ডুব : আহা পারতাম, যদি পারতাম, ফারুকী সাবকে কিছু কথা বলতাম!
সিনেমার শুরুতেই পর্দায় ডিসক্লেইমার ভেসে উঠলো- ‘এই সিনেমার সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়’। পুরো সিনেমা দেখা শেষে সিট থেকে উঠে দাঁড়ানোর পর এই ডিসক্লেইমারের কথা মনে পরে প্রচন্ড হাসি পেল। হায়রে ফারুকী সাব, সামান্য কয়টা টাকার ব্যবসার জন্য আমাদের সবার প্রিয় গল্পের জাদুকরকে নিয়ে নোংরামিটা করার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল আপনার?
উপরের লাইনগুলো পড়ে অনেকেই ভাবা শুরু করেছেন যে, আরেকটা নেগেটিভ রিভিউ পড়তে যাচ্ছেন। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, ডুব আমার কাছে ভালো লেগেছে! কিছু কিছু জায়গায় অনেক বেশিই ভালো লেগেছে। মেড ইন বাংলাদেশ, টেলিভিশনের পর পরিচালক ফারুকীর কাজে আমি আবার মুগ্ধ হয়েছি। তারপরেও, সিনেমা শেষে অনেকগুলো আক্ষেপ সঙ্গী, আর সঙ্গী ব্যাক্তি ফারুকীর ক্রমাগত মিথ্যাচারের জন্য উনার প্রতি সীমাহীন রাগ।
আয়নাবাজি, ভুবন মাঝি, ঢাকা অ্যাটাকের পর এই সিনেমাতেও চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফি মুগ্ধ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে শুরু করে ঘরের ভেতরের দৃশ্যসহ প্রতিটি দৃশ্যের ফ্রেমিং বারবার মুগ্ধ হতে বাধ্য করেছে। এমন চমৎকার কাজের জন্য সিনেমাটোগ্রাফার শেখ রাজিবুল ইসলাম একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। আবহসঙ্গীত দুর্দান্ত। বরাবরের মতোই চিরকুটের গান গানের জন্য শান্তিদায়ক। ‘আহারে জীবন আহা জীবন’ গানটা একটু বেশিই ভালো হয়েছে।
অভিনয় নিয়ে কথা বলার মতো ধৃষ্টতা দেখানো উচিত হবে না। প্রত্যেকটা চরিত্রেই অসাধারণ নামকরা সব অভিনেতা, অভিনেত্রী ছিলেন এবং তারা প্রত্যেকেই নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। ইরফান খানের ভাঙা ভাঙা বাংলা কানে লাগার কোনো সু্যোগ উনি দেননি চোখের এক্সপ্রেশানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্ক্রিনে আটকে রেখে। অসম্ভব গ্ল্যামারাস পার্নো মিত্র আমাদের দেশের লোকাল ভাষায় বেশ মানিয়ে অভিনয় করেছেন, উনাকে পর্দায় আরো বেশি সময় দেখা গেলে ভালো লাগতো। রোকেয়া প্রাচী নিজের চরিত্র অনুযায়ী সাবলীল অভিনয় করেছেন। তবে, উপরের সবাইকে ছাপিয়ে সমস্ত মনোযোগ কেড়েছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। তাহসানের নাটকের ন্যাকা তিশা দেখে যারা বিরক্ত তারা এই সিনেমায় তিশার অভিনয়ে চমকে যাবেন। জাত অভিনেত্রী বোধহয় একেই বলে!
কী ভাবছেন- সবকিছু এতো পজিটিভ হওয়ার পরেও আক্ষেপ কেন? কারণ একটাই- সিনেমার গল্প। নির্মাতা এখনো ভাঙা ক্যাসেট বাজানোর মতো সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছেন , এটা মৌলিক গল্পের সিনেমা। কিন্তু, এই সিনেমার মূল ঘটনা থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি দৃশ্যই চিৎকার করে বলছে এটা প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়ের গল্প। উনার জীবনের গল্পটাকে মূল রেখে নির্মাতা স্রেফ নিজের মতো করে কাট-ছাট করেছেন। বায়োপিক বানাননি এ কথা সত্য কিন্তু বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার জিতে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা একজন সুপরিচিত নির্মাতা কেন ‘এটা মৌলিক গল্পের সিনেমা’- এমন মিথ্যাচারের আশ্রয় নেবেন? মূল আক্ষেপটা সেখানেই।
সিনেমাবোদ্ধা অনেকেই নেগেটিভ রিভিউর প্রতিউত্তরে বলেছেন, এই সিনেমার অন্তর্নিহিত অভিপ্রায় বুঝতে হলে তারেক মাসুদ, আলমগীর কবির, জহির রায়হান, ঋত্বিক কুমার ঘটক, সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণা ঘোষ, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, জঁ লুক গদার, মোহসেন মাখমালবাফ, রোবের ব্রেসোঁ, ফেদেরিকো ফেলিনি, ফ্রাংক কাপরা, রোমান পোলানস্কিদের কাজের সাথে পরিচয় থাকতে হবে। হ্যাঁ, উপরে উল্লেখিত সবার কাজের সাথে আমার কম-বেশি পরিচয় আছে এবং তারপরেও ‘ডুব’ সিনেমায় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার সিনেমার অন্তর্নিহিত অভিপ্রায় ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করি আমি। পার্সিয়ান সিনেমার আদলে উনার গল্প বলার ধরণ, অসাধারণ ফ্রেমিং সেন্স, দৃশ্যে মেটাফোরের চমৎকার ব্যবহার, সহজবোধ্য সুন্দর সাবলীল সংলাপ – এতসবের পরেও উনার গল্প বলাটা সম্পূর্ণ হচ্ছে না, খাপছাড়া খাপছাড়া লাগছে। উনি একের পর এক অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করছেন কিন্তু সবগুলোকে জোড়া দিয়ে একটা মাস্টারপিস তৈরি করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। এখানেই অন্য সব বিখ্যাত পরিচালকের সাথে উনার পার্থক্যটা। এই সিনেমার ক্ষেত্রে উনার গল্পটাই ছিলো অসম্পূর্ণ। স্পয়লার হয়ে যাবে বলে সে বিষয়ে এখানে কিছু উল্লেখ করছি না। কিন্তু, এমন পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প বলাটাকে আর যাই হোক, উচ্চমানের শিল্পের তকমা দিতে পারবো না।
সিনেমাবোদ্ধা নই, সাধারণ দর্শক। তাই, কোনো রেটিং দেওয়ার ঝামেলায় যাচ্ছি না। একটা কথাই বলবো- ভুল-ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ভিন্ন ধরণের কাজের চেষ্টার জন্য পরিচালক ফারুকীর জন্য ভালোবাসা আর মিথ্যাচারের জন্য ব্যাক্তি ফারুকীর প্রতি একরাশ ঘৃনা।