টেলিভিশন নাটকে গ্রামের গল্প
‘গ্রাম’ আমাদের মূল শিকড়। আমাদের টিভি নাটকেও যুগের পর যুগ গ্রামের সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা সব ফুটে উঠেছে। গ্রামের নাটকের আলাদা একটা দর্শকশ্রেনীই গড়ে উঠেছে। যদিও আজকাল গ্রামের নাটকের সংখ্যা কমে গেছে কিংবা যাও হয় তা দিয়ে মন ভরে না। ‘আমাদের টিভি নাটক’ সিরিজের এবারের কিস্তি গ্রাম-নির্ভর দশ নাটক নিয়ে—
এই সিরিজের আরও লেখা: আমাদের টিভি নাটক
১. কূল নাই কিনার নাই: আশির দশকে প্রচারিত বিটিভির বিখ্যাত নাটক। আফজাল-সুবর্ণা জুটির জনপ্রিয়তার পেছনে এই নাটকের প্রভাব অনেকখানি। ওবায়েদুল হকের ‘নদীবক্ষে’ গল্প অবলম্বনে মমতাজ উদ্দিন আহমেদের চিত্রনাট্যে এই নাটকে সুবর্ণা গ্রামের চঞ্চলা মেয়ে, তাকে ভালোবাসে চাচাতো ভাই আফজাল। কিন্তু ঘটনাক্রমে সুবর্ণার বিয়ে হয় আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে। কিন্তু নেমে আসে কঠিন পরিণতি, তাকে আবার ফিরে আসতে হয়। গ্রামের প্রেক্ষাপটে এই নাটক অতুলনীয়। মাসুদ আলী খান, রওশন আরা হোসেন, রওশন জামিল, আব্দুল কাদেরও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। প্রযোজনা করেছেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ।
২.জননী: স্বামী বাউণ্ডুলে, স্ত্রীকেই দেখতে হয় যাবতীয় কাজকর্ম। অসুস্থ শ্বশুর আর তিন সন্তান নিয়ে তার অভাবের সংসার। একদিন স্বামী তার জমানো টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, অসুস্থ মেয়ে আর সংসার নিয়ে অকূল পাথারে পড়ে স্ত্রী। সে স্বপ্ন দেখে ঘুরে দাঁড়াবার, বড় মেয়েকে হারিয়েও একদিন সে ঘুরেও দাঁড়ায়। এই যেন চিরাচরিত সংগ্রামী নারীর জীবন, এমনই এক গল্প সাজিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। জনসচেতনামূলক ‘জননী’ নাটকে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ডলিজহুর। ছিলেন আবুল খায়ের, আসাদুজ্জামান নূর, মোজাম্মেল হক ও শাওন। প্রযোজনায় ছিলেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ।
৩. এক জোনাকী: ফেরদৌস হাসানের রচনা ও পরিচালনায় নব্বই দশকের অন্যতম আলোচিত নাটক। গল্পে দেখা যায়, শুধুমাত্র কালো হওয়ার কারণে বিয়ে হয় না বিপাশা হায়াতের, যাও বা চড়া যৌতুকে ঠিক হয় বিয়ের আগে বাড়িতে হানা দেয় ডাকাত। সব লুট করে নিয়ে যায়, বিয়ে ভেঙে যায়। ডাকাত দলেরই একজন সদস্য তৌকীর আহমেদ, পথে বিপক্ষ দলের আক্রমণে সে আহত হয়। সঙ্গীরা তাকে ফেলে চলে যায়, মুমূর্ষু অবস্থায় বিপাশা তাকে সেবা করার জন্য নিয়ে আসে। আরো আবুল হায়াত, শর্মিলী আহমেদ, মোজাম্মেল হোসেনসহ অনেকে।
৪. দ্বিচক্রযান: গ্রাম্য গল্পে প্রাণ দিতে জুড়ি নেই সালাউদ্দিন লাভলুর, এই ধারার নাটকেই তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। মাসুম রেজার রচনায় এই নাটকের গল্প গড়ে উঠেছে এক গ্রাম্য যুবক ও তার সাইকেলকে কেন্দ্র করে। প্রধান ভূমিকায় জাহিদ হাসানের অন্যতম সেরা অভিনয় ছিল এই নাটকের উল্লেখযোগ্য দিক। আরো ছিলেন বন্যা মির্জা।
৫. নিখোঁজ সংবাদ: আনিসুল হকের রচনায় মুস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় এই নাটকে দেখা গিয়েছিলেন সম্পত্তির কারণে পারিবারিক রাজনীতি ও চেয়ারম্যানের কুপ্রভাবের চিত্র। মৃত বলে যাকে কবর দেয়া হয়েছিল আসলে সে তা নয়, এক সময় সে ফেরত আসে। সবাই ভাবে ভূত। আলোচিত এই নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, তিশা, শিরিন আলম, মাসুদ সেজান, আশুতোষ সুজন, রিফাত চৌধুরীসহ অনেকে।
৬. মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম: গ্রামে মন্ত্রী আসবে এই নিয়ে বিশাল আয়োজন। চেয়ারম্যান সাহেব থেকে ইউএনও সবাই ব্যস্ত,এমনকি মন্ত্রী নিজে দাঁড়িয়ে গরীব মেয়ের বিয়ে দেবেন। এত আয়োজন ভণ্ডুল করে দিচ্ছে এক পাগলাটে যুবক। তারকাবহুল এই নাটকে জাহিদ হাসানের অসাধারণ অভিনয়ের পাশাপাশি রিয়াজ, ফারুক আহমেদ, চ্যালেঞ্জার, এস আই টুটুল, মাজনুন মিজান, সালেহ আহমেদ, মাহফুজ আহমেদ সবাই খুব ভালো করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
৭. শীল বাড়ি: গ্রামে বসবাসরত এক শীল পরিবারের কাহিনী। সন্ধ্যা আরতির বদলে এই বাড়িতে নিত্য ঝগড়া হয়। বৃদ্ধ বাবা-মা থেকে তাদের তিন ছেলে, এক মেয়ে, দুই পুত্রবধূ কেউই কারো চেয়ে কম নয়। এমন সময় বাবা অনেক টাকা রাস্তায় কুড়িয়ে পায়, বদলে যায় প্রেক্ষাপট। বৃন্দাবন দাসের রচনায় সালাউদ্দিন লাভলুর পরিচালনায় উপভোগ্য এই নাটকে অভিনয়ে ছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান, শিরিন আলম, চঞ্চল চৌধুরী, শাহনাজ খুশি, শামীম জামান, বৃন্দাবন দাস, নাদিয়া আহমেদসহ অনেকে।
৮. হ্যালো বাংলাদেশ: গ্রামের এক স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বসবাসরত এক বাঙালী মেয়ের পরিচয় ঘটে ফেসবুকের মাধ্যমে। সেই মেয়ে কাউকে না জানিয়ে উপস্থিত হয় গ্রামে। স্কুল শিক্ষক থেকে সবাই হতবাক। স্কুল শিক্ষকের বিয়ে ঠিক গ্রামেরই এক মেয়ের সঙ্গে, তার বাড়িতে থাকার বন্দোবস্ত হয় ওই মেয়ের। তারপর ঘটতে থাকে নানান মজার কাহিনী, শেষে গিয়ে জানা যায় প্রবাসী তরুণীর আসার আসল গল্প! মারুফ রেহমানের রচনায় মাহফুজ আহমেদের পরিচালনায় টেলিফিল্ম ‘হ্যালো বাংলাদেশ’। পরিচালনার পাশাপাশি স্কুল শিক্ষকের চরিত্রেও তিনি অভিনয় করেন মাহফুজ, তার বাগদত্তার চরিত্রে ছিলেন রিচি সোলায়মান। অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত তরুণীর চরিত্রে অভিনয় করে আলোচিত হয়েছিলেন রূপন্তী, ছিলেন মীরাক্কেল-খ্যাত জামিল।
৯. জীবনসঙ্গী(২০১৭): বিয়ের রাতে গ্রামের সহজ-সরল ছেলে শুনে তার নববধূ আরেকজনকে ভালোবাসে, তাকে পেতে চায়। স্ত্রীর এই চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি মিলিয়ে দিতে চান সেই প্রেমিকের সঙ্গে, অতঃপর খুঁজতে বের হন। সুমন আনোয়ারের পরিচালনায় এমনই গল্প নিয়ে নির্মিত এই নাটকের অনবদ্য চিত্রনাট্যে আফরান নিশোর অভিনয় অন্যতম প্রাণ। এছাড়া শ্যামল মাওলা, মৌসুমী হামিদ, মনিরা মিঠু সবাই দারুণ অভিনয় করেছেন।
১০. দ্বন্দ্ব সমাস: আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজের নাটক। একই ব্যক্তির বিপরীত দুই সত্তা, সাম্প্রদায়িকতা, গ্রাম্য রাজনীতি সবই খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। নির্মাতা আশফাক নিপুণ সবচেয়ে জটিল চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন। মুখ্য চরিত্রে রওনক হাসানের অভিনয় এই নাটকের প্রাণ, একসঙ্গে দুই চরিত্রে সমানতালে অভিনয় করেছিলেন, সঙ্গে নির্মাতা আশফাক নিপুণের মুন্সিয়ানা চিত্রনাট্য। দুজনই মেরিল প্রথম আলোতে সমালোচক পুরস্কার পান।