জহির রায়হানের ‘কখনো আসেনি’র নেপথ্য কাহিনি
জহির রায়হান চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৫৭ সালে। এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র (১৯৫৯) সহকারী পরিচালক হিসেবে। ১৯৫৯ সালে ঘোষণা দেন নিজে সিনেমা বানানোর। ছবির নামও জানিয়ে দেন। ‘কখনো আসেনি’।
শুরু থেকেই তার আগ্রহ ছিল পরিচালনার। পরিকল্পনা শুরু করে দেন ‘জাগো হুয়া সাভেরা’তে কাজ করার সময়েই। কাহিনিও দাঁড় করিয়ে ফেলেন। তবে জুতসই নাম পাচ্ছিলেন না। সেটা দেন মাসিক সচিত্র সন্ধানীর সাংবাদিক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ। কিন্তু মূল সমস্যা ছিল অন্য। ছবি বানাতে অনেক টাকার দরকার হয়। তা জোগাবে কে?
সেজন্য পরিচিত-অপরিচিত সব মানুষের কাছেই ধরনা দিতে থাকেন। যার কাছেই মনে হয় টাকা পাওয়া যাবে যান তার কাছেই। সঙ্গে গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ। এমনকি একবার নারায়ণগঞ্জের এক পাটের গুদামের মালিকের কাছেও যান! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য শিঁকে ছিঁড়ত না। শেষ পর্যন্ত প্রযোজনার দায়িত্ব নেন আজিজুল হক ও মনজুরুল হক। জহির রায়হানেরই প্রতিষ্ঠান লিটল সিনে সার্কেলের ব্যানারে।
তখন একটা সুবিধা ছিল। এফডিসি থেকে পাওয়া যেত কারিগরি সুবিধা। কিন্তু সেজন্য ২৫ হাজার টাকা জমা রাখতে হতো। সেটার বন্দোবস্ত অন্যভাবে হয়ে যায়। ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র পর আরো দুটো ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করেন জহির রায়হান। এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ (১৯৫৯) ও সালাহ্উদ্দিনের ‘যে নদী মরুপথে’ (১৯৬১)। প্রথমটির নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী।১ শুটিংয়ের ফাঁকে মাঝে মধ্যে কথা হতো দুজনের। একদিন সুমিতা দেবী জিজ্ঞেস করেন, শট ডিভিশন থেকে শুরু করে সব কিছুই তো আপনি করেন। নিজে পরিচালনা করতে পারেন না? জহির রায়হান উল্টো প্রশ্ন করেন, টাকা জোগাবে কে? তার উত্তর সুমিতা দেবী দেন ‘কখনো আসেনি’র কাজ শুরু হলে। নাজীর আহমদ তখন এফডিসির নির্বাহী পরিচালক। তাকে বলে ২৫ হাজার টাকা জমা না দিয়েই এফডিসির কারিগরি সুবিধা নেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ১৯৬০ সালের মার্চে শুরু হয় শুটিং।
‘জাগো হুয়া সাভেরা’ থেকেই খান আতার সঙ্গে পরিচয় জহির রায়হানের। নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন আনিস নামে। ‘কখনো আসেনি’র নায়কও সে। পাশাপাশি গানেরও ওস্তাদ। তাকেই সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এপ্রিলে খান আতা করাচি যান। অন্য একটা সিনেমার সংগীত পরিচালনার কাজে। অবাক হয়ে দেখেন সেখানে গান রেকর্ড করতে খরচ খুবই কম হয়। দ্রুত টেলিগ্রাম পাঠান ঢাকায়। হাজার ছয়েক টাকা পাঠালে ‘কখনো আসেনি’র সবগুলো গান রেকর্ড করে নিয়ে আসবেন। প্রস্তাবটি সবারই মনে ধরে। কিন্তু ওই একই সমস্যা। টাকা পাওয়া যাবে কোথায়?
আর কোনো উপায় না দেখে জহির রায়হান এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন। একদিন সকাল সকাল যান গাজী শাহাবুদ্দিনের বাসায়। তাকে বলেন, এমন একজনের কাছে যাবেন, যাকে বললেই টাকা পাওয়া যাবে। তারপর নিয়ে আসেন নিজেরই বাড়িতে। তার বাবা ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। ভীষণ ধর্মভীরু। গাজী শাহাবুদ্দিনকে তার সামনে ফেলে নিজে সটকে পরেন! কথা শুনে জহির রায়হানের রাশভারি বাবা কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকেন। তারপর কিছু না বলেই চলে যান দোতলায়। একটু পর ফিরেও আসেন। হাতে তুলে দেন একটি চেক। সঙ্গে সঙ্গে দুজনে চলে যান ব্যাংকে। টাকা তুলে পাঠিয়ে দেন করাচি। ছবির চারটি গানই রেকর্ড করিয়ে নেন খান আতা। কলিম শরাফী ও মাহবুবা রহমানের কণ্ঠে।
পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয় ছবিটির কাজ। জমা দেয়া হয় সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য। কিছু দৃশ্য নিয়ে আপত্তি তোলেন সেন্সর বোর্ডের কয়েকজন সদস্য। জহির রায়হান ফুল বোর্ডে ছবিটি দেখার দাবি জানান। এসবে কেটে যায় আরো কয়েক মাস। শেষ পর্যন্ত জুনে ছাড়পত্র পায় ‘কখনো আসেনি’।
ছবিটি হলে মুক্তি দিতে গিয়ে আরেক দফা লড়াই করতে হয়। তখনো ঢাকার বাংলা ছবির বাজার একদমই পোক্ত হয়নি। বানানোই হয়েছে মোটে দশ-বারটা। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু আর ভারতের হিন্দি ও বাংলা ছবিই চলত বেশি। তাই প্রদর্শক-পরিবেশকদের সব আগ্রহও ছিল সেসব সিনেমার প্রতি। স্বভাবতই ‘কখনো আসেনি’ নিয়ে তারা তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ করেনি।
শেষ পর্যন্ত ছবিটি মুক্তি পায় ১৭ নভেম্বর। ঢাকার মায়া, নারায়ণগঞ্জের ডায়মন্ড ও যশোরের নিরালা সিনেমা হলে। তখন ঢাকায় উর্দু-হিন্দি তো বটেই, এমনকি চলছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯)। তার মধ্যেই মায়াতে ছবিটি চলে চার সপ্তাহ।
অবশ্য সব মিলিয়ে ছবিটি ব্যবসায়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তবে প্রশংসা কুড়িয়েছিল খুব। অংশ নেয় মস্কো, তেহরান ও কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে। আর ছবিটি সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা হয় ছবিটিরই বিজ্ঞাপনে। ‘দেশের জনসাধারণ বিশ বছর পর যে ছবি দেখবে বলে আশা করেছিল বিশ বছর আগেই দেশের তরুণরা সে ছবি তাদের উপহার দিল।’
টীকা:
১ সেখান থেকেই জহির রায়হান ও সুমিতা দেবীর সম্পর্কের শুরু। ১৯৬১ সালে তারা বিয়ে করেন।