জালালের গল্প নাকি বলব আশাভঙ্গের গল্প?
সিনেমার ট্রেলার দেখে মা কে নিয়ে জোর করে অবশেষে গেলাম শ্যামলী হলে। জন প্রতি টিকিট ১৫০ টাকার। সিনেমা হলে যাবার আগে ফেসবুকে আমি নিজেই স্ট্যাটাস দিয়েছি, আমরা না দেখলে এ মুভি কে দেখবে? আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মুভি এটি! কত পুরস্কার পেয়েছে! এই মুভি দেখে চলেন স্মার্ট দর্শক হই! তাই মুভি দেখার পর কষ্টটা খামচে ধরেছে। ৩০০ টাকা খরচ করে মায়ে- মেয়ে মুভি দেখলাম, সেই অনুসারে এই মুভির সমালোচনা করতেই পারি।
গত ৪-৫ বছর ধরে আমার ভালো ভালো মুভি দেখার সঙ্গী মা। ওসব আর্ট ফিল্ম, কমার্শিয়াল ফিল্মের বিচার বুঝি না। আমরা ভালো মুভি পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ি! এবং অন্য অনেক ভালো মুভি যেভাবে আমাদের দুঃখ দিয়েছে, তাদের মধ্যে আজকে যোগ হল এটা।
ধরে নিলাম, পরিচালক নবীন! তাই সে অনুযায়ী মুভিটার অনেক দোষ ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েই, এই রিভিউ লিখছি। এই রিভিউ আমি এবং মা মিলেই লিখছি। আমাকে রিভিউ লেখার আগে মা বলে দিয়েছিল যে, যা যা বলছি সব লিখবা । লিখছি তাই।
১। “জালালের গল্প” মুভির নাম আগে ছিল “জালালের পিতাগণ” সেইটাই বেশী উপযুক্ত ছিল। মায়ের মতে, মুভিতে জালালের কোন গল্পই দেখানো হয় নি। জালাল অনেকটা মুভির পার্শ্বচরিত্র ছিল, প্রথম গল্পের শেষ ভাগে বাচ্চা জালালকে নদীতে ভেসে দেওয়া আর লাস্ট সিনে জালালের পানিতে পড়ে মৃত্যু ছাড়া, কোন দৃশ্য জালালবিশিষ্ট ছিল না।
২। কিশোর জালালের এক্সপ্রেশন তাও ভালো ছিল, যথার্থ ছিল, কিন্তু যুবক জালালের অভিনয় রীতিমত বিরক্তির সৃষ্টি করেছে।
৩। ছবির একমাত্র শান্তির জায়গা ছিল মোশারফ করিম আর তৌকির আহমেদের অভিনয় । তাও অতিরিক্ত আবহ সঙ্গীতের জন্য তাদের অভিনয়য়ের স্পেস বেশী ছিল না ।
৪। গল্প দর্শক ধরে রাখার মত ছিল না। খুবই ধীর গতির গল্প। একঘেয়ে গল্প-বলা ভালো লাগে না। সেটা পড়তেও না, দেখতেও না। কোন উত্থান পতন, জোশ কিছুই ছিল না।
৫। কবিরাজের কাজকর্ম বিস্তারিতভাবে দেখানোর মানে ছিল না। গল্প ধীর করে দিয়েছে। একসময় মনে হচ্ছিল আমরা কবিরাজ কীভাবে প্রতারণা করে এই শীর্ষক ডকু দেখতে আসছি, মুভি না।
৬। ইন্টারমিশনের আগে টানটান কাহিনী রাখা উচিত ছিল। এমন সময় ইন্টারমিশন পড়ে, কোন তৃপ্তিই ছিল না বসে থাকার। আমি আর আম্মু ৩০০ টাকার শোকে আর মোশারফ করিমের অভিনয় দেখতে বসে ছিলাম।
৭। একদম গানের ব্যবহার নেই। ব্যাপারটা খারাপ লাগে নাই। কিন্তু কথা হল যখন গান না থাকে, তখন গল্পটা শক্তিশালী হতে হয় , সেটাও ছিল না। মানুষ তো ঝিমায় যাইতে বাধ্য!
৮। মৌসুমির সঙ্গে মোশারফ করিম অথবা যুবক জালাল, এর একজনের সঙ্গে পরিপূর্ণ রোমান্স দেখালে মন্দ হত না।
৯। ফ্ল্যাশব্ল্যাক বুঝা যায় নি। মৌসুমি জালালকে জড়ানোর সময় মোশারফের সঙ্গে যে ফ্ল্যাশব্ল্যাকে গেছে, এইটা বুঝতেই পারি নি। পরে বুঝেছি।
মোদ্দা কথা, ভালো একটা গল্প মার খেয়ে গেছে, গল্প সাজানোর অভাবে।
ভালো দিক তো খুঁজে বের করতেছি ৩০০ টাকার শোক ভুলতে,
সিনেমাটোগ্রাফি ভালো। চোখ শান্তি পাইছে। চিরকুটের আবহ সঙ্গীত ভাল। কমেডিগুলো ভালো, হেসেছি প্রচুর। শেষ দৃশটা ভালো। প্রথম চলচিত্রের নির্মাতা হিসেবে ১০০ তে পাশ মার্কস দেওয়া যায়।
বারবার আশাহত কিন্তু কেন ?
অমি ও আইসিক্রিমওয়ালা দেখে রোজার ঈদটা মাটি হইছিল। অনেক ভালো ভালো কথা শুনার পর মুভি দেখতে বসলাম, পুরা প্যাঁচ লেগে গেল। জালালের গল্প দেখে সেই দশা হইছে।
অনেকে কাহিনী শুদ্ধ রিভিউ দিয়েছিল, আমি পড়ি নাই। সাসপেন্স রাখার জন্য, গিয়ে দেখলাম, মুভিতে আসলে সাসপেন্স কিছু নাই। ধরে রাখার মত।
আলমগীর কবিরের মুভি দেখেছি, তারেক মাসুদের মুভি দেখেছি, গোলাম রাব্বানির মুভি দেখেছি, হাল আমলের মুস্তাফা সরোয়ার ফারুকির মুভি, রেদয়ান রনির মুভিও দেখেছি। হলে গিয়েই দেখেছি। কিছু নিয়ে আসতে পেরেছি।
কিন্তু আজ এই মুভি দেখে কিছুই তো নিয়ে আসতে পারলাম না বাসায় !
স্মার্ট দর্শক হতে চাই। অন্যধারার মুভি দেখতে চাই। কাহিনিভিত্তিক মুভি দেখতে চাই। কিন্তু তার মানে এই নাই, জোর করে হাসি হাসি মুখ করে বলতে হবে ভালো মুভি। আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেখে বলতে হবে “ইয়েস অন্যরকম মুভি, তাই ভালো মুভি”। কেন নিজগুণে এই মুভি স্বীকৃতি লাভ করতে পারল না “ভাল মুভি”? কেন আজ যেসব দর্শক ছিলাম হলে, একজনও আনন্দ নিয়ে আলোচনা করছিল না , মুভিটা নিয়ে একবারও। বিমর্ষ কিন্তু একাই ছিলাম না আমরা মা মেয়ে ।
মা ৩০০ টাকার শোক ভুলতে পারতেছে না। আমার আবার প্রজেক্টের জন্য ৩০০ টাকাই লাগবে, সেই শুনে মা আরও খেপা। আমি বললাম “একটুও ভালো লাগে নি কি আম্মু, ওই যে কমেডি দৃশ্যগুলো তো ভালো ছিল, হাসলা তুমি……”
মা বলল “শুন, তুমি একটা মুভি দেখলা, দেখার সময় ঘড়ি দেখতেছ কখন শেষ হবে ? তারপর হল থেকে বেরিয়ে ভুলেও গেলা ! তোমার মনে মুভিটার কোন গল্প, দৃশ্য কিছুই ছায়াপাত করতেও পারল না। ওই মুভি ভালো কি প্রকারে লাগবে বল ?”