ডিস্টারবেন্স: ডিসপ্লে এবং মিসপ্লে
‘রেহানা মরিয়ম নূর’ দেখা শুরুর ১১তম মিনিটে প্রশ্ন জাগে লাইটিং এরকম কেন, কেমন যেন ঘোলাটে আর ডিস্টার্বিং, করিডোরে এত বেশি পুনরাবৃত্তিক দৃশ্যের ইন্টারপ্রেটেশন কী।
২৩তম মিনিটে প্রশ্ন জাগে রেহানা এত ক্ষুব্ধ কেন, কারো সাথে কোমলস্বরে কথাই বলে না। পৃথিবীর সবকিছুর প্রতিই দেখি সে বীতশ্রদ্ধ।
এবং ৪১তম মিনিটে চূড়ান্ত প্রশ্নটি পাই- সব শট ইনডোরে কেন, একটাও আউটডোর দৃশ্য নেই।
পরিচালকের মোটিভ কী!
অমোঘ এ প্রশ্নটার গভীরে প্রবেশ প্রক্রিয়ায় ১ মিনিটে তৈরি হয়ে যায় নিজের ফিল্ম দেখা ফিলোসফির সিনোপসিস।
লিখে ফেলি সেটাও।
ইংরেজি, স্প্যানিশ, রুশ, ইরানি এবং ফ্রেঞ্চ ভাষার বহু সিনেমা তরুণ বয়সে দেখা হতো। অ্যাকশন, রোমান্টিক, সাইফাই এবং সুপারহিরো ঘরানার ফিল্ম বরাবরই এড়িয়ে চলি, আমার পছন্দের জনরা সোশ্যাল এবং সাইকোলজিকাল ড্রামা। দর্শকরুচির ক্রমবিবর্তনে এই জনরায় ফিল্ম নির্মাণের প্রবণতা কমে যাচ্ছে। বিউটিফুল মাইন্ড, শশাংক রিডাম্পশন বা টুয়েলভ এংরি মেন ঘরানার ফিল্মের চাইতে অ্যাকশন বা থ্রিলার ফিল্মে দর্শক আনন্দ পাচ্ছে বেশি।
ভিন্ন কালচারের ফিল্ম দেখতাম মূলত স্টোরিলাইনে ভিন্নতার কারণে।
কিন্তু একটা পর্যায়ে উপলব্ধি আসে ক্যারেক্টারের অভ্যন্তরীণ ক্রাইসিসগুলোর সাথে কানেক্ট করতে পারছি না। তার পারসোনালিটির যে প্যাটার্ন সেটার বর্তমান চিত্র তৈরি হওয়ার রুট কজ বুঝতে পারছি না। কারণ কালচারাল পার্থক্য বিস্তর। কলকাতা, দক্ষিণ ভারতীয় ফিল্ম দেখার ক্ষেত্রে সেই সমস্যাটা বোধ করি না। কালচারাল ভিন্নতা থাকলেও কোথায় যেন একটা সমসত্বতা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশি কনটেন্ট… হোক সেটা জসিম-মান্নার ফিল্ম অথবা ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম মেকারদের প্রজেক্ট… দেখার চেষ্টা করি দুটো পারসপেক্টিভ থেকে।
জসিম বা মান্নার ফিল্ম দেখি কমেডির প্রয়োজনে, মানুষের অদক্ষতা আর অযোগ্যতা কতটা অতিমানব পর্যায়ের হতে পারে সেই রসাস্বদনে জসিম-মান্না-রুবেল-ডিপজল বা শাবানার ফিল্মগুলো একেকটি প্রকৃষ্ট স্যাম্পল।
ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম মেকারদের কাজগুলো থেকে বোঝার চেষ্টা করি সমকালীন ট্রেন্ড কোনদিকে যাচ্ছে। স্টোরিলাইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাগে অ্যামেচার প্রকৃতির, ক্যারেক্টারাইজেশন লিনিয়ার; সিনেমাটোগ্রাফি দিয়ে অন্য দুই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা।
‘রেহানা মরিয়ম নূর’ আমার দেখা ইউনিক বাংলাদেশি কনটেন্ট। একটা আর্টওয়ার্ক কেবলমাত্র ভালো-মন্দ-মাঝারি বিশেষণবদ্ধ থাকলে সেটাকে যথার্থ মূল্যায়ন মনে হয় না।
প্রথম ৪১ মিনিটে তৈরি হওয়া ৩টি প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আমি একটা ৩ মিনিটের বিরতি নিই, প্রথম থেকে ফিল্মের ক্রনোলজিটা সাজানোর চেষ্টা করি, এবং টের পাই কোরিলেশন খুঁজে পাচ্ছি।
দর্শকের ভিউ থেকে বললে, কিছু ফিল্ম বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দেখতে ভালো লাগে, কিছু ফিল্মের জন্য লাগে রোমান্টিক সম্পর্কের মানুষ। কিন্তু কিছু ফিল্ম থাকে একাকী উপভোগের, তার মেজাজ বা দাবিটাই থাকে ওরকম। একাকী অবস্থায় একজন মানুষের মধ্যে যেসব আলোড়ন তৈরি হয় দলগতভাবে থাকলে তার ব্রেইন কাজ করে পুরোপুরি অন্যভাবে।
‘রেহানা মরিয়ম নূর’কে আমি বলবো একদম একা দেখার ফিল্ম। হল ভরতি দর্শকের মধ্যেও ফিল্মটা দেখা যাবে, তবে কোনো সঙ্গী সাথে রাখা চলবে না।
‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর মূল এসেন্স আমার বিবেচনায় ডিসটার্বেন্স। সর্বক্ষণ এটা আপনার চোখকে প্রশান্তিময়তা থেকে বঞ্চিত রাখবে, আপনার মনে তৈরি হবে একঘেয়েমি, এবং ক্ষণে ক্ষণে মনে হবে রেহানা এমন কেন, তার সাথে গল্প করতে বা মিশতে একদমই ইচ্ছা করবে না বাস্তব জীবনে।
কারণ রেহানার চরিত্রের নারী বা পুরুষ আমরা অহরহ দেখে থাকি কর্মক্ষেত্রে বা নিজেদের পরিমণ্ডলে। তাদের সাথে কারো সদ্ভাব হয় না, সর্বক্ষণ চেহারায় বা কথায় রুক্ষতা ধরে রাখে। they are just unwilling to connect to human, they prefer to stay alone, একাকীত্বকে মহিমান্বিত করতেই সম্ভবত bliss of solitude ফ্রেজিংয়ের উদ্ভব, এবং রেহানা ঘরানার মানুষেরা সেই ফিলোসফির অনুশীলন করে।
এই ফিলোসফি কতটা চয়েজ, কতটা স্বয়ংক্রিয় আর্গুমেন্ট চলতে পারে সেই পয়েন্টে, কিন্তু lone wolf প্যাটার্নের মানুষদের অস্তিত্ব সংক্রান্ত ফ্যাক্ট তাতে মিথ হয়ে যায় না।
রেহানারা নিজেদের এই টাইপটা উপভোগ করে, নাকি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চায়? সম্ভবত চায়, কিন্তু নিজে অনমনীয় থাকবো, অন্যরা আমাকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে— জগত সম্পর্কে অত্যন্ত লিনিয়ার এক বোঝাপড়া নিয়ে তাদের জীবন কাটে। কারো অত দায় পড়েনি আপনাকে নিয়ে মেতে থাকার, সে আপনি ক্লিওপেট্রা হন অথবা হালের পরীমনি!
ফিল্মের দৃশ্যায়নগুলো অনেক বেশি সিম্বলিক এবং মেটাফরিকাল। তাই আক্ষরিক না দেখে সিম্বল দিয়ে ব্যাখ্যা করলে কিছু কিছু পাজলের উত্তর মিলতে পারে।
যেমন রেহানার চুল ঢাকা, কিন্তু সেটা হিজাব দিয়ে নয়, অন্য ব্যবস্থায়। সমস্ত ফিল্মে তাকে খোলা চুলে দেখা গেছে মাত্র ২-৩ বার, তাও অতি স্বল্প সময় আর ইনসিগনিফিক্যান্ট সিকুয়েন্সে। চুলের বদলে ব্যাপারটাকে মাথা ঢেকে রাখা হিসেবে দেখলে এটাকে বাধা বা বদ্ধতার সিম্বলে কানেক্ট করা যায়। তার চিন্তা ঢাকা পড়েছে আবরণের আড়ালে।
প্রথম দৃশ্যেই আমরা দেখি রুমের ভেতর থেকে বের হতে তাকে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ ধাক্কাধাক্কির পর তবেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে পারে। ফিল্মের সবচাইতে টেনশনময় মুহূর্তে ক্লাসের সব শিক্ষার্থী বিল্ডিংয়ের মূল গেট এর তালা আটকিয়ে দেয়, একটাই দাবি তাকে রিজাইন দিতে হবে। সে বের হতে চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটা কারো দাবি মেনে নয়, নিজের জোরে। তখন মুখরিত স্লোগানে একটাই শব্দ ‘রিজাইন রিজাইন’।
সামষ্টিকতার সিম্বলে যদি শিক্ষার্থীদের দেখি, করিডোরকে সংকীর্ণতা, এবং মাথা ঢেকে রাখাকে দেয়াল— সেক্ষেত্রে রিজাইনকে রিজিডিটি ভেঙ্গে ফ্লেক্সিবল হওয়ার দাবি হিসেবে দেখা যেতে পারে। মেয়ের স্কুলের দৃশ্যে দুই অভিভাবকের সঙ্গে তর্কাতর্কির যে দৃশ্য সেখানে রেহানাকে দেখা গেলেও অন্য অভিভাবকদের কণ্ঠটাই শোনা যায় কেবল।
আমরা সর্বক্ষণ যে সমাজ আর সামাজিক আচারের কথা তুলি, সেই সমাজের মতবাদগুলোই শুনি, কিন্তু সমাজের শনাক্তযোগ্য চেহারা নেই আসলে। শুভাকাংখী এবং নিন্দুক উভয়েই সমাজ।
কিন্তু রেহানা চূড়ান্ত রিজিড। ফ্লেক্সিবিলিটি তার কাছে পরাজয়। মেয়ের স্কুল থেকে ডাকলে সে অনুপস্থিত থাকে, হাসপাতালে ডিসকাউন্টের জন্য প্রিন্সিপালকে ফোন করলেই হবে, কাউন্টার থেকে নম্বরও দিতে চাচ্ছে, কিন্তু সে ফোন করবে না, ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম সংলাপই হলো তোর মতো ভাই থাকার চাইতে না থাকা ভালো।
ফলে রেহানার স্কুল অব থটের সাথে এলাইনমেন্ট হয় না অন্যদের।
এই জায়গায় আমাদের ইথিক্স বনাম প্রিন্সিপলের মধ্যকার ডিলেমা নিয়ে ভাবতে হয় পুনরায়। ইথিকালি কারেক্ট মানেই স্ট্রং প্রিন্সিপল নয়, আবার প্রিন্সিপল স্ট্রং হলেই ইথিকালি কারেক্ট সবসময় সাব্যস্ত করা যায় না।
রেহানার স্টোরিলাইনের পরতে পরতে ইথিক্স আর প্রিন্সিপল সংক্রান্ত ডিলেমা।
প্রাইভেট মেডিকেলে পডাশোনা যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। একটা স্কেলে কতটুকুই বা লেখা সম্ভব যেটার কারণে একজন শিক্ষার্থীকে এক্সপেল্ড করা যায়, এবং যেখানে শতাভাগ নিশ্চিত নয় স্কেলটি সেই শিক্ষার্থীরই। এক্সপেল্ড মানে পুনরায় পরীক্ষায় বসতে হবে, বেড়ে গেল শিক্ষা ব্যয়।
এক্সপেল্ডের যুক্তি হিসেবে রেহানা বলছে কদিন পরে এদের হাতেই মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করবে, এরা যদি দুই নম্বরি করে কীভাবে চলবে। যুক্তি অকাট্য, কিন্তু স্কেলের দৈর্ঘ্যটাও বিবেচনায় রাখা উচিত।
ভাইভা পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা নার্ভাস হয়ে পড়ে, তাদের কিছুটা ক্লু দিলেই ডেলিভার করতে পারে। অথচ প্রশ্ন করলেন অত্যন্ত রুড ভঙ্গিতে, জানা জিনিসও ভুলে যাওয়ার কথা।
উভয় ক্ষেত্রেই রেহানার আচরণ কি ইথিকালি এপ্রোভড, যদিওবা প্রিন্সিপলের দিক থেকে অসম্মত হওয়ার পয়েন্ট নেই?
পক্ষান্তরে দুই জায়গাতেই ইমপ্যাথিপূর্ণ আচরণ করা আরেফিনকে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পাব আনএথিকাল হিসেবে।
এনি নামের শিক্ষার্থী আরেফিনের রুমে যায় তার বহিষ্কৃত বান্ধবীর জন্য ফেভার চাইতে। এটা আনএথিকাল। বিনিময়ে আরেফিন তাকে যৌন নিগ্রহ করে। এটাও আনইথিকাল। এই দুষ্কর্মের সাক্ষি রেহানা, ইন্টারেস্টিংলি এনির আরেফিনের রুমে যাওয়ার কারণও সেই রেহানাই।
এবং এনি নিজে ট্রমাটাইজড হলেও দীর্ঘ ক্যারিয়ার, সম্মান প্রভৃতি ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিয়ে বিষয়টাকে চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে রেহানা বিপ্লবী হয়ে উঠে। কারণ এনির সঙ্গে যা হয়েছে সেটা প্রশ্রয় দিলে আরেফিন ভবিষ্যতে আরো অনেক মেয়েকে এরকম নরক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলবে। সুতরাং এনি চুপ থাকলেও সব জেনে চুপ থাকাটা রেহানার প্রিন্সিপল অনুসারে আনএথিকাল। ইথিক্স প্রতিষ্ঠা করতে সে যে কাজটা করলো তা কোন ইথিক্স দিয়ে জাস্টিফায়েবল? আরেফিনের বিরুদ্ধে সে যৌন নিগ্রহের লিখিত অভিযোগ দিল প্রিন্সিপল বরাবর, তার যুক্তি হলো আরেফিন তাকে নিগ্রহ না করলেও কোনো একটা মেয়েকে তো করেছে!
একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ এলে সঙ্গত কারণেই প্রতিষ্ঠানের ব্রান্ড ইমেজ খারাপ হবে, ভর্তিসংখ্যা হ্রাস পাবে, টান পড়বে রেভিনিউতে, প্রিন্সিপলও বরখাস্ত হতে পারেন। সমাধান হিসেবে রেহানার বেতন ইনক্রিমেন্ট দেয়ার যে কৌশল এটা কি ইথিকাল?
আরেফিন যে বহিষ্কৃত ছাত্রীকে বলে রেহানার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করতে এটা কি ইথিকাল? এবং যে এনির জন্য রেহানা আনএথিকাল পথ বেছে নিল সে যখন তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিল সেই কাজটাকে কি আনইথিকাল বলা যাবে? কারণ শুরুতেই আমরা দেখি রেহানা তার বান্ধবীকে অহেতুক হেনস্তা করছে এটাই সে বিশ্বাস করে। কিন্তু ঘটনাটা রেহানাকে বেকায়দায় ফেলতে ঘটানো হচ্ছে যার নেপথ্য চরিত্র সে নিজে, এটা জানা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে যাওয়াটা কি ইথিকাল?
ফলে ইথিক্স আর আনইথিকালের যে জট সেখানে কেউ ক্লিনশিট পাচ্ছে না। রেহানা রিজাইন করেনি, তবে কি সে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিবে? নাকি এক মাস পরেই আরেফিন অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার যে গল্প শোনা গেল সেটাকেই সমাধান ধরে সময়ক্ষেপণই সমাধান মেনে নিল? এটা কি ইথিকাল রেহানা?
ইথিক্স প্রশ্নে আরেফিনের কাছ থেকে পাই তাৎপর্যপূর্ণ স্টেটমেন্ট, ‘সবাই ভুল করে। তুমি কোনো ভুল করোনি কখনো? পার্থক্য হলো আমারটা তুমি জেনে গেছো, তোমারটা আমি এখনো জানি না।’
এই পর্যায়ে রেহানার চরিত্র সংক্রমিত হতে থাকে আমাদের মধ্যে৷ co-existence এর প্রতি যে ভয়ংকর বিমাতৃক আচরণ তা কেবল রেহানা নয় আমাদের সকলের মধ্যেই বিদ্যমান। আমরা ভিন্নতার সৌন্দর্য বুঝি না, কেবল খুঁজতে থাকি তোতা আর ময়নাপাখিময় সভাসদ। যে কারণে প্যারেন্টিংয়েও থাকে না ইমপ্যাথি বা কো-এক্সিসটেন্সের প্রতি সহনশীলতা। বাচ্চাদের মাথায়ও আমরা ঢুকিয়ে দিই জটিল মারপ্যাচ। আমরা যারা মফস্বলে বা গ্রামে বড় হয়েছি সমবয়সী ১৫-২০ জনের সঙ্গে খেলাধুলা করেই ব্যক্তিত্বের এক্সচেঞ্জ হয়েছে। সেইসব খেলাধুলা সবসময় স্পোর্টিং থাকেনি, মারামারি পর্যন্ত গড়িয়েছে, বিচারও বসেছে, কিন্তু একদিন পরেই ভুলে গিয়ে গলায় গলায় ভাব হয়ে গেছে। কিন্তু রেহানার প্যারেন্টিং থিওরিতে দুটো সমবয়সী বাচ্চার একজন অন্যজনকে চিমটি দিলে সেটা এবিউজ, এবং চিমটির বিপরীতে কামড় দিলে সেটা ডিফেন্স।
এটার জন্য গার্ডিয়ান ডাকা এবং দুই পক্ষ একে অপরের সন্তানের প্রতি পজেসিভ হয়ে অন্য বাচ্চার বিষোদগার করার যে মেকানিজম তৈরি হলো, এটাই আধুনিক স্কুলিং সিস্টেমের শোচনীয়তম ব্যর্থতা। এই ঘটনা গার্ডিয়ান পর্যন্ত আসারই কথা নয়, শিক্ষকরাই দুজনের মধ্যে ভাব গড়ে দেবে। কিন্তু পাবলিকলি একজন অন্যজনকে স্যরি বলবে, যেহেতু চিমটির তুলনায় কামড় অধিক ভায়োলেন্ট কাজ, সেহেতু কামড় দেয়াজনই স্যরি বলতে বাধ্য— এই ডায়নামিক্স কি ৪-৫ বয়সী বাচ্চাদের বোঝাটা জরুরি আদৌ? এরা কো-এক্সিসটেন্স থিমটাই তো ধারণ করতে শিখবে না কখনো।
পক্ষান্তরে রেহানার শিশু বাচ্চাটি এতদিন ধরে প্রস্তুতি নিল পারফর্ম করার জন্য, স্যরি বললেই পারফর্ম করতে পারবে জানলে সে কি মানা করত? বরং খুশিমনেই স্যরি বলে দিত; পারফরম্যান্সের আনন্দের বিপরীতে ওইটুকু স্যরি কি আদৌ কোনো স্খলন?
কো-এক্সিটেন্সের প্রতি অতি বিরূপতার দরুণ সেল্ফ-আইডেন্টিটির প্রতি যে অন্ধ অবসেশন সেখান থেকেই কি আমরা হয়ে উঠছি উগ্র মৌলবাদী?
রেহানা বাচ্চাটার প্রতি চূড়ান্ত ইমপ্যাথিশূন্য আচরণ করেই নিরস্ত হয় না, দরজা থেকে হাত সরানোর জন্য ৩ পর্যন্ত গোনার আল্টিমেটাম দেয়। শিশুটিও মায়ের ইগো সম্বন্ধে অবগত। সাধারণত বাচ্চাদের জেদের কাছে মা-বাবা হার স্বীকার করে নেয়। কিন্তু রেহানা ঠিকই ৩ গোনা শেষে প্রচণ্ড জোরে দরজার পাল্লা টান দেয়, সময়মত হাত না সরালে বাচ্চাটির হাত যেত থেতলে। কিন্তু রেহানা ডোন্ট কেয়ার এটিচুডই বহাল রাখে। এই বাচ্চাটি পরিণত বয়সে মা’কে ফিল না করলে সেই দায় কার?
শুরুর মতো শেষ দৃশ্যেও দরজার ব্যবহার। আগেরবার সে ছিল বদ্ধ দরজার ভেতরে, এবার সে বাইরে ভেতরে কন্যা, দরজা আগের মতোই বন্ধ। একে মেটাফরিকালি ইন্টারপ্রেট করা যায় এভাবে, ইমোশন আর ইমপ্যাথিকে জোর করে আটকে রেখে হলেও কিছু মানুষ আমিত্বের অহংকারে দাঁড়িয়ে থাকে একা, ভাবে এটাই তার আইডেন্টিটি। যে কারণে সারা সিনেমায় অসংখ্যবার রুম দেখানো হলেও শেষ দৃশ্যে দরজায় দাঁডানো রেহানার পাশে ফোকাস করা হয় নেমপ্লেট, আমরা জানি সে মেডিসিন বিভাগের এসিসট্যান্ট প্রফেসর!
মা-বোন-সন্তান-বন্ধু-কলিগ-শিক্ষক সবকিছুর চাইতে শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক পরিচয়টাকেই কি রেহানার মতো মানুষেরা আইডেন্টিটি ভেবে নেয়? এটা ভাবনা নাকি ভ্রম?
এ কারণেই রেহানাকে আমরা সরু করিডোরে হেঁটে যেতে দেখি বেশিরভাগ সময়, বদ্ধ বিল্ডিংয়ের বাইরে যে বিশাল জগত তার সঙ্গে দেখা হয় কদাচিৎ, হলেও তা রেখাপাত করে না মনে। ঘোলাটে লাইটকে যদি আলোকিত অবস্থার সিম্বল ভাবি, ওটাই রেহানার অভ্যন্তরীণ মানসিকতার প্রকৃত স্বরূপকে প্রতিনিধিত্ব করে।
ভিজুয়াল কনটেন্টের সকল ফর্মের মধ্যে আমার পছন্দক্রমের সর্বতলানীতে থাকবে নাটক। জীবনে খুব বেশি নাটক দেখিওনি, তাই আজমেরি হক বাঁধন সম্পর্কে জানাশোনা ছিল সীমিত। হুমায়ূন আহমেদের ২-১টা নাটকে দেখেছিলাম। বাচনভঙ্গি পছন্দ হয়নি, তবে নাকের গঠন গড় বাঙালি নারীদের চাইতে কিছুটা ব্যতিক্রমী মনে হয়েছিল। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ দেখার পূর্বে এটুকুই ছিল বাঁধনের প্রতি আমার ইমপ্রেশন। ফিল্মে তার যে গেশ্চার বা লুকিং তাতে ডিসটার্বেন্স ভাইবটা সবসময়ই ছিল স্ক্রিনে। তার পরবর্তী কয়েকটি প্রজেক্ট দেখার ইচ্ছা জমালাম। তখন তার শিল্পীসত্তা নিয়ে পর্যবেক্ষণ লেখা যাবে।
পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ আমার পৃথিবীতে সম্পূর্ণ অপরিচিত। এই ফিল্মসূত্রেই প্রথম নাম জানলাম। তার চিন্তাপ্রক্রিয়া আমাকে আকৃষ্ট করেছে। তার অন্যান্য প্রজেক্টগুলোও জানা-বোঝার চেষ্টা করব। এরকম প্রতিকূল আর অনুর্বর সময়ে অজনপ্রিয় এক জনরায় ক্রিটিকাল এক ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক করা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
তবে এই ফিল্ম দেখে যদি ৭৯% বাঙালি দর্শক নেগেটিভ ফিডব্যাক না দেয়, যারপরনাই বিস্মিত হব। ধরে নিব এ দেশের অডিয়েন্স রুচিতে মোচড় লেগেছে, সামনে ‘কোয়ালিটি’ ধারণায় ব্যাপক রদবদল ঘটলেও ঘটতে পারে।
রেহানা হওয়াটা অপরাধ নয়, তবে রেহানা বর্তমান পৃথিবীর ইনডিভিজুয়ালদের রোল মডেল হয়ে গেলে সেটাকে মানবিকতার বিপর্যয় হিসেবেই দেখব।