Select Page

জিরো ডিগ্রী : শূন্যেই মুক্তি

জিরো ডিগ্রী : শূন্যেই মুক্তি

zero-degree-poster-mahfuz-joya-ruhiঅনিমেষ আইচ তার না মানুষ ছবিটা শেষ করতে পারেননি, খুব হতাশ হয়েছিলাম। এরপর জিরো ডিগ্রী তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা। নাটক টেলিফিল্মে নিজের আলাদা একটা ছাপ রাখা অনিমেষ আইচকে নিয়ে প্রত্যাশা অনেক। প্রত্যাশার এই বিশাল আশা নিয়ে জিরো ডিগ্রী দেখতে যাওয়া।

সিনেমাটি মাহফুজ, জয়া আর রুহির গল্পের। পুরুষ, নারী, বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতিশোধের গল্প জিরো ডিগ্রী। সিনেমাটিকে বলা হচ্ছে থ্রিলার তবে গল্পে যতটা না থ্রিল তার চেয়ে বরং সিনেমাটির নির্মাণ কৌশলে থ্রিলটা বেশী। চিত্রনাট্যকে মোটামুটি চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে এককভাবে মাহফুজ আর রুহির লিনিয়ারলি ন্যারেটেড গল্প, দ্বিতীয় ভাগে এককভাবে জয়ার ননলিনিয়ারলি ন্যারেটেড গল্প, তৃতীয় ভাগে মাহফুজ, জয়া ও রুহি তিনজনের প্যারালালি চলা গল্প যেখানে জয়ার ঘটনাবলির সাথে মাহফুজ ও রুহির কোন একসুত্রে গাঁথা ব্যপার নেই এবং চতুর্থ বা শেষ ভাগে মাহফুজ জয়া এবং রুহির এক সূত্রে গাঁথা একটি গল্প। সিনেমাটির সবচাইতে শক্তিশালী দিক চতুর্থ ভাগ বা শেষ অংশটি আর সবচাইতে দুর্বল ভাগটি হচ্ছে দ্বিতীয় অংশটি। দুর্বল বলছি কারণ চিত্রনাট্যের এই অংশে একই সাথে অনেক দীর্ঘ সময়কে তুলে ধরা হয়েছে, জয়ার শিশুকাল থেকে একদম জয়ার প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া অব্দই নানান ঘটনা অর ক্রাইসিস তুলে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক। এটা করতে গিয়ে ডিটেইলিং এর কিছুটা দায়সারা কাজ হয়েছে। সিকোয়েন্স একের পর এক চলে গিয়েছে কিন্তু প্রাণটা কেমন জানি অনুপস্থিত, অর্থাত্‍ জয়ার সাথে দর্শকের কানেক্ট করাটা হয় না, জয়ার ক্রাইসিসে দর্শকের সহানুভূতিটা ঠিক ভাবে পাকাপোক্ত হয় না। ছবিটির প্রথম ভাগে অর্থাৎ মাহফুজের গল্পের সময়ের ব্যাপ্তিটা জয়ার মত এতটা লম্বা নয়। মাহফুজের বৈবাহিক জীবনের নানান ঘটনা, ক্রাইসিস এসব কিছু তুলে ধরা হয়েছে, ফলে গল্পের, সংলাপের এবং সিনেম্যাটিক ট্রিটমেন্টের ডিটেইলিং যথাযথ হয়েছে। ফলে মাহফুজের অনুভূতিকে দর্শক অনুভব করে অথচ ছবিটির প্রথম অংশ এবং দ্বিতীয় অংশের শট duration প্রায় সমান। বিরতির আগ পর্যন্ত সিনেমাটি একটু শ্লথ গতির বিরতির পর থেকে ছবিটি অন্য মাত্রা পায়। পুরুষ ও পুরুষের শোষণ ,নারী ও নারীর বিশ্বাসঘাতকতা এর থেকে জন্ম নেওয়া ঘৃণা, প্রতিশোধ অতঃপর চরম পরিণতি মোটামুটি সিনেমাটির সারমর্ম ।

মাহফুজ আহমেদ

সিনেমায় নায়িকা নয় বরং এই বন্য চরিত্রের নায়কই আপনাকে বেশী আকর্ষণ করবে।

মাহফুজ আহমেদ অনবদ্য। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন লুকে তার চরিত্রের বিভিন্ন রকম চড়াই উতরাই তিনি বেশ দক্ষতার সাথে পার করেছেন। তার একেকটি এক্সপ্রেশন, ডায়লগ ডেলিভারি এক কথায় অনবদ্য। দর্শক হিসেবে সিনেমায় নায়িকা নয় বরং এই বন্য চরিত্রের নায়কই আপনাকে বেশী আকর্ষণ করবে। সু-অভিনেত্রী জয়া আহসান বরাবরই তার দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। তবে ঐ যে বললাম জয়ার প্রতি অনুভূতিটা কেমন জানি কৃত্রিমতা সর্বস্ব শুধুমাত্র চিত্রনাট্যের দুর্বলতার কারণেই, তবে জয়া আহসান তার শতভাগ দিয়েছেন। রুহি জিরো ডিগ্রীর একটি চমক। জয়া আহসানের মত শক্তিশালী অভিনেত্রী যেখানে থাকেন সেখানে অন্যান্যরা একটু প্রদীপের পাদদেশেই চলে যায় কিন্তু রুহি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অভিনয়ে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর হয়েছে রুহি আর জয়ার বরং রুহির চরিত্রটির ডাইভারসিটি অনেক বেশী এবং তিনি রীতিমত তাক লাগানো অভিনয় করেছেন। আমি বরং রুহিকে জয়ার চেয়ে এগিয়ে রাখব। ইরেশ জাকেরের চরিত্রটি এবং তার অভিনয় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারিক আনাম খানের মত এরকম একজন গুণী অভিনেতাকে এত ছোট দৈর্ঘ্যের চরিত্রে মেনে নেওয়াটা কষ্টকর। আরও অনেক চরিত্র ছিল তারা সবাই যথাযথ অভিনয় করেছেন।

ক্রাইম থ্রিলার আমাদের দেশে খুব একটা হয় না, জিরো ডিগ্রী সেক্ষেত্রে সাহসী এবং সফল পদক্ষেপ। থ্রিলারের ক্ষেত্রে আবহ সঙ্গীত, আলো এবং রং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।এই তিনটি বিষয়ের যথাযথ মিশ্রণ না হলে থ্রিলার আর থ্রিলার থাকে না। নির্মাতা অনিমেষ আইচ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল। চিত্রনাট্য মাঝে মধ্যে গড়পড়তার দিকে চলে গেলেও বা খেই হারিয়ে ফেললেও অনিমেষ আইচের এই তিনটা বিষয়ের সুপরিকল্পিত ও যথাযথ প্রয়োগ ছবিটিকে সামলিয়েছে। সিনেমাটির সম্পাদনা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মত, বুদ্ধিদীপ্ত ও অভিনব সম্পাদনা ছবিটিকে অন্যান্য বাংলা সিনেমা থেকে সহজেই আলাদা করে। সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে কিছু বলবার নেই, আমরা এই সেক্টরে এখন বেশ সিদ্ধহস্ত সন্দেহাতীত ভাবে,অসাধারণ ক্যামেরার কাজ ও ফ্রেমিং। একটা দৃশ্যের কথা উল্লেখ করি খাবারের টেবিলে সিনেমাটির প্রধান তিনটি চরিত্র খাবার নিয়ে বসে আছে। ক্যামেরা নীচ থেকে উপরের দিকে দ্রুত নিজ অক্ষে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে উঠে এসময় আবহ সঙ্গীত ও ক্যামেরার কাজ এবং চরিত্রগুলোর অট্টহাসি ও সংলাপের সমন্বয়ে যে সিনেম্যাটিক থ্রিলার কম্পোজিশন হয় তা এক কথায় অসাধারণ।

গানগুলো ভালো সিনেমার প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যথারীতি জেমসের গানটি দর্শকের মুখে মুখে তবে শেষ দৃশ্যের রবি ঠাকুরের গানের ব্যবহারটা অনবদ্য।

জিরো ডিগ্রীর নামের সার্থকতাটা কোথায় ? সেটা বুঝবেন ছবিটির শেষ দৃশ্যে এসে। শেষ দৃশ্যটা দিয়েই লেখাটা শেষ করি। ছবিটির প্রধান তিনটি চরিত্রের রিয়েলাইজেশন হয় তাদের এখন আর কিছু করবার নেই, ভাববার নেই, কোন কিছুরই অনুভবের নেই না ভালোবাসার না ঘৃণার না প্রতিশোধের, তাদের এখন শূন্যে অবস্থান তাই শূন্যেই তাদের মুক্তি। শেষ দৃশ্যে যখন ক্যামেরা ধীরে ধীরে টপ এঙ্গেলে যায় নীচে তিনটি চরিত্র ছোট হয়ে আসে, তাদের পারিপার্শ্বিকতা প্রকট হয়ে ওঠে, তারা হয়ে ওঠে শূন্যের কাছাকাছি, এ শূন্যেই তাদের মুক্তি এ শূন্যেই তাদের আনন্দ। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে কবি গুরুর আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে …


Leave a reply