ঢাকাই সিনেমার ফার্স্ট লেডির গল্প
আজ গল্প বলতে এসেছি সেই অভিনেত্রীর যার হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে নায়িকার প্রচলন শুরু হয়। তিনি সুমিতা দেবী যাকে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ফার্স্ট লেডি।’ এই একটা ইতিহাসেও তিনি অমর হয়ে থাকবেন কারণ ইতিহাসটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নায়িকা, চরিত্রাভিনেত্রী। কি পজেটিভ কি নেগেটিভ দুইদিকেই সমান অভিনয়দক্ষতা ছিল।
মূলনাম হেনা ভট্টাচার্য। ধর্মান্তরিত হবার পর নাম হয় নিলুফার বেগম। সুমিতা দেবী মূলত চলচ্চিত্রের নাম যেটি পরিচালক ফতেহ লোহানীর দেয়া ‘আসিয়া’ ছবিতে। এরপর তাঁর এ নামই প্রচলিত। জন্ম ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জে। কালজয়ী পরিচালক জহির রায়হান তাঁর স্বামী। তাঁদের দুই সন্তান বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। প্রথমবার বিয়ে হয়েছিল কলকাতার বামপন্থী নেতা অতুল লাহিড়ীর সাথে এবং সে বিয়ে বেশিদিন টেকেনি।
কৈশোরেই প্রচলিত সমাজের বিপরীতে অবস্থান নেয়ার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন সুমিতা দেবী। তাঁর পরিবারে এক মেয়ে বিধবা হবার পর তাঁর লাইফস্টাইলে যে পরিবর্তন আসে সেটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। এজন্য পরিবারের সাথে তাঁর বাগবিতণ্ডা হয়েছিল। তবে এখান থেকেই জীবনে কিছু একটা করে দেখানোর জিদ হয়োছিল তাঁর। চলচ্চিত্রে কাজ করার সাহস সেই জিদেরই একটা পরবর্তী ধাপ বলা যেতে পারে এবং তিনি সফল হন। চলচ্চিত্রের জন্য প্রচলিত সমাজের জাতধর্ম, ভেদাভেদকে তিনি মানেননি এক্ষেত্রে তাঁকে নারী জাগরণী অভিনেত্রীও বলা চলে।
সুমিতা দেবীর চলচ্চিত্র অভিষেক হয় ১৯৫৯ সালে ‘আকাশ আর মাটি’ ছবিতে, নায়ক আমিন ও প্রবীর। তবে নায়িকা হয়ে আসেন ‘আসিয়া’ ছবিতে ১৯৬০ সালে। দুই ছবিরই পরিচালক ফতেহ লোহানী। তিনি হয়ে যান আমাদের চলচ্চিত্রের ফার্স্ট লেডি। নায়িকা বলে যে একটা বিষয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে আছে তারই প্রচলন শুরু হয় তাঁকে ঘিরে। আজ অব্দি যারা চলচ্চিত্রে নায়িকা হয়ে এসেছে সুমিতা দেবীর ধারায় এসেছে বলা যায়।
প্রাসাদের মধ্যে অতি সুন্দরী এক মেয়েকে সাজিয়ে রাখার ইচ্ছা হয় বাড়ির কর্তার যেন তাকে বাইরের কেউ না দেখে। মেয়েটিও সেভাবেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু এভাবে কতদিন থাকা যায়। একসময় প্রাসাদে এক নতুন আগন্তুক আসে। আগন্তুকের সাথে মেয়েটির ভালোবাসা হয়ে যায় কিন্তু ভাগ্য তাদেরকে এক হতে দেয় না। ছবির নাম ‘কখনো আসেনি।’ জহির রায়হানের পরিচালনায় ১৯৬১ সালে মুক্তি পায় অসাধারণ এ ছবিটি যার নায়িকা সুমিতা দেবী। নায়ক ছিলেন খান আতাউর রহমান যিনি আনিস নামে অভিনয় করতেন তখন। একই জুটির নিটোল প্রেম ও বাধার গল্পে ‘কাঁচের দেয়াল’ মুক্তি পায় ১৯৬৩ সালে। খানআতা-সুমিতা দেবী ভালো জুটিতে পরিণত হয়।
পঞ্চাশের দশকের চলচ্চিত্রে শুভ সূচনা করে সুমিতা দেবী বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে সমানভাবে কাজ করতে থাকেন। তাঁর ক্রেজ বাড়তে থাকে।
উল্লেখযোগ্য অন্যান্য ছবি : সোনার কাজল, দুই দিগন্ত, এইতো জীবন, মাটির পাহাড়, এদেশ তোমার আমার, বেহুলা, অভিশাপ, নতুন প্রভাত, ওরা ১১ জন, বউ কথা কও, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, লাল সবুজের পালা, সুজন সখি, লাল কাজল, জন্ম থেকে জ্বলছি, দুই পয়সার আলতা, দস্যু বনহুর, আগুন, মনিমালা, গুণ্ডা, অলঙ্কার, সোনার হরিণ, ডাকপিওন ইত্যাদি।
সুমিতা দেবীর জীবনটাও ছিল সংগ্রামী। দেশবিভাগের সময় তাঁর পরিবারকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। দুই দফায় কলকাতা থেকে ঢাকায় আসতে হয়েছিল দেশবিভাগ ও হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার জন্য। ১৯৫৭ সালে আবার ঢাকায় আসেন। তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাস নিয়ে নির্মিত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে সুমিতা দেবীর কাজ করার কথা ছিল। পরিচালক এ জে কারদার তাঁকে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুমিতা ছবিটি করতে পারেননি নয়তো ওটাই তাঁর প্রথম ছবি হত। মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। উর্দু ‘সঙ্গম’ এবং পরে আরো কয়েকটি ছবিতে কাজ করতে গিয়ে পরস্পরের প্রেমে পড়েন জহির রায়হান ও সুমিতা দেবী। তাঁদের বিয়ে হয় এবং আট বছর সংসার ছিল। জহির রায়হান দ্বিতীয়বার সুচন্দাকে বিয়ে করেন এবং সুমিতা দেবী একা হয়ে পড়েন। তাঁর শেষ জীবন ছিল একাকীত্বে ভরা। চলচ্চিত্রের মতো বাস্তবেও তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে জীবনের সাথে।
আমাদের চলচ্চিত্রে খলনায়িকা বা খল অভিনেত্রীর যে প্রচলন ঘটেছে তার শুরুর কাণ্ডারিও ছিলেন সুমিতা দেবী। বেশকিছু ছবিতে খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মারধর বা নির্যাতনের দৃশ্য না দেখিয়েও যে শুধু অভিনয় দিয়ে বাচনভঙ্গি দিয়ে খল চরিত্র করা যায় তিনি দেখিয়েছেন। মায়া হাজারিকা, রওশন জামিল-রা খল চরিত্র করে যে খ্যাতি পেয়েছেন তার শুরুটা ছিল সুমিতা দেবী-র।
অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন সুমিতা দেবী। ‘আসিয়া’ ছবিতে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট পদক পান। ১৯৬৩ সালে ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবির জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ‘নিগার পুরস্কার’ পান। এছাড়া বাচসাস পুরস্কার, বাংলাদেশ টেলিভিশন রিপোর্টার সমিতি পুরস্কার, ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার, আগরতলা মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কার পান। তবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পাওয়াটা দুঃখজনক।
তাঁর শেষ জীবন অনেকটাই একাকীত্বের ছিল। ৬ জানুয়ারি ২০০৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।
সুমিতা দেবী শুধু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নয় পুরো বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের গর্বিত নাম। কারণ তাঁর সময়টাই ছিল বাংলা ভাষার অভিনেত্রী হিসেবে তাই তাঁর দর্শকভক্তরাও ছিল বাংলা ভাষাভাষী সব দর্শক। আমাদের চলচ্চিত্রের ফার্স্টলেডি হয়েও তিনি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় নাম হয়ে থাকবেন। শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি।