ডুব, হুমায়ূন আহমেদ ও একজন হিমু’র কথা
সোবাহান সাহেব একজন মধ্যবয়স্ক ধনী মানুষ। কিন্তু একজন অসুখী পিতা। তার ছেলেমেয়েরা যে যার মত ঢাকা শহরে থাকে। বাবার খোঁজখবরও রাখে না। এই বয়সে ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য তিনি একটা ফন্দি করেন। সব ছেলেমেয়েদের কাছে তার মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ পৌঁছে দেন। ছেলেমেয়েরা বাবাকে শেষ নজর দেখার জন্য সপরিবারে বাবার বাড়িতে চলে আসেন।
এটা কোন বাস্তব গল্প নয়। এটা একটা সিনেমার গল্প। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের “নয় নম্বর বিপদ সংকেত” সিনেমার। সিনেমার ট্যাগলাইন ছিল “হুমায়ূন আহমেদের একটি অর্থহীন ছবি”। তবে ছবির গল্প অর্থহীন ছিল না। হুমায়ূন স্যারের একজন নগণ্য ভক্ত হিসেবে যতটুকু মনে করি এটা ছিল তার নিজের জীবনেরই ছবি, আংশিক বায়োপিক। জীবনের এক সময়ে সন্তানদের কাছে পাওয়ার জন্য একজন বাবার মনের আকুলতা তিনি এই ছবিটির মাধ্যমে হাস্য-রসাত্মকভাবে তুলে ধরেছেন। আগেই বলে রাখি ধর্ম বাদ দিয়ে সমাজ কল্পনা করা গেলেও সেই সমাজের কোন মূল্য অন্তত আমার কাছে নেই। আর আমাদের ধর্মে বন্ধুত্ব বা পালিত সন্তান বা ধর্মের ভাই-বোন সম্পর্কের মূল্য থাকলেও সেগুলো কোনটিই রক্তের সম্পর্কের মত ঘনিষ্ঠ নয়। তাই মেয়ের বান্ধবী বা বান্ধবীর মেয়েকে বিয়ে করা করা আধুনিক সমাজের চোখে স্ক্যান্ডাল হলেও ধর্মীয়ভাবে অপরাধ নয়। এমনকি পালিত সন্তানের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করাও অধর্মীয় কিছু নয়। যাহোক হুমায়ূন স্যার যা করেছেন আমি কোনভাবেই এটাকে খারাপ বা বাজে কাজ বলতে পারব না। তিনি বিয়ে করেছেন, মেয়ের বান্ধবীর সাথে অবৈধ কিছু করেন নি।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে, মেহের আফরোজ শাওন বরাবরই একজন ভাল অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী ও গায়িকা। হুমায়ূন স্যারকে জীবনসঙ্গিনী করায় স্যারের অনেক অন্ধভক্ত তার বিরুদ্ধাচরণ করলেও আমি মনে করি এটা ঠিক না। হুমায়ূন স্যার শাওনকে ভালোবাসতেন। সেই হিসেবে আর আমাদেরও উচিৎ তাকে ভাল চোখে দেখা। কারণ ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসাকে ভালোবাসার নামও ভালোবাসা। “ডুব” সিনেমা নিয়ে সম্ভবত শাওনের মনে যে সংশয় আছে সেটা হলো “সিনেমাটিতে হুমায়ূন স্যারকে চরিত্রহীন পুরুষ এবং শাওনকে লোভী নারী হিসেবে দেখানো হতে পারে”। আমার বিশ্বাস ফারুকী কেন, বাংলাদেশের কোন পরিচালক এই হীন কাজ করবেন না। হয়তো হুমায়ূন স্যারের প্রথম পরিবারের কাছে শাওনের চরিত্রটি খলনায়িকার মত, এবং ডুব সিনেমাতে চরিত্রটি কিছুটা তেমনই থাকতে পারে। তাই বলে এই নয় যে ছবিটি মুক্তির পর সবাই নতুন করে আবার শাওনকে আঘাত করার জন্য হামলে পড়বে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আমরা পত্রিকায় পড়েছি, খবরে দেখেছি, শুনেছি, সিনেমায় সেরকম কিছু দেখলে দুনিয়া উল্টে যাবে না। হুমায়ূন স্যার অবুঝ ছিলেন না, শাওনকে বিয়ে করার ঘটনাটা যদি অপরাধ ধরা হয়, তবে শাওনের অপরাধ ৮০% হলে তিনিও ২০% অপরাধী ছিলেন। তবে আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন। মনের বিশ্বাস স্যারের কোন অপরাধ নেই, সেই উসিলায় শাওনেরও অপরাধ থাকলে তা মাফ। সিনেমায় হুমায়ূন স্যার ও শাওনের প্রেমকাহিনী যদি কোনরূপ বিকৃত করা ছাড়া তুলে ধরা যায়, আমি মনে করি সেখানে দোষের কিছু পাওয়া যাবে না। এমনও হতে পারে শাওনের মনস্তাত্বিক বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পেরে তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ভুল ধারনাগুলো দূরও হয়ে যেতে পারে।
সবশেষে একটা কথা বলি। আমি বইয়ের মাধ্যমে হুমায়ূন স্যারকে যতটুকু চিনেছি, তিনি ছিলেন সৎ সাহসী। আমার বিশ্বাস স্যারের জীবদ্দশায় কেউ যদি তার বায়োপিক বানাতে চাইতেন, স্যার তাকে বাঁধা না দিয়ে আরো উৎসাহ প্রদান করতেন। স্যারের সহধর্মিণী হিসেবে শাওন ম্যাডামের কাছেও একই ব্যবহার আশা করব।
বিঃদ্রঃ আমার নামটি হিমেল থেকে হিমু রেখেছিলেন আমার জান্নাতবাসী মা, যিনি হুমায়ূন স্যারের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। সেই টানেই স্যার ও তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত কিছু লেখার দুঃসাহস দেখালাম।