Select Page

জালালের গল্প- একটি খাঁটি “বাংলাদেশী” সিনেমা

জালালের গল্প- একটি খাঁটি “বাংলাদেশী” সিনেমা

11986965_10156004916495442_2323524293145204396_n

সিনেমার নাম- জালালের গল্প (২০১৫)

“এটি একটি সামাজিক একশনধর্মী সিনেমা, সাথে রোমান্স ও আছে”, “এই সিনেমাতে দর্শক আমাকে সম্পূর্ণ নতুন করে আবিষ্কার করবেন, একদম ভিন্নধর্মী কাহিনী”, “এই সিনেমা দুই বাংলার সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল সিনেমা”, “আমার এই সিনেমাতে আমি যেই ধরনের টেকনোলজি ইউজ করেছি সেই ধরনের জিনিসের নাম টম ক্রুজের বাপ, দাদা,কাজের বুয়া- কেও শুনে নাই” – আপনি যদি এই একই ধরনের কথা শুনে ক্লান্ত, বিরক্ত আর হতাশ হন- তাহলে জালালের গল্প নামক সিনেমার আপনার জন্য একটি বিরাট “সুখবর” এর নাম কারণ এই সিনেমা দেখে হল থেকে আপনি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বের হবেন।

নদীতে ভেসে আসা এক নাম জানা ছেলে শিশুকে নিয়ে শুরু হয় কাহিনী, যার নাম পরে ঠিক করা হয় জালাল। জালাল একা আসে না গ্রামে, সাথে “সৌভাগ্য” নামক বস্তু নিয়ে আসে গ্রামবাসীর ভাষায়। সেই জালালকে ব্যবহার করে ব্যবসা শুরু করে তার পালক বাবা, সেই ব্যবসা “ধর্মান্ধতার” মোড়কে মোড়ানো- যেই মোড়ক খসে পড়তে খুব একটা সময় লাগে না। অবশেষে ভেসে আসা জালালকে আবার ভাসিয়ে দেয়া হয় অজানা গন্তব্যে।
সেই জালালের বয়স এবার নয় বছরের মত, পালক পিতা তৌকির আহমেদের বাসায় তার আশ্রয় হয়- আশ্রয়ের চেয়েও “সস্তা” তার অবস্থান- যেন বাড়ির এক কোনে পড়ে থাকা ময়লা যাকে অলসতার কারণে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছেনা অথচ সে এই বাড়ির সকল অনাচার আর অবিচারের নীরব সাক্ষী। সন্তানের বাবা না হতে পারা হতাশ তৌকির নতুন বউ ঘরে আনে, এরপরেও কিছু না হলে ওঝার শরণাপন্ন হয়, ওঝা কর্তৃক “ঝাড়ফুঁকের” আড়ালে সেই নতুন বউয়ের সাথে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক- যেন আধ্যাত্মিকতার আড়ালে জমজমাট ধর্মব্যবসা! অবশেষে এই পাপকর্মের দোষারোপ সেই জালালের ঘাড়ে এসে পড়া এবং আবার ছোট্ট “অপয়া” জালালের অনিশ্চিত যাত্রা!

এবার আশ্রয় এক ঠাণ্ডা মাথার খুনি আর নির্মম মানুষের কাছে, যিনি নির্বাচনে জেতার জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষের গর্ভের সন্তানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলতে দ্বিধাবোধ করেন না। জালাল কি পারবে নিজের জীবনের মত আরেকটি প্রাণকে “অনিশ্চিত” হওয়া থেকে বাঁচাতে?

এই সিনেমার সবচেয়ে পাওারফুল দিক হচ্ছে এটি আগাগোড়া একটি খাঁটি “বাংলাদেশী” সিনেমা। এখানে হলিউড মেকিং এর প্রতি দুর্বলতা নাই, না আছে বলিউড ফর্মুলার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ! পরিচালক সম্পূর্ণ নিজের ইউনিক স্টাইলে গল্প বলেছেন যার সাথে আপনি কারো তুলনা করতে পারবেন না কারণ তার গল্প বলার ধরণ ছিল একেবারেই তার নিজস্ব ঘরানার যেটা এখন প্রায় “রেয়ার” বলা চলে। ফার্স্ট হাফ এত দ্রুত এগিয়েছে যে কখন শেষ হল টের ই পেলাম না! “একটু অন্যরকমের’ সিনেমা মানেই যে সিনেমার গতি স্লো হবে, সবাই আস্তে আস্তে কথা বলবে, মাথা ঘুরায় তাকাতে দুই ঘণ্টা সময় নিবে,এরপরে ইচ্ছা হলে একটি সংলাপ বলবে- এই ধরনের কনসেপ্ট কে জালালের গল্প বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে এবং প্রমান করেছে যে দারুন লেভেলের গতি নিয়েও কত সাধারন আর চিরচেনা গল্পের এক অসাধারণ সিনেমা বানানো যায়! দারুণ মানানসই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যেটা কখনই গল্পকে ছাপিয়ে যায় না, বাংলাদেশ নামক দেশের গ্রামের অসাধারণ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা, দারুণ সিনেমেটোগ্রাফি, মোশাররফ করিম দা দিয়ে কোপ দেয়ার সময় গাছের ডালে কোপ দেয়ার মত অসাধারণ ডিটেলিং দৃশ্য, ওঝা বেরিয়ে যাওয়ার পর বোবা প্রাণী কুকুরের চিৎকার করে প্রতিবাদ এবং অবশেষে অসাধারণ এক ফিনিশিং- প্রশংসার পাল্লা ভারি হবে শুধু জালালের গল্প নিয়ে আলোচনা করতে গেলে।

যেই জিনিসটি নিয়ে প্রশংসা না করলেই নয়- সবার অভিনয়। পরিচালক তার প্রথম সিনেমাতে সবা কাছ থেকে দারুণভাবে অভিনয় বের করে এনেছেন। কিশোর জালাল আর যুবক জালাল- দুইজনই দারুণ। মৌসুমি হামিদ কে দেখে অবাক হয়েছি সবচেয়ে বেশি- ব্ল্যাকমানি আর ব্ল্যাকমেইল টাইপ সিনেমাতে নিজের প্রতিভা শুধু শুধু অপচয় করছেন তিনি, জালালের গল্প তার ক্যারিয়ারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ। জালালের সাথে বিচ্ছেদের সময় শর্মীমালার কান্নার দৃশ্য চোখ ভিজিয়ে দেয়। ওঝা চরিত্রে অভিনয়কারী- দারুণ! মোশাররফ করিম কে ছোট্ট কিন্তু দারুণ একটা ক্যারেকটারে দেখে মনে হয়েছে এই মানুষটার অভিনয় প্রতিভার আরও অনেক দিক আমাদের দেখা এখনও বাকি- এই কথা বলছি কারণ এই সিনেমাতে কাজের জন্য তিনি পর্তুগাল সিনেমার উৎসবে শত শত সিনেমাকে পিছনে ফেলে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন।

গল্প, স্ক্রিনপ্লে, পরিচালনা, অভিনয়, সেন্স অফ হিউমার যুক্ত (যেটা মোটেও ভাঁড়ামি না বরং অনেক স্মার্ট) সংলাপ ইজ ইকুয়াল টু জালালের সিনেমা। হলে গিয়ে এই সিনেমা না দেখলে আসলেই মিস করবেন, গত বেশ কয়েকবছরের আমি বাংলাদেশে এরকম সুনির্মিত বা polished সিনেমা আর দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। এখন পর্যন্ত ২০১৫ এর বেস্ট সিনেমা বললে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে জালালের গল্পের নাম বলব।

পরিচালক আবু শাহেদ ইমনকে বেশ কিছুদিন আগেই আমার রেডিওর সিনেমার শো তে অতিথি হিসেবে ডেকেছিলাম, তিনি প্রোগ্রাম শেষ হওার পর একটা কথা বলেছিলেন- সাকিব ভাই, আমি জানিনা আমি কি বানাইসি, তবে একটা কথা বলতে পারি, আমার সিনেমা দেখে আপনি বলতে পারবেন না “বোরিং”- কারণ আমি নিজেই বোরিং সিনেমা পছন্দ করিনা। আমি তাকে বলেছিলাম- আপনার সিনেমা ভাল হলে আমি যত ব্যস্তই থাকি না কেন, সেটা সম্পর্কে কিছু হলেও লিখব। আমরা দুইজনেই দুইজনের কথার বরখেলাপ করিনি 😉

এবার কাজ করার দায়িত্ব আপনার- হলে গিয়ে এই ধরনের সিনেমাকে উৎসাহিত না করলে অনেক বড় ভুল করবেন যার মাশুল আমাদের এই মৃতপ্রায় ইন্ডাস্ট্রির জন্য আরও বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে কষ্টের ব্যাপার হল, এরকম ভাল একটি সিনেমা সারা দেশে মাত্র ১৪ টি সিনেমা হল পায় প্রথম সপ্তাহে। একই জিনিস আজ তামিলের কপি হলে “হলসংখ্যা” গুনতে পরিচালককে হয়ত ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হত। এটাই নির্মম বাস্তবতা, সিনেমাতে অভিনয় করা মোশাররফ করিমের সংলাপ অনুযায়ী “বাস্তব অনেক শক্ত, বাস্তব নরম না!”


মন্তব্য করুন