Select Page

জয় জয় ‘দেবী’

জয় জয় ‘দেবী’

উপন্যাস ‘দেবী’ আমার পড়া হয়নি, তাই এখানে আলোচনা মূলত চলচ্চিত্র ‘দেবী’ নিয়েই। প্রতিটি শিল্প মাধ্যমের আলাদা প্রকাশভঙ্গী আছে, সাহিত্য হিসেবে একরকম আবার নাটক বা সিনেমা হিসেবে অন্যরকম হতে পারে। সাহিত্যে যেমন লেখকের কল্পনার বিচরণের আকাশসম সীমানা থাকে, সেখানে ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় নির্মাতার যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা থাকে। তাই ‘দেবী’ চলচ্চিত্রকে একটি চলচ্চিত্র হিসেবেই বিবেচনা করা শ্রেয়, উপন্যাস হিসেবে নয়- উপন্যাস উপন্যাসের জায়গায়।

অনম বিশ্বাস সম্প্রতি জাতীয় চলচ্চিত্র পেয়েছেন ‘আয়নাবাজি’র অনবদ্য চিত্রনাট্যের জন্য, তাই তার প্রথম পরিচালিত সিনেমা থেকে প্রত্যাশা ছিল অনেক, আবার জয়া আহসানের ‘সি তে সিনেমা’ প্রযোজনা সংস্থার প্রথম নির্মাণ ‘দেবী’ সেখানেও প্রত্যাশা ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। এখন এতো প্রত্যাশার কতটুকু পূরণ হলো আসুন দেখি।

‘দেবী’ চলচ্চিত্রটিকে দুইভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। এক, সিনেমাটির বাহ্যিক কাঠামো নিয়ে। দুই, সিনেমাটির অন্তনির্হিত তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে। ‘দেবী’র বাহ্যিক কাঠামো বলতে প্রথমেই চিত্রনাট্য। একটি সিনেমার মূল ভিত্তি তার চিত্রনাট্য, আর এখানে মূল কান্ডারী ছিলেন, দেবীর একাধারে চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতা অনম বিশ্বাস। ননলিনিয়ার প্যারালাল ফরমেটের চিত্রনাট্যটি সবরকম দর্শকের জন্য সহজবোধ্য, কোন দৃশ্যই খাপছাড়া মনে হয়নি।গল্পে থ্রিল ও হরর অনুভূতি তৈরি করতে দৃশ্যের যেরকম সিকোয়েন্স তৈরি করবার দরকার ছিল, সেরকমই করা হয়েছে। তবে ক্লাইমেক্সে আরেকটু কালক্ষেপন ও ডিটেইলিং করা গেলে আরো ভাল হতো। যেকোন হরর ছবির মূল শক্তি সাউন্ড ডিজাইন ও লাইটস। দেবীর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ও সাউন্ড ডিজাইন অনবদ্য, অসাধারণ তার আলো ছায়ার খেলা, যা সিনেমাটির পরতে পরতে রোমহর্ষক অনুভূতির সৃষ্টি করে। চিত্রগ্রহণ থেকে সম্পাদনা সব টেকনিকালিটিতেই ‘দেবী’ অত্যন্ত সাউন্ড একটি সিনেমা।

জয়া আহসান একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন ‘দেবী’তে। তার চালচলন, মুখাবয়বের অভিব্যক্তি প্রতিটি সংলাপ প্রক্ষেপণ এক অন্যরকম মোহময় আকষর্ক অনুভব জাগায়। আক্ষরিক দেবীই যেন হয়ে উঠেছেন জয়া। অভিনয়ে এক অন্যরকম আকষর্ক উপাদান  এনেছেন জয়া, তার পর্দার উপস্থিতির প্রতিটি মুহূর্ত থেকে চোখ সরানো যায় না।

মিসির আলী চঞ্চল চৌধুরী যথারীতি জাত চিনিয়েছেন, তবে তার চুলের রং আর হাঁটার ধরনের সাথে মুখাবয়বের মেকআপ যথেষ্ঠ কম বয়সী মনে হয়েছে। শবনম ফারিয়াকে নিয়ে আমি খুব একটা আশাবাদী ছিলাম না, মনে হচ্ছিল তিনি যথারীতি ওভারএক্সপ্রেসিভ পারফর্মেন্স করবেন, কিন্তু নীলুর মতো এরকম একটি অন্তর্মুখী চরিত্রকে তিনি অত্যন্ত সাবধানতার সাথে সাবলীল ও পরিমিত অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। অনিমেষ আইচ অনেক জায়গায় ঠিকঠাক থাকলেও ভয় বা বিস্ময় জাগানো দৃশ্যগুলোতে পানসে মনে হয়েছে তাকে।

এবার ‘দেবী’র অন্তনির্হিত বিষয়টি নিয়ে বলি, এটি নিতান্তই আমার উপলব্ধি। লেখক কিংবা পরিচালক এই বোধটা দিতে চেয়েছেন কিনা জানি না, এটা একেবারে দর্শক হিসেবে আমার উপলব্ধি। আমার কাছে মনে হয় সাহিত্য বা চলচ্চিত্র যেটাই হোক না কেন, প্রতিটি ভালো শিল্পকর্মেরই তার পাঠক বা দর্শকের প্রতি একটা ব্রেইন স্টর্মিং বিষয় থাকা উচিত। অর্থাৎ আপনি সাহিত্যটি পড়ে বা সিনেমাটি দেখে সরাসরি হজম না করে একটু রসিয়ে রসিয়ে হজম করবেন। পাঠক বা দর্শকেরও একটা চিন্তার জায়গা থাকবে, একটা ফাইন্ডিংস থাকবে এখন সে ফাইন্ডিংস এর সাথে লেখক বা পরিচালকের উদ্দেশ্য মিলে যাবে কি যাবে না সেটা পরের বিষয়।

‘দেবী’ চলচ্চিত্রটি হরর হলেও অন্যান্য ভৌতিক ছবির সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে এখানে অলৌকিক শক্তিটিকে অপশক্তি দেখানো হয়নি, বরং অলৌকিক শক্তিটি এখানে নারী শক্তি, প্রকৃতির শক্তি, শুভশক্তি। এখানে দেবীর বা শুভ শক্তির দ্বারা মানুষরূপী অমানুষদের পতন দেখানো হয়েছে। ১৭৫৭ সালের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অত্যাচারিত, নিপীড়িত, শৃংখলিত নারীকে মুক্ত করেছে নারী শক্তিই। ‘দেবী’ হয়ে উঠেছে নারী শক্তির বিজয়গাঁথা।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের হাওয়া বদলের দিনে, ‘দেবী’ নিঃসন্দেহে একটি ঝড়ো হাওয়া যা বেগবান করেছে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের গতিকে। জয়া আহসান অভিনেত্রী হিসেবে অনন্য তো ছিলেনই, এবার প্রযোজক হিসেবে তিনি যে দায়িত্ব পালন করেছেন- সেটা প্রযোজনা থেকে শুরু করে প্রচারণা সব ক্ষেত্রেই তা সকল প্রযোজকদের জন্য অনুকরণীয়।

অনম বিশ্বাস নির্মাতা হিসেবে প্রাণখোলা প্রশংসার দাবিদার এক নতুন ধারার সৃষ্টির জন্য। ‘দেবী’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বাণিজ্যে, চলচ্চিত্র শিল্পে এক নব্য ধারার স্রষ্টা যা বাংলাদেশের সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বহুদূর। জয় জয় ‘দেবী’।


মন্তব্য করুন