ডুব : সিনেমা অর নট সিনেমা- ইজ দ্যাট দ্য কোয়েশ্চেন?
বইলা নিই শুরুতেই। এইটা ‘ডুব’ নিয়া লেখা আনপেইড রিভিউ। আর আমি টিম ‘ডুব’ এর কেউ না।
সিনেমার কয়েকজন কবির কথা দিয়া শুরু করতে চাই।
আন্দ্রেই তারকোভস্কিরে একবার জিজ্ঞেস করা হইসিল ‘আর্ট কি?’
তাঁর উত্তর ছিল, ‘আর্ট এর সংজ্ঞা দেয়ার আগে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। পৃথিবীতে মানুষের জীবনের অর্থ কী? হইতে পারে এইখানে আমরা স্পিরিচুয়ালিটি বাড়ানোর জন্য আসছি। জীবনের অর্থ যদি এইরকম হয়, তাইলে হইতে পারে আর্ট সেইখানে পৌঁছানোর মাধ্যম।’
ফেলেনি বলসিলেন একবার, ‘আর্টিস্ট থাকেন ফ্যান্টাসি আর বাদবাকি (বাস্তব) দুনিয়ার মাঝামাঝি।’
তাইলে সিনেমা কি? সিনেমার জায়গা কই?
ফেলেনিরে দিয়াই উত্তর দেই। উনি বলসিলেন, ‘গল্পকার হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হইল মানুষরে একটা স্টেশানে নিয়া আসা। সেইখানে সে নিজের ট্রেন নিজে খুইজা নিবে।’
জ্যা লুক গদার বলসিলেন, ‘সিনেমা হইতেসে সবচেয়ে সুন্দর ধোঁকাবাজ।’
ভিজুয়াল আর্ট যেইখানে স্পেস নিয়া কাজ করে, মিউজিক সেইখানে সময় দিয়া মানুষের ভিতরে ঢুকে আর অনুভুতিরে নাড়া দেয়। সিনেমা আবার স্পেস আর টাইম দুইটা নিয়াই ডিল করে। এই দিক থাইকা চিন্তা করলে আর্টের দুইটা বেসিক ফর্ম এক হইতেসে সিনেমায় আইসা।
তো সিনেমা কখন সিনেমা হয়া উঠে?
এই একই প্রশ্ন আমি অন্য ভিজুয়াল আর্টরে (পেইন্টিং, ফটোগ্রাফি, স্কাল্পচার, গ্রাফিক্স, আর্কিটেকচার) করতে চাই, মিউজিকরে করতে চাই। আর্ট কখন আর্ট হয়া উঠে? মিউজিক কখন মিউজিক?
গদার এই নিয়া বলসিলেন, ‘আর্ট বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি না , এটা প্রতিচ্ছবির বাস্তবতা।’
আর্টিস্ট ভ্যান গগ বলসিলেন, ‘ছোট ছোট জিনিসরে একসাথে একজায়গায় আনলেই বিশাল কিছু তৈরি হয়।’
আরেকবার তিনি বলসেন, ‘বড় শিল্পী সে, যে সাধারণ জিনিস নিয়া কাজ করতে পারে।’
গায়ক বব ডিলান বলসিলেন, ‘সব সুন্দর কাজের পিছনে কোন না কোন বেদনা থাকে।’
তার মানে বেদনার্ত হয়া ছোট ছোট সাধারণ জিনিস নিয়া কাজে নামলেই ভাল আর্ট হয়? হইতে পারে। নাও হইতে পারে। আর্টের ব্যাপারটাই এমন। আপনি গণিত বা বিজ্ঞান শাস্ত্র যেমন সমীকরণ দিয়া মিলায়া চেক করতে পারেন, হইসে নাকি হয় নাই প্রমাণ করতে পারেন- আর্টে সেটা হয় না।
তাইলে সিনেমা কী? আর্ট? বিনোদন না বাণিজ্য? অনেকের মতে এই তিনের সংমিশ্রণ। এটা শুধু তুলি দিইয়া আইকা ফেলা যায় না বা গিটারে সুর তুইলা গলা ছাইড়া গাইলেই হয় না, অনেক মানুষের দলবদ্ধ একটা প্রয়াস সিনেমা। এইখানে ইনভেস্টমেন্ট লাগে, বাজার বুঝা লাগে। দর্শকের কাছে প্রোডাক্টটা পৌছায়া দেয়া লাগে। আর অনেক রকম আর্টিস্টরে এক সাথে নিয়া একটা আর্ট ফর্ম তৈয়ার করা লাগে। আর্টিস্ট যেমন হইতে হয়- ম্যানেজার ও হইতে হয়।
খালি বিনোদন আর বাণিজ্য ঠিক রাখতে গিয়া হলিউড আর তার সাগরেদরা আইডিয়া দেয়া ভুইলা গেসে, আর আইডিয়া দিতে গিয়া ফরাসিরা দেউলিয়া হয়া যাইতেসে।
আবার যারা সংমিশ্রণ করতে যাইতেসেন তারা তোপের মুখে পড়তেসেন দুই শিবিরের। আর্ট হাউস এইটারে নিতেসে না আবার বক্স অফিসও হিটের তকমা লাগাইতেসে না।
গদার কইসিলেন, ‘সিনেমা কিছু বিমূর্ত ধারণা না, এটা কিছু মুহূর্তের প্রকাশ।’
‘ডুব’ নিয়া লেখার কথা ভাবতেসিলাম। কথা শুরু করব কী দিয়া ভাবতে ভাবতে সিনেমার কবিদের কথা মনে পইড়া গেল। এত প্যাচাল পারলাম এই জন্য। তাঁরা কেমনে সিনেমারে দেখেন সেইটা বুঝার চেষ্টা করতে গিয়া ডুব দিলাম আরেক সাগরে।
‘ডুব’ নিয়া নানান রকম কথা হইতেসে। এইটা ভালোভাবে দেখতে চাই আমি। কারণ সিনেমারে আমি টিকেট কাইটা দেখলাম আর ঢেঁকুর তুইলা চেক ইন দিলাম, এর মধ্যে সীমিত রাখতে নারাজ। সিনেমার রেশ থাইকা যাওয়া উচিত। এটা আমার কথা না। আব্বাস কিয়ারোস্তামি বলসেন। যার সম্পর্কে গদার বলসিলেন, ‘সিনেমার শুরু গ্রিফিথরে দিয়া ,শেষ কিয়ারোস্তামিরে দিয়া।’
তো সিনেমা হলের দর্শকদের নিয়াই একটা কথা বলেছিলেন সিনেমার কবি কিয়ারোস্তামি। তিনি বলসিলেন, ‘হলের সিট দর্শকরে অলস বানায়া দেয়। তাঁরা সব উত্তর চাইতে থাকেন সিনেমার মধ্যে। কিন্তু আমার কাছে প্রশ্নবোধক কিছু জিনিসওয়ালা সিনেমা বেশি ভালো লাগে।’
তিনি সিনেমার নির্মাণ নিয়া আরেকটা কথা বলসিলেন।
কথাটা অনেকটা এমন— ‘আমি যদ্দিন সিনেমা বানানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকি, আমি ভাবি না শেষমেশ কী দাড়াইতেসে জিনিসটা। মানুষের সিনেমাটা দেখা উচিত না উচিত না, কিম্বা কতবার দেখা উচিত- দর্শকের প্রতিক্রিয়া কী হইতে যাইতেসে। আমি খালি বানাই। জিনিসটা কী দাঁড়ায় দেখতে থাকি। এর মধ্যে অনেক কিছু আমার পছন্দমতন নাও ঘটতে পারে। দেখা গেল অনেক দর্শক হল থাইকা অতৃপ্তি নিয়া বাইর হইল। কিন্তু তারা সিনেমাটা ভুলতে পারতেসে না।’
ডুব কেন আলোচনার কেন্দ্রে?
হইতে পারে –
ক। (অনেকের ধারণা মতে) হুমায়ূন আহমেদের জীবনের ছায়া অবলম্বনে বানানো।
খ। ইরফান খানের মতো আন্তর্জাতিক মানের অভিনেতা আছেন এইখানে।
গ। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সিনেমা।
আমার ব্যক্তিগত মতামত— এই তিন ধারণা মাথা থাইকা ফালায়া দিতে না পারলে ‘ডুব’ দেইখা শান্তি পাইবেন না। ‘ডুব’ দেন শুধু ‘ডুব’ দেয়ার জন্য।
এই সিনেমার গাঁথুনি আর সিনেমাটোগ্রাফি নিয়া কিছু না লিখলে এর উপর অবিচার হইতে পারে। গল্প বলার আঙ্গিক আর গল্পের নানা মোড়ে দর্শকরে দাঁড় করায়া নির্মাতা যেইভাবে টাইম-স্পেস নিয়া খেলা করসেন, তা সিনেমায় নতুন না হইলেও, দেশের মূলধারার সিনেমায় একেবারেই নতুন। কিছু জায়গায় আমার গল্পের গাঁথুনি দুর্বল মনে হইলেও বেশির ভাগ অংশে উতরায়া যাইবেন নির্মাতা। দুর্বলতাটাও আমার মনে হইসে উনার অপারগতা না, সময়ের অভাব। আরো সময় নিয়া গল্পটা দাঁড় করাইতে পারলে এটা আরো বড় জায়গায় পৌছাইতো, হয়ত।
জাভেদ চরিত্রটা আরো সময় নিয়া রেন্ডার দেয়া যাইত। গভীর হয় নাই খুব। হয়ত নির্মাতা বলবেন, আমি চাইসি এই চরিত্র মাইল্ড থাকুক, নিরবতা দিয়া কথা বলুক। নিরবতায় একমত আমিও। কিন্তু দর্শকরে জাভেদের মনস্তত্ব স্পর্শ করে নাই, যতটা সাবেরী চরিত্র করতে পারসে।
সাবেরী চরিত্রে অনবদ্য তিশা। গল্পের এক পর্যায়ে বাবারে যখন পানি দিতে আইসা কাঁদতে থাকে সাবেরী আমি খেয়াল করসি, আশেপাশে অনেকেই কাঁদতেসে।
গল্পের নানা মোড়ে দর্শকরে বুঝদার ধইরাই নির্মাতা গল্পটা বলসেন। অনেক জায়গায় ভাবাইতে বাধ্য করসেন।
আর সিনেমাটোগ্রাফিতে অসাধারণ কাজ দেখাইসেন সিনেমাটোগ্রাফার শেখ রাজিবুল ইসলাম। প্রথম সিনেমা হইলেও এটা কিন্তু মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাথে উনার প্রথম কাজ না। বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে একসাথে কাজ করসেন উনারা। এক প্রবাসী শ্রমিকের জীবন নিয়া ক্রাউন সিমেন্টের বিজ্ঞাপন কিংবা জুঁই-এর ছাড় না দেয়া মেয়েটার গল্প— উনাদের একসাথে করা কাজ।
রাজিবুল ইসলাম এর কাজ বেশ গুছানো এবং সিনেমাটিক- নিঃসন্দেহে। তার কাজে তার স্থাপত্য বিদ্যার প্রভাব বেশ স্পষ্ট। লোকেশন হিসাবে যেই বাড়িগুলা সিলেক্ট করা হইসে, সেইগুলা বাংলাদেশের স্থাপত্যশৈলির অসাধারণ রুপ ফুটায়া তুলে ফ্রেমে। সেট ডিজাইন এর কাজ সহজ কইরা দেয় অনেক সময় ভালো স্থাপত্য। প্রোডাকশন ডিজাইন আর আর্ট ডিরেকশানে যারা ছিলেন- সাধুবাদ। অসাধারণ মুন্সিয়ানা ছিল। যদিও পোশাক সিলেকশন আরো চিন্তা কইরা করা যাইত মনে হইসে।
ফ্রেমিং এবং টাইম-স্পেসের সাহায্য নিয়া গল্পরে সামনে আগায়া নিয়া যাওয়ার কঠিন কাজটা নির্মাতা করসেন সার্থকভাবে। সাহিত্য বা কবিতা যেমন শব্দের গাঁথুনি দিয়া তৈয়ার হইতে থাকে, সিনেমা তেমন ফ্রেম আর শট দিয়া। শব্দ দিয়া। ইমেজ আর সাউন্ডের সার্থক ইন্সটেলেশান হইল সিনেমা।
শুধু অভিনেতা বা অভিনেত্রী না, প্রকৃতিও যে অভিনয় করতে পারে তা তারকোভস্কি, কিয়ারোস্তামি, বেলা তার, সাই মিং লিয়াং বা নুরি বিলগে চিলানের কাজ দেখলে বোঝা যায়। এই সিনেমায় তার ছাপ স্পষ্ট। নীরবে ফ্রেমের দিকে তাকায়া থাকা জাভেদ বা সাবেরীর মুখ মনে দাগ কাটে। দমকা বাতাস বা আরবান লাইফের নিস্তব্ধতা, শব্দ আর ইমেজের সাহায্য নিয়া ফুটায়া তুলসেন নির্মাতা। আর এর সাথে ‘আহারে জীবন’ গানের ম্যারেজ অসাধারণভাবে ইমোশানরে নাড়া দেয়।
এবার আসি ‘ডুব’-এর মার্কেটিং বা বিপননের কথায়। নির্মাতা খুব ভালোই জানেন, কিভাবে প্রোডাক্ট সেল করতে হয়। ইরফানের করা জাভেদের চরিত্রে দেশের অনেক গুণী অভিনেতা অভিনয় করার যোগ্যতা রাখেন- কোন দ্বিমত নাই। কেন তাইলে ইরফান খান?
ইন্ডিয়ার বাজারে প্রবেশের জন্য নির্মাতার একজন ইন্ডিয়ান মুখ দরকার ছিল। যত দূর জানি জাভেদ চরিত্র করার জন্য নওয়াজুদ্দীন সিদ্দিকীরেও অফার দেয়া হইসিল। হয়ত ব্যাটে বলে হয় নাই- উনি করেন নাই। ইরফান খান রাজি হইসেন। নির্মাতারে সাধুবাদ, উনি স্টারডমের ভেল্কি দেখাইতে চান নাই- অন্য খানদের দরজায় কড়া নাড়েন নাই।
ইরফান করাতে কি লাভ হইল দেশের সিনেমার?
বলিউড তথা ইরফানরে চেনে এমন একটা দর্শক শ্রেণী জানল বাংলাদেশেও সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি আছে এবং সেইখানে কিছু নির্মাতা কাজ করতেছেন। ডুব একটা নতুন মাইলফলক দেশের সিনেমার এই দুর্দিনে।
তাছাড়া আন্তর্জাতিক সিনেমা নির্মাণের একটা উদাহরণ তৈরি হইল। গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে আপনি খালি দেশের গণ্ডির ভিতর সিনেমা বানায়া তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারেন না যেইখানে তাইওয়ান, হংকং, ইন্ডিয়া, কোরিয়া, জাপানের মতো এশিয়ার অন্য অনেক দেশ আন্তর্জাতিক বাজার ধইরা ফেলতেসে। আর শুধু কলকাতা বা পশ্চিম বাংলার দর্শক টার্গেট কইরাও আখেরে লাভ নাই খুব একটা, তারাও এই দেশে দর্শক খুঁজতে আসে। ‘আমি ছোট, আমাকে মারবেন না’ নীতিতে করুণা ভিক্ষা না কইরা হিম্মত নিয়া ঐ বাজারে ঢুকতে চাইসেন নির্মাতা। এইটাই আমার কাছে সাধুবাদের দাবিদার মনে হইসে।
বিশ্বের অন্য অনেক দেশের সাথে প্রতিযোগিতা কইরা দেশের গার্মেন্টস শিল্প টিইকা আছে। সিনেমারে যদি শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে ধরি, তাইলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা কইরা নিজের সিনেমারে বাঁচায়া রাখতে হইতে পারে। খালি আবেগী কথা, ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ বইলা কাঁদলে দেশের সিনেমারে বাঁচাইতে পারবেন না। এই প্রতিযোগিতার বাজারে দেশের নতুন অনেক নির্মাতা সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতেসেন। আন্তর্জাতিক বাজারে ঢুকতেসেন। ‘ডুব’-এর নির্মাতা ও সেই পথের পথিক ধইরা নেয়া যায়।
গল্পের নির্বাচন নিয়া বলি একটু। কেন এই গল্প?
গদার একটা কথা বলসিলেন, ‘এমন জিনিস দেখাও যা তুমি না দেখাইলে আর কেউ দেখাইতে পারবে না।’
এই গল্প ফারুকী বলসেন কারণ উনি হয়ত ভাবসেন এটা উনি না বললে আর কেউ বলবে না। এটা নির্মাতার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর তার সিনেমা তিনি কিভাবে বানাবেন তাও তার নিজের ব্যাপার। একই গল্প অন্য কেউ বললে হয়তো অন্য পারস্পেক্টিভ থাইকা বলবে। অন্যভাবে বলবে। সিনেমারে শুধু গল্প দিয়া বিচার করার ও পক্ষে না অনেকে। আবার সব কিছুতে ‘কেন’ খুঁজতে গেলেও সিনেমার রস কমতে পারে।
তারকোভস্কি বলতেন, ‘সব কিছুতে অর্থ খুঁজতে গেলে চারপাশের সব ঘটনা হারাইতে থাকবে।’
অনেক নির্মাতা আছেন যারা গল্পের চেয়ে অন্য অনেক বিষয়রে প্রাধান্য দেন। তাদের মতে গল্প তো উপন্যাসও কয়, সিনেমারেও গল্প নির্ভর হইতে হবে কেন? কিয়ারোস্তামিও বলসেন এমন কথা। ভারতের অমিত দত্ত বানাইসেন ‘ক্রমশ’। তিনিও গল্প বলেন কাব্যিক ধারায়। শব্দ আর ইমেজের বিয়া দেন আর প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করেন নিজেরে- ‘সিনেমা কী পারে যা অন্য আর্ট পারে না!’
সিনেমারে অনেকে কবিতা বা মিউজিকের কাছাকাছি ভাবতে চাইসেন। একটা কবিতায় কি আপনি গল্প খুঁজেন? বা কোন গানে গল্প না থাকলে কি আপনি গানটা শোনা বন্ধ করে দিসেন? কবিতার আবার সব লাইন আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। আবার সব কবির সব কবিতা আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। আবার অন্যদের ভালো লাগতে পারে। আমাদের সমস্যা হইল আমরা কবিতা পড়ি না, কবিদের চিনি না। চিনি গল্পের জাদুকরদের। মূলধারার সাহিত্য চর্চায় ও গল্পকারদের কাটতি বেশি বাজারে। এই জন্য হুমায়ূন আহমেদের গল্প উপন্যাস বেশি- কবিতার চেয়ে। বা হুমায়ূন আহমেদ বাধ্য হইসেন গল্পকার হইতে- কারণ কবিতার পাঠক নাই এই অঞ্চলে।
‘সিনেমা কী পারে যা অন্য আর্ট ফর্ম পারে না’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে নানা গলিতে ঢুকতে বাধ্য হইবেন আপনি। গল্প আর ‘কেন এমন’ এইসব ক্লিশে টপিক ছাইড়া অন্য আড্ডার টপিক তৈয়ার হবে। নতুন ধারার সিনেমা বানানোর সাহস পাবে নতুন নির্মাতারা। দর্শকের কাছে নির্মাতা এইটুকু আবদার করতেই পারে।
তাইলে কি সিনেমায় গল্প থাকবে না?
এইখানে আমাদের আরেকটু সমঝদার হইতে হবে। অল্পতেই আমরা যে কোন জিনিসরে খারিজিদের কাতারে ফালায়া দেই। এই খাসলত বদলাইতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস হয় না, ফারুকীর সিনেমা হয় না, অমুকের গান হয় না, তমুকের আর্ট হয় না- এই ধ্যান ধারনা বদলানোর সময় আসছে। দিন শেষে মানুষ বাঁচবে তার কর্ম দিয়া। আর সময় ঠিক কইরা দিবে- কি হইসিল,আর কি হয় নাই। অনেক আর্টিস্ট জীবদ্দশায় তার প্রাপ্য সম্মান পান নাই- অনেক বড় মিউজিসিয়ান বা সিনেমার কবি মর্যাদা পান নাই বাইচা থাকতে। এইটা জাতির আরেক খাসলত। মরলে তখন বলে ‘বড় ভালো লোক ছিল’। গুণী জন্মায় সেইখানে- গুণের কদর হয় যেইখানে। ঋত্বিক ঘটকরেও বাঁইচা থাকতে তার প্রাপ্য দেই নাই আমরা। তারেক মাসুদরে নিজের সিনেমা ফেরি করে দেখাইতে হইসে জেলায় জেলায়। ‘মাটির ময়না’ আন্তর্জাতিক সম্মান না পাইলে তারেও নানা কথা দিয়া ডুবাইতাম আমরা।
গদারের বাণী দিয়া শেষ করি— ‘হোক অথবা না হোক, সেটা আসলেই কোন বিষয় না।’
ডুব ‘সিনেমা অর নট সিনেমা’ সেইটা বুঝতে হইলে আরো সময় দেয়া লাগবে। আর গল্প কেন্দ্রিক সিনেমার বাইরেও যে অ-গল্পের সিনেমা হয়, ভিন্নভাবে গল্পের উপস্থাপন হয়- সেইটা মাথায় রাইখা দর্শক হিসাবে আমাদের আরো ভিন্ন মতাবলম্বী সিনেমা দেখার চর্চা বাড়াইতে হবে।
লেখক : নির্মাতা ও জেনারেল ম্যানেজার- বিড়ালপাখি সিনে ক্লাব।