জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৯: সেরা চিত্রনাট্য নিয়ে অভিযোগ!
ভারতীয় লেখকের নাম না রেখে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগের পুরস্কার নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে ‘ন ডরাই’ সিনেমার বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছে, যৌথভাবে সেরা চলচ্চিত্র নির্বাচিত হওয়া এ সিনেমার প্রযোজক মাহবুব উর রহমান পুরস্কারটি পেলেও ভারতীয় সহকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়নি।
নিউজ নেক্সটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহবুব এবং জুরি বোর্ড দাবি করছেন এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে চলচ্চিত্রটির অফিসিয়াল ট্রেইলার, হলে প্রদর্শিত সংস্করণ এবং উইকিপিডিয়ায় লেখক হিসেবে ওপার বাংলার সুপরিচিত চিত্রনাট্যকার শ্যামল সেনগুপ্তের নাম দেখা গেছে।
এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমটিকে শ্যামল বলেন, “এটা নিয়ে আমি কোনো ঝামেলা তৈরি করতে চাই না। তবে আমার কাছে ঘটনাটি খুবই অগ্রহণযোগ্য লাগছে। এটা কি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মর্যাদা নষ্ট করবে না? খোদ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী যে পুরস্কারটি হাতে তুলে দেবেন, সেখানে এমন ধোঁকাবাজি পুরো দেশের সম্মানের জন্যই ক্ষতিকর।”
“বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের যে জুরি বোর্ড, তারা কি কোনো কিছুর খোঁজ রাখেন না?” এমন প্রশ্নও তোলেন তিনি।
তিনি বলেন, “তাদের শৈথিল্য দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। সিনেমাটি যদি বেশী আলোচিত না হতো, তাহলেও না হয় বুঝতাম তারা এ সম্পর্কে জানতেন না। যেখানে এত জায়গায় আমার নাম আছে, তারা কী করে এমনটা করলেন?”
তবে প্রযোজক মাহবুব বলেন, পুরস্কারটি আসলে আমার প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। তাই সেখানে আমার নাম এসেছে। তিনিও (শ্যামল) আমাদের অংশ ছিলেন। একসাথে দলগতভাবেই কাজটি আমরা করেছি।”
“আসলে মূল গল্পটা আমার তৈরি করা। চিত্রনাট্যের কাজও এখানে (বাংলাদেশে) আমরাই করেছি। তবে তিনি যেহেতু অভিজ্ঞ, পুরো প্রক্রিয়ায় তার সাহায্য নিয়েছি,” যোগ করেন তিনি।
“শ্যামল সেনগুপ্ত শুধু ‘ডক্টরিন’ (তাত্ত্বিক সহায়তা) করেছিলেন। তিনি খুবই প্রবীন লেখক। যে কারণে শ্রদ্ধাবোধের জায়গা থেকেই সিনেমার ‘ক্রেডিট লাইনে’ লেখক হিসেবে তার নাম দিয়েছিলেন আমাদের প্রযোজক,” মাহবুবের সাথে আলাপে এ তথ্য পাওয়ার কথা জানান পরিচালক তানিম রহমান অংশু।
এ দিকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে জুড়ি বোর্ডের সদস্য সচিব এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসীম উদ্দিন বলেন, “কাগজেপত্রে যেটা আছে, সেটা দেখেই আমরা পুরস্কার দিয়েছি।”
“জুড়ি বোর্ডের কাছে যে প্রস্তাবণা গিয়েছে, সেখানে চিত্রনাট্যকার হিসেবে ওনার (মাহবুব) নামই দেওয়া হয়েছে। সেন্সর সনদেও তাঁর নাম আছে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা কাগজপত্রের বাইরে যেতে পারি না,” বলেন তিনি।
জুরি বোর্ডের সদস্য সচিব বলেন, “ন ডরাই’ সিনেমাটি কক্সবাজারের এক ‘সার্ফার মেয়ের জীবনের সত্য কাহিনী অবলম্বণে চট্টগ্রামের ভাষায় তৈরী। আর তিনিও (মাহবুব) চট্টগ্রামের মানুষ, যার কক্সবাজারে নিয়মিত যাওয়া-আসা আছে। কলকাতার কোনো মানুষের পক্ষে সেখানকার এই গল্প বা ভাষা জানা সম্ভব নয়। যে কারণে আমার মনে হয় না অভিযোগটা সত্য।”
এ দিকে প্রযোজনা সংস্থার পক্ষে দুইজন বাংলাদেশি সার্বিক সহায়তা করলেও “রুহেল গল্প বা চিত্রনাট্যের একটি শব্দও লেখেনি” উল্লেখ করে শ্যামল বলেন, “প্রভাবশালী হলে যা খুশি করা যায়- এমন বিপদজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ সৃষ্টি করা হলো।”
তার দাবি, ২০১৬ সালে প্রথমে তাকে শুধু গল্পটি লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তখন তিন মাস বসে তিনি যে গল্পটি লিখছিলেন, সহ-প্রযোজকের খোঁজে সেটা ভারতের গোয়ার চলচ্চিত্র উৎসবের ‘ফিল্ম বাজারে’ জমা দেওয়ার পর তাকে চিত্রনাট্য তৈরির কাজে নিয়োজিত করা হয়।
ওই বছরের শেষের দিকে কক্সবাজারে গিয়ে টানা ছয়দিন ছিলেন তিনি। প্রযোজকের পক্ষ থেকে তাকে সেখানকার আলোচিত নারী সার্ফার নাসিমার গল্প নিয়ে তৈরী বিভিন্ন প্রামান্যচিত্র ও কক্সবাজার বিষয়ক কিছু বই সরবরাহ করা হয়। দেশে ফিরে এক বছর ধরে চিত্রনাট্যটি তৈরি করেন তিনি। পরবর্তীতে দৃশ্যায়ণ, এমনকি সিনেমা মুক্তির সংবাদটিও তাকে দেওয়া হয়নি।
ছবি মুক্তির পর আইএমডিবির ওয়েবসাইটে ‘ন ডরাই’ সিনেমার গল্পকার হিসেবে প্রযোজকের নাম দেখে চমকে ওঠেন শ্যামল। তিনি বলেন, “এমনিতে রুহেল খুবই ভদ্রলোক, সৌমদর্শন, অমায়িক তাঁর ব্যবহার। সে এই কাজ করবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। সেটাও না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু তাই বলে এমন হাস্যকর মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতীয় পুরস্কার নিতে হবে!”
‘ন ডরাই’ এবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছয়টি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। পুরস্কার ঘোষনার পর প্রযোজকের সাথে কথা হওয়ার কথা জানিয়ে শ্যামল বলেন, “সে আমাকে বলছে, বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কারের নিয়ম অনুযায়ী কোনো বিদেশীর মনোনীত হওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে চিত্রনাট্য বিভাগে তারা আবেদন করলো কেন?”
এর আগে ২০১৭ সালের ‘ঢাকা অ্যাটাক’ চলচ্চিত্রের জন্য ‘সেরা সম্পাদক’ হিসেবে ভারতীয় নাগরিক মো. কালামের নাম ঘোষণা করা হলেও পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া ২০১৬ সালের ‘নিয়তি’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নৃত্য পরিচালক হিসেবে এমন একজনের নাম ঘোষণা করা হয়, যে সেই ছবিতে কাজই করেননি।
২০১৪ সালে সরকারি অনুদানে নির্মিত ‘বৃহন্নলা’সিনেমাটির কাহিনী পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছোটগল্প ‘গাছটি বলেছিল’ থেকে নেওয়া হলেও নির্মাতা মুরাদ পারভেজ গল্পকার হিসেবে নিজের নাম দিয়েছিলেন। যে কারণে তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ গল্প ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পেলেও পরে তা বাতিল করা হয়।