সিঙ্গেল টেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শর্টফিল্ম
সিঙ্গেল টেকে তৈরি সিনেমা এই কনসেপ্টটার সাথে কি আপনি পরিচিত? শুরু থেকে শেষ অবধি, গোটা গল্প, গোটা সিনেমা একটা মাত্র শটে যেখানে তৈরি হয়। সাধারণত সিনেমা তৈরি হয় অনেকগুলো শট যা ভিন্ন ভিন্নভাবে নেওয়া হয় সেসব একত্রে জুড়ে দিয়ে তারপর। কিন্তু সিঙ্গেল টেক বা ওয়ান টেক সিনেমায় গোটা গল্পটাকে ধারণ করা হয় কেবলই একটি শটে। এই একটি শটের ভেতর আপনাকে প্রতিটি চরিত্রকে নিয়ে আসতে হবে, নিয়ে আসতে হবে গল্পের গোটা আদ্যোপান্ত। সেন্সর বোর্ডে আটকে যাওয়া মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে হইচইয়ের সময়ে আমি বলছি ইশতিয়াক আহমাদ জিহাদের তৈরি ২০মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ছায়া মরিচের বনে’র কথা যা ধারণ করা হয়েছে কেবলই একটা শটে।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি গল্পকে নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রটি। চিত্রনাট্য ও পরিচালনা ইশতিয়াক আহমাদ জিহাদের। মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া এক যুবক রফিকের ঘরের মা-বাবা-ভাই-বোন এর প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন কাটানোর এক রাতে ওই যুবক মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধে নিহত হওয়ার সংবাদ দিতে তার বাড়িতে আসে সহযোদ্ধারা। তারা প্রবেশ করার পূর্ব মুহুর্তেই বাড়িতে উপস্থিত হয় রাজাকার রমজান তার সঙ্গী নুরুকে নিয়ে। ঘরে লুকিয়ে রাখা সন্তান-সন্ততিকে সামলে তাদের মুখোমুখি হয় রফিকের বাবা ফরাজ মিয়া। পরহেজগার এই মানুষটার ওপর মানসিক টর্চার চালায় রাজাকাররা। হুমকি দিয়ে চলে যাওয়ার পরে বাইরে লুকে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ ও তার সহযোদ্ধা বকু। তারপর কাহিনী মোড় নেয় অন্যদিকে। যেখানে এসে হাজির হয় মুক্তিযুদ্ধের রুঢ় বাস্তবতা, ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প। শেষে সেই শান্তশিষ্ট পরহেজগার ফরাজ মিয়াকে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হয়।
এই শর্টফিল্মের বিশেষত্ব আগেই বলেছি, এটা সিঙ্গেল টেকের শর্টফিল্ম। সিনেমাটোগ্রাফার সামিউল করিম সুপ্তকের প্রশংসা করতেই হয়। এই একটা শটের ভেতরেই তিনি লং শট নিয়েছেন, কখনো ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে চিত্রগ্রহণ করেছেন। ক্লোজ শট নিয়ে সেসব এর অ্যাঙ্গেলও পরিবর্তন করেছেন। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, তিনি একই ফ্রেমের ভেতরেই একের পর এক নতুন নতুন দৃশ্য তৈরি করেছেন। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসা আমজাদ থেকে ক্যামেরা সরিয়ে তাক করেছেন সরাসরি হেঁটে আসা রাজাকার রমজানের দিকে। সে ক্যামেরা আবার ঘুরে একই ফ্রেমে নিয়ে আসছে নামাজে সালাম ফেরানো ফরাজ মিয়ার দিকে। এই দৃশ্য যিনি দেখবেন তিনিই চোখ ফেরাতে পারবেন না।
এই শর্টফিল্মের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো কালার গ্রেডিং। আমরা যাকে মনোক্রোমাটিক, কিংবা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট বলে থাকি এই কালারটি তার কোনোটাই নয়। দু’টোর মাঝামাঝি কিছুটা গ্রিনিশ এবং ডার্ক টোনে করা কালার। যার ফলে চরিত্রগুলো ইনটেন্স হচ্ছিলো। আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’তে কিছুটা এমন কালার পাওয়া যায়। যদি আমি ভূল না করি, লাইট ও ফ্রেমের সীমাবদ্ধতা ঢাকতে গিয়ে তারা এই কালারে কাজ করেছেন এবং সত্যি বলতে তাদের উদ্দেশ্য সফলই। শুধু কিছু জায়গায় লাইটের বিপরীতে ফ্রেম ধরতে গিয়ে কালারের কারণে চরিত্রগুলোর চেহারা এতই ডার্ক হয়ে যাচ্ছিলো না চোখে লাগবে। তবুও মুস্তফা প্রকাশকে কালারের জন্য বাহবা দিতে হয়। হারিকেন-চেরাগের আলোটা ভালোই লাগছিলো ওই কালারের সাথে দেখতে।
মাটির ঘরে শ্যুটিং করা হয়েছে। ছিলো বাসন-কোসন, দেয়ালে সূরা-কালামের মতো প্রপ্স। কস্টিউম-মেকাপ সব মিলিয়ে ১৯৭১কে ধারণ করার একটা প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। সাউন্ড মিক্সিংয়ের কাজ করেছেন হাসিব আহমেদ আর আহসাবুল ইয়ামিন। ফলির কাজ ছিল জীবন্ত। পাতার শব্দ, ঝিঁঝির ডাক, সাথে ঝকঝকে ডায়ালগ ডেলিভারি এসব মিলিয়ে সাউন্ড হয়েছে দারুণ। কিন্তু রফিকের মা-কে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে যাওয়াটা কানে ধাক্কা লাগার মতো ছিলো।
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এই গল্পের মূল প্রোটাগনিস্ট ফরাজ মিয়ার চরিত্র করেছেন। এই ধরণের গল্পে জয়ন্ত একদিকে যেমন সাবলীল, অন্যদিকে পরিচিতও। আমরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পে জয়ন্তকে দেখলেই বুঝে যাই তিনি এখানে কোন চরিত্রটা প্লে করবেন, ঠিক সে চরিত্রেই তিনি হাজির হয়েছেন ‘ছায়া মরিচের বনে’তে। এ সকল ক্ষেত্রে সমস্যাটা হয় এই যে, দর্শক কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তারা বুঝেন জয়ন্ত এখানে মহৎ কোনো চরিত্রেই থাকবেন। এমনিতে জয়ন্তের অভিনয় নিয়ে কিছু বলার নেই, তা বরাবরের মতনই দারুণ। একই সাথে তা কমই আকর্ষণ করছিলো এইই যা…
তার বাইরে বাকিদের অভিনয় বিশেষভাবে বলার নেই। সিঙ্গেল টেকের কাজে চ্যালেঞ্জ থাকে। সে অনুযায়ী ভালোই। শুধু তরুণ চরিত্রগুলোর ডায়ালগ ডেলিভারিতে অতি আধুনিকত্ব ছিলো। তারা চাইলেও আঞ্চলিকতাটা নিজেদের ভেতর আনতে পারছিলেন না; ১৯৭১ আর ২০২৩ এর আঞ্চলিক ভাষাতেও তো বিস্তর ফারাক, সে অনুসারে বলছি।
জিহাদের এই কাজে নতুন ব্যাপার হলো গৎবাঁধা ‘টুপি-পাঞ্জাবী-দাড়িবেষ্টিত দানব’ যে রাজাকার ধারণা আমাদের এখানকার কাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত, জিহাদ সেখানে নতুন একরূপে হাজির করেছেন রাজাকারকে। যে রাজাকার মানুষের মতনই, দানব নন। যে আমার আপনার আশেপাশের মানুষই, আমাদের মতনই তার চেহারা।
জিহাদের এই ধরনের গল্প খুব একটা নতুন নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ ধরণের গল্প কমবেশি প্রচলিত। কিন্তু তার চিত্রনাট্য ইউনিক। তিনি এখানে খুবই স্বল্প সংলাপে, খুবই স্বল্প সময়ে অনেকগুলো চরিত্রকে বিল্ডআপ করেছেন। সেসব চরিত্রের নিজস্ব কিছু গল্প আছে যার পরিণতি দর্শক নিজেই সাজিয়ে নিতে পারবেন। এই যে দর্শকের হাতে ছেড়ে দেওয়া, বাংলাদেশি শর্টফিল্মে এই প্রবণতাটা খুবই কম। তাইই আমাদের এখানে শর্টফিল্ম দর্শকপ্রিয়তা তুলনামূলক কম পেয়ে থাকে। জিহাদ সেদিক থেকে আমাদেরকে হয়তোবা নতুন কিছুরই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বলা যায়।