‘ছুটির ঘণ্টা’র স্মৃতি কখনো ছুটি নেবে না
‘ছুটির ঘণ্টা’ মুক্তির পর দেখা গেল, শিশুমৃত্যুর কারণে কারো মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়নি। সবাই শুধু কাঁদছে। কোনো কোনো হলে পাঁচ মাস ধরে চলেছিল ছবিটি। কোনো কোনো হল শুধু নারী দর্শকদের নিয়েই হাউসফুল হয়ে যেত।
১৯৮০ সালের ঘটনা। তখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছবি দেখার চল ছিল দেশে। ছবির গল্প উঠে আসতো পাড়া-মহল্লার আড্ডার আলোচনায়, মনে ধরলে গান ফিরতো মানুষের মুখে মুখে। সিনেমা দেখার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম। এই আনন্দের মাঝখানে একদিন হানা দিলো ‘দুঃখ’!
যে যায় হলে ছবিটা দেখতে সে ফিরে আসে কান্না নিয়ে। এই কান্না মাখানো ছবির নাম ‘ছুটির ঘণ্টা’। আজও এই ছবির গান গায় মানুষ!
‘একদিন ছুটি হবে/অনেক দূরে যাব/ নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাবো’ অথবা আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী/ সাথী মোদের ফুলপরী/ ফুলপরী, লালপরী, লালপরী, নীল পরী/ সবার সাথে ভাব করি..
‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির পরিচালক ছিলেন আজিজুর রহমান। ছিলেন একারণে বলা-উনি এখন আর পৃথিবীতে নেই। স্থায়ী ছুটিতে চলে গেছেন। গত সোমবার (১৪ মার্চ) বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় তিনি কানাডার একটি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গত কয়েক বছর কানাডাতেই থাকতেন ছেলেমেয়ের সাথে। হয়তো ফিরবেন ‘পৃথক পালংকে’, ঘুমাবেন কোন এক মাটির ঘরে। নিজের বানানো ছবির মতো ছবি হয়ে থাকবেন মানুষের মনে, তার স্মৃতি ছুটি নেবে না কখনো।
কলেজ পাশ করার পর কমার্শিয়াল আর্ট নিয়ে ডিপ্লোমা করেছিলেন। সে পথে না হেঁটে জীবন শুরু করেছিলেন পরিচালক এহতেশামের সহকারি হিসেবে। এহতেশাম পরিচালিত ‘এদেশ তোমার আমার’ ছিল সহকারি হিসেবে তার প্রথম ছবি । নিজের পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘সাইফুল মূলক বদিউজ্জামান’। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। ‘রূপবান’ মুক্তি পাবার পর ‘ফোক’ ছবির একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল দেশে। যদিও এরপরের ছবিগুলোতে তিনি এই পথে হাঁটেননি,জড়িয়ে পড়েছিলেন সামাজিক গল্পনির্ভর বাণিজ্যিক ধারার ছবির সাথে। গানগুলো ছিল তার ছবির প্রাণ।
সাইফুল মূলক বদিউজ্জামানের মতো আরও তিনবার তিনি ছবি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। ভিন্ন ধারার গল্প নিয়ে বানিয়েছিলেন ‘স্বীকৃতি’ নামের ছবি যা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর। একই বছর তার আরও একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল যার নাম ‘সমাধান’। কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা ‘কুয়াশা’ (জানি না এটা সত্যি সত্যি কাজী আনোয়ার হোসেন লিখেছিলেন কি না) সিরিজের একটা গল্প থেকে থ্রিলারধর্মী ছবি বানিয়েছিলেন যার নামও ছিল ‘কুয়াশা। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৭ এর ১৫ এপ্রিল। এই ছবিতে তিনি তার গানের বলয় ভেঙ্গেছিলেন। বরাবর তার ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করতেন প্রয়াত সত্য সাহা। কুয়াশা ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন প্রয়াত আজাদ রহমান। এরপর তার স্টাইল মোতাবেক তিনি আর এই পথে হাঁটেননি। সর্বশেষ যে ছবি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন তার নাম ‘ছুটির ঘণ্টা’।
ছুটির ঘণ্টাতে ফেরার আগে তার কয়েকটা ছবির দিকে নজর দেয়া যাক। অপরাধ (১৯৭৫), গরমিল (১৯৭৬), সাম্পানওয়ালা(১৯৭৯), মাটির ঘর (১৯৭৯),অমর প্রেম (১৯৭৭), অনুভব (১৯৭৭), অগ্নিশিখা (১৯৭৮) এবং অশিক্ষিত (১৯৭৮)।
বাণিজ্যিকভাবে সফল হতো বলে তার ছবির তালিকা দীর্ঘ। তিনি নিজেও কিছু ছবির প্রযোজনা করেছেন। সর্বশেষ প্রচেষ্টা ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘মাটির ঘর’। তার নির্মিত সিনেমার সংখ্যা ৫৪টি। মাটির ঘর ছবিতেও এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট ছিল। নায়িকা গ্রামের মোড়ল ও তার লোকদের হাতে ধর্ষিতা হলে নায়ক নিজে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। অতি নাটকীয় সে গল্পে সবাইকে মেরে নায়িকার মুখোমুখি হয়ে নায়ক রাজ্জাক তাকে জিজ্ঞেস করে ‘তুই আমার সাথে যাইবি না আমিনা? এরপর নায়িকা শাবানাকে গুলি করার পর নিজেও কবরের পাশে মৃত্যবরণ করে। এই ছবির এক জনপ্রিয় গান ছিল-’আমার নায়ে পার হইতে লাগে ষোল আনা’। ঢাকা শহর নিয়ে মজার গান আছে ‘অশিক্ষিত’ ছবিতে। “ঢাকার শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে/লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখ্যা পরান জুড়াইছে”- যা এখনও জনপ্রিয়।
‘ছুটির ঘণ্টা’ নিয়ে তার এক্সপেরিমেন্ট স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘অশিক্ষিত’ ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যের পর একদিন পত্রিকায় একটা খবর দেখে চমকে যান। নারায়ণগঞ্জের একটা স্কুলে ছুটির আগে টয়লেটে আটকা পড়ে এক ছাত্র। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল ঈদের ছুটি। ছেলেটি এখানেই আটকে থাকে, স্কুল খোলার আগে এখানেই তার মৃত্যু হয়। স্কুল খোলার পর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়, স্কুলের দপ্তরী তার অবহেলার কথা স্বীকার করে জেল খাটেন। এই ঘটনাটা তার মাথা থেকে নামছিল না। তিনি কয়েকজন প্রযোজককে এই গল্প শোনালে তারা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। শেষে ‘অশিক্ষিত’ ছবির প্রযোজককে তিনি রাজী করাতে পারেন। যদিও ‘অশিক্ষিত’ ছবির শেষদৃশ্যে মোড়লরূপী এটিএম শামসুজ্জামানের গুলিতে মাস্টার সুমনের নিহত হওয়া নিয়ে বিরূপ সমালোচনা হয়েছিল। এই ছবির শেষদৃশ্যে রাজ্জাক শিশুমাস্টার সুমনকে দুই হাতে তুলে নিয়ে রওয়ানা হন মৃতদেহের সৎকারে, তার সাথে জড়ো হয় পুরো গ্রামের মানুষ।
‘ছুটির ঘণ্টা’র শেষ দৃশ্যও তেমন। দপ্তরীরূপী রাজ্জাক স্কুলের টয়লেট থেকে বের করেন মাস্টার সুমনের মৃতদেহ। ব্যাকগ্রাউন্ডে স্লো ভার্সনে বাজে সেই জনপ্রিয় গান-’একদিন ছুটি হবে। অনেক দূরে যাব..।’
পরিচালক আজিজুর রহমান বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে, কানাডার একটা হাসপাতালে চিরস্থায়ী ছুটির আওতায় চলে গেছেন। আগেই লিখেছি পৃথক পালঙ্কে চড়ে হয়তো আসবেন, ঘুমাবেন সান্তাহারের কোথাও, যেখানে জন্মেছিলেন,যেখানে ঘুমিয়ে আছেন তার পূর্বপুরুষ! সান্তাহারে থাকাকালীন রেলের জীবনও টেনেছিল তাকে। ট্রেনচালকের জীবন নিয়ে ‘জনতা এক্সপ্রেস’ নামেও তার একটা ছবি আছে। এই ছবিতে নিজের সন্তান ট্রেনের নীচে পড়ে মারা যায়। প্রায় একই বাস্তবতা আছে তার তিন ছবিতে!
হয়তো নিজের জীবনে কখনো এমন বাস্তবতায় তিনি পড়েননি। হয়তো সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহার সাথে তার হৃদয়গত কিংবা ‘গানের’ সম্পর্ক ছিল। হয়তো গানকে ভালোবেসেই তিনি ছবি বানাতেন এটা জেনে যে একদিন তিনিও ছবি হয়ে যাবেন।
তিনি ছবি হয়ে অনেক দূরে গেলেও লালপরী, নীলপরীর কল্পনায় কিংবা ছুটির আনন্দে থেকে যাবেন মানুষের হৃদয়ে। ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন জাদুকর জুয়েল আইচ। আটকে পড়া মাস্টার সুমন ভেবেছিলেন জাদুকর জাদু দিয়ে তাকে বাঁচাতে পারবেন। মানুষ অনেক কিছু পেরেছে,পারেনি চিরস্থায়ী ছুটি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। ‘ছুটির ঘণ্টা’ মুক্তি দিতে চায়নি সেন্সর বোর্ড। হয়তো শুরু থেকেই সেন্সর বোর্ডের চরিত্র একই রকম আছে। ছবিটি মুক্তি দেয়ার আগেই ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছবিটির প্রদর্শনী করা হয়েছিল। দেখা গেল, শিশুমৃত্যুর কারণে কারো মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়নি। সবাই শুধু কাঁদছে। এরপর ছবিটি ছাড়পত্র পেলেও মাত্র বিশটা হলে মুক্তি দেয়া হয়েছিল প্রথমে। কোনো কোনো হলে পাঁচ মাস ধরে চলেছিল ছবিটি। কোনো কোনো হল শুধু নারী দর্শকদের নিয়েই হাউসফুল হয়ে যেত। আহা বাংলা ছবির সেইসব স্বর্ণালী দিনগুলো।
‘ছুটির ঘণ্টা’ কাঁদিয়েছে কোটি দর্শককে, কাঁদাবেও। আমাদের শৈশবের সুখস্মৃতি জমা হয়েছিল আপনার ছবিতে। আপনি ছুটিতে গেলেন,স্মৃতি সেই একই জায়গায় রয়ে গেল আগের মতো। শেষ ঘুমের জন্য যখন আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে মাটির কাছে আমাদের মনে পড়বে ‘মাটির ঘর’ কিংবা ‘অশিক্ষিত’ ছবির কথা। মনে পড়বে ‘জনতা এক্সপ্রেস’ কিংবা ‘ছুটির ঘণ্টা’র কথা।
আপনাকে নিয়ে মানুষের যত স্মৃতি সেসব কখনো ছুটি নেবে না!
*লেখাটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত