ডিটেকটিভ ড্রামা ‘মুন্সিগিরি’
অমিতাভ রেজা চৌধুরী ও চঞ্চল চৌধুরী মানেই একটা বাড়তি আকর্ষণ। এই জুটি আয়নাবাজি (২০১৬) দিয়ে প্রথম ভেলকি লাগিয়েছিল। তারপর থেকেই তাদের পরবর্তী পরিবেশনা দেখার অপেক্ষা ছিল। ঠিক পাঁচ বছর পর একই দিনে (৩০ সেপ্টেম্বর) আরেকটি থ্রিলার নিয়ে হাজির হয়ে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছেন তারা। এ বছর যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি। তাতে অমিতাভ-চঞ্চলের ওয়েব ড্রামা ‘মুন্সিগিরি’ নিয়ে আগ্রহের পারদ ঊর্ধ্বমূখী থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
গল্পের সূচনায় দেখা যায় রেললাইনে পড়ে থাকা একটি লাশ। রহস্যের জট খুলে মূল অপরাধী পর্যন্ত পৌঁছানোর গল্প ‘মুন্সিগিরি’।
গল্পের লেখক শিবব্রত বর্মন পেশায় সাংবাদিক। তার সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় গল্পের রসদ জোগাড়ে সাহায্য করেছে। তার ‘মৃতেরাও কথা বলে’ উপন্যাস অবলম্বনে জমজমাট একটি চিত্রনাট্য লিখেছেন নাফিস আমিন। থ্রিলার হিসেবে ‘মুন্সিগিরি’র টোন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুরুগম্ভীর, কমিক মোমেন্ট একটু কম। তবে লেখক চরিত্রে গাজী রাকায়েতের সংলাপে হেঁয়ালি ও দার্শনিকতার যুগপৎ অবস্থান দেখা গেছে। তার একটি উল্লেখযোগ্য সংলাপ, ‘রাষ্ট্র নিপীড়নের নাম দিয়েছে আইন, আর ব্যক্তি সেই নিপীড়ন করলে ক্রাইম’। গল্পের প্রধান আকর্ষণ দেশীয় পটভূমিতে পরিচিত ঢাকায় একটি মার্ডার মিস্ট্রির উপস্থাপন।
ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ অব পুলিশের এডিসি মাসুদ মুন্সি অপরাধী ধরতে পুরনো পদ্ধতির উপরেই আস্থা রাখেন। তার মতে, প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসামী ধরলে নিজেকে ধইঞ্চ্যা মনে হয়। তাই তার বস তাকে বলেন, টেকনিকাল লিটারেসি বাড়াতে। মুন্সি চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী বরাবরের মতই মুন্সিগিরি দেখিয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে পূর্ণিমা, শবনম ফারিয়া, গাজী রাকায়েত, শহীদুজ্জামান সেলিম প্রত্যেকের অভিনয় ভালো লেগেছে।
ড্রামাটিতে ডিবির কাজের ধরনের একটা সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। খুনের এলাকা পরিদর্শন, লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ, তদন্তের স্বার্থে যোগাযোগের বিশাল নেটওয়ার্ক রাখা, সবার আগে অপরাধের মোটিভ খুঁজে বের করা, শত শত লোকের মধ্যে থেকে সন্দেহভাজনের শর্টলিস্ট করা, তদন্তকে ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজনে নিয়মের কিছুটা বাইরে যাওয়া সবই গল্পের মধ্য দিয়ে দেখা গেছে। দিনরাত তদন্তের পেছনে পড়ে থাকতে গিয়ে ডিবি সদস্যদের পরিবারকেও যে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সেটাও দেখা যায় মুন্সির জীবনের মাধ্যমে। আবার বুদ্ধিমতী স্ত্রীও সময়ে সময়ে নতুন আইডিয়া দিয়ে তদন্তে সাহায্য করে। এভাবে একটু একটু করে রহস্যের জট খুলে কাহিনী এগিয়ে যায়।
মুন্সিগিরিতে সেট-সজ্জার ক্ষেত্রে নির্মাতারা বাস্তবতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মধ্যবিত্তের ঘরবাড়ি, সরকারি কোয়ার্টার, বাংলাবাজারের প্রকাশনী, সরকারি অফিসে ফাইলপত্রের স্তুপ সবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এছাড়া তদন্তের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত বইটির একটি সুন্দর প্রচ্ছদ তৈরিও নির্মাতার মনোযোগ এড়ায়নি। এ ধরনের প্রপসের ব্যবহার গল্পটির বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়েছে। জাহিদ নীরবের আবহ সঙ্গীত কাহিনীতে প্রয়োজনীয় ড্রামাটিক ও থ্রিলিং মুহূর্ত অনুভব করিয়েছে। সেইসাথে তুহিন তামিজুলের চিত্রগ্রহণও যথাযথ ছিল।
কিছু কিছু বিষয়ে সামান্য অসন্তুষ্টি রয়ে গেছে। ক্লাইম্যাক্সে গল্পের জট এত দ্রুত খুলেছে যে, অনুসরণ করতে খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে। এ ছাড়া কাহিনীতে বই ও লেখকের নাম বদলাবদলি হয়ে যাওয়ার বিষয়টা কষ্টকল্পিত মনে হয়েছে। আর না চাইলেও কিছু কিছু জায়গায় আয়নাবাজির সাথে এর তুলনা চলে এসেছে। আয়নাবাজির গল্প ছিল চমক জাগানিয়া, অভূতপূর্ব; যদিও তাতে কিছু কিছু অপেশাদার অভিনেতার দুর্বলতাও চোখে পড়েছে। আর মুন্সিগিরি সাধারণ খুনের তদন্ত হিসেবে শুরু হয়ে স্থানে স্থানে চমক জাগিয়েছে, কিন্তু অভিনেতাদের সবলতা পুরোটা সময় কৌতুহল ধরে রেখেছে।
মহামারী পরিস্থিতিতে ‘মুন্সিগিরি’ নির্মাণের কাজটি সহজ ছিল না মোটেই। করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ায় তিনবার এর ফিল্মিং বন্ধ হয়ে যায়। তবে আশার কথা হচ্ছে, নির্মাতারা এর আরও দুটি সিকুয়েলের পরিকল্পনা করছেন। দেশীয় ধারায় এমন ভালো কাজ অব্যাহত থাকুক, এটাই একান্ত প্রত্যাশা।