ঢাকাই সিনেমার ব্র্যান্ড ভ্যালুতে সাম্প্রতিক অনাস্থা
একটা সিনেমায় অভিনেতা-অভিনেত্রীই নন, নানান ধরনের ব্র্যান্ড ভ্যালু এর বিপণন ও দর্শকগ্রহণযোগ্যতায় প্রভাব ফেলে। পরিচালক একটি ব্র্যান্ড হতে পারে। আর বড় ও সফল ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে স্টুডিও বা প্রযোজনা সংস্থাগুলোও ব্র্যান্ড ভ্যালু হিসেবে বিপণনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। অনেক সময় পরিচালক ও ব্যানারের সুনামের কারণে আনকোরা বা তুলনামূলক অসফল অভিনেতাদের সিনেমা নিয়ে দর্শকের আগ্রহ তৈরি হয় ও বক্স অফিসে সাড়া পড়ে যায়। সত্যি বলতে কী, যে ইন্ডাস্ট্রি সিনেমার বিপণনে এ ধরনের ভ্যালু তৈরি করতে পারে না, তা আসলে কোনো ইন্ডাস্ট্রিই নয়।
বাংলাদেশে এক সময় এ ধরনের নামে চলা অসংখ্য পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন। অবশ্য বিষয়গুরো এখন ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে ইউএসপি হিসেবে কাজ করে না; ছয় দশকের সিনেমার ইতিহাস আছে এমন এক ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটা আশ্চর্যজনক এক ঘটনা। রায়হান রাফীর মতো ব্যতিক্রম নাম হয়তো নেয়া যায়, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সে অর্থে আর নেই! এ না থাকার কালেও যা আছে তা আবার ভুলভাল কাজ বা ছোটখাট লাভের আশায় দর্শকের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। যেখানে একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠান ব্র্যান্ড ভ্যালু প্রতিষ্ঠার আগে ভুলভাল ট্যাগের শিকার হতে পারে।
সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ থেকে মূলত এ লেখার আইডিয়া। সেটা বলার আগে আরেকটু ভূমিকা দেয়া যাক। রায়হান রাফী পরিচালিত ও শাকিব খান অভিনীত ‘তুফান’-এর কারণে ২০২৪ সালে নিয়মিত হলগামী দর্শকের মন জিতে নেয় ওটিটি প্লাটফর্ম চরকি, যদিও প্রাথমিক ঘোষণার মতো পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি প্রযোজক হিসেবে নিজেদের প্রচার করেনি। শুধু স্ট্রিমিং পার্টনার হিসেবে চেহারা দেখিয়েছে। তা সত্ত্বেও ‘তুফান’ অনেকটাই চরকির সিনেমা। কিন্তু এ খ্যাতি প্লাটফর্মটির জন্য প্রথম অর্জন নয়, বরং ধারাবাহিক এক অর্জন। ২০২৩ সালে রায়হান রাফী পরিচালিত ও আফরান নিশো অভিনীত ‘সুড়ঙ্গ’ দিয়েও হিটমেকার হিসেবে পরিচিতি পায় চরকি। ওই সময় সিনেমা প্রযোজক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চরকি ব্যাপক প্রচারের আশ্রয় নেয়। প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হওয়ার সুফল পায় বেশ। সব মিলিয়ে শাকিব খানের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘প্রিয়তমা’র জন্য দারুণ ফাইট দিয়ে চরকি বড়পর্দার সিনেমা নির্মাতা ব্র্যান্ড হিসেবে অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা পায়। আর ‘তুফান’ সেই পালে নতুন হাওয়া লাগায়। কিন্তু একটা স্টুডিও বা ব্যানারের সাফল্য শুধু মারমার-কাটকাট সিনেমা নয়; বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
এ আলাপের মাঝামাঝিতে একটা বিষয় মনে করিয়ে দিতে যায়, এটা কোনোভাবেই সিনেমা, ওয়েব ফিল্ম, সিরিজ বা নাটকের বিভাজনধর্মী বা সংজ্ঞা নির্ণয় বিষয়ক লেখা নয়। বরং এ সৃজনশীল ভাবনার স্বাধীনতা যেমন পুরোপুরি নির্মাতার এবং একইসঙ্গে একজন ভোক্তা কীভাবে দেখবেন তারও। আমার আলাপ পুরোপুরি বিপণনে এ ক্যাটাগারাইজেশন কী ভূমিকা পালন করে; সে বিষয়ে অল্পস্বল্প ধারণা অর্জন।
যাই হোক, চরকির সম্পর্কে এ ভূমিকার পর এক হঠকারি সিদ্ধান্তের কথা বলি। বাংলা ওটিটির জন্য একটি ব্যতিক্রম হলেও দু-একটি প্রশংসিত কাজের জন্য পরিচিতি পেয়েছে এ প্লাটফর্মের ‘মিনিস্ট্রি অব লাভ’ সিরিজটি। এ সিরিজের একটি ছবি হলো ’৩৬-২৪-৩৬’। সামাজিক বার্তানির্ভর ছবি, শুরুতেই দর্শকও জেনে গিয়েছিল, এটি ওটিটির জন্য নির্মিত। সেভাবেই এসেছিল ঘোষণা। প্রচারণা। কিন্তু হুট করে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে নির্মাতারা। সার্টিফিকেশন সনদ নিয়ে সিনেমা হলে মুক্তি পায় ’৩৬-২৪-৩৬’। বাজেট, নির্মাণ আয়োজন ও কাস্ট ভ্যালু বিবেচনায় এরই মধ্যে দর্শক একে ওয়েব ফিল্ম বা ওটিটির জন্য নির্মিত কনটেন্ট হিসেবেই দেখেছে। এমনকি ট্রেলার বা প্রচার উপকরণগুলো সিনেমার মতো জমকালো বিবেচনা করা হয়নি। এর ফলে ব্র্যান্ড হিসেবে চরকি যারা ঈদে ‘তুফান’-এর মতো তুমুল জনপ্রিয় সিনেমা দিল, তারা নেমে এল ওয়েব ফিল্ম বা নাটককে সিনেমা হলে চালানো প্রতিষ্ঠান হিসেবে!
এর অল্প কদিন পরই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল মেহজাবীন চৌধুরীর অভিষেক সিনেমা ‘প্রিয় মালতী’। যা কিনা আগেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিয়েছে, সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্যরা প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু সহ-প্রযোজক চরকির লোগো কিছুটা হলেও এ সিনেমার প্রচার বা বাণিজ্যে প্রভাব ফেলেছে। এটি শুরু থেকে আগা-গোড়া সিনেমা হিসেবে নির্মাণ ও প্রচার হলেও দর্শক বলছে চরকি আবারো সিনেমা হলে ওয়েব ফিল্ম মুক্তি দিয়েছে! অন্তত সোস্যাল মিডিয়ার সিনেমা বিষয়ক গ্রুপে তেমন আলাপই তো গেল। যার প্রভাব যে শাকিব খানের মতো নায়ক সিনেমায় না থাকলে আগামীতে পড়বে না; তা কি কেউ বলতে পারে!
ওটিটি প্লাটফর্ম হিসেবে চরকির সিনেমা প্রযোজনা নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। একে তো নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত লগ্নি, তার সঙ্গে এর করপোরেট ধাঁচ। সনাতনী কৃৎকৌশল ভেঙে পড়ার পাশাপাশি সনাতনী ধাঁচের প্রযোজনা অতীত হওয়ার কালে এ ধরনের একটি সেটআপ ঢাকার সিনেমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তা কতটা পরিকল্পনা মাফিক চলবে তা অবশ্য আমরা স্পষ্ট নই। এ প্রতিষ্ঠান যখন হলে প্রথমবার কোনো সিনেমা রিলিজ দেই, তখনও পরিকল্পনাহীনতার ছাপ দেখা যায়। সেই সিনেমাটি ছিল গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘গুণিন’। যা কিনা ওয়েব ফিল্মের পাত্র-পাত্রী শরিফুল রাজ ও পরীমনির দেশ কাঁপানোর বিয়েকে উপলক্ষ্য করে তড়িঘড়ি সেন্সর করিয়ে সিনেমা হলে মুক্তি দেয়া হলো। কিন্তু আগে ওটিটির জন্য নির্মিত ফিল্ম হিসেবে প্রচারিত ‘গুণিন’-এর থিয়েট্রিক্যাল ফল উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। বরং বড়পর্দার ব্যানার হিসেবে শুরুতেই নেতিবাচক ট্রেন্ড দিয়ে যাত্রা করে চরকি। সেখানে তারা শিক্ষা নেয়নি। হয়তো এ ধরনের সিনেমাগুলো অল্প কালেকশন, ওটিটির দর্শক ভ্যালু ও করপোরেট স্পন্সরশিপ বা সামষ্টিক ওটিটি আয়োজনের বিপরীতে সফল প্রচেষ্টা। কিন্তু একটা সিনেমা যে প্রেক্ষাগৃহ টিকিয়ে রাখার ছোট ছোট পদক্ষেপের অংশ হয়ে থাকে, সেই বিষয়টা মিসিং থেকে যাচ্ছে এসব সিনেমায়। এমনকি সিনেমা তো হলে দেখার বিষয়, তাও যেন ভুলে যাচ্ছেন নির্মাতারা। সিনেমার বাণিজ্যিক সাফল্য কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ নির্ভরই, বক্স অফিস এ হিসাব-নিকাশে অন্যকিছু বিবেচনা করে না। বরং সিনেমার নামে অন্য কিছু দেখা হচ্ছে এমন বিবেচনায় দর্শক পরবর্তী সিনেমাটি (যা শুরুতে সিনেমা আকারে প্রচার হয়েছে) দেখতে আগ্রহী নাও হতে পারে।
অবশ্য একটি রুগ্ন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এ ধরনের তামাশার দায় পুরোপুরি চরকির কাঁধে চাপানো কিছুটা অন্যায়ই বটে। আর সেই ‘ধান ভানতে গিয়ে শিবের আলাপ’ কতটা বিস্তারিত নাও করতে পারি। শুধু সাম্প্রতিক দু-একটা ঘটনার হিন্টস দিই। কিছুদিন আগে চাউর হলো, প্রথমবারের মতো সিনেমায় অভিনয় করতে যাচ্ছেন তানজিন তিশা। টিভি পর্দার এ নায়িকা আগেও কয়েকবার বড়পর্দার নায়িকা হওয়ার গুঞ্জনে ছিলেন, তবে ব্যাটে-বলে মিলছিল না। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, এক বা দুটো শো হলেও সিনেমায় দেখা গেছে এ নায়িকাকে। আপনি কি জানেন জনপ্রিয় নির্মাতা ভিকি জাহেদেরও সিনেমায় অভিষেক হয়ে গেছে! ঘটনা তেমন জটিল না। মাহবুবা ইসলাম সুমি পরিচালিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে ‘তুমি রবে নীরবে’ সিনেমায় তিশাকে নায়িকা হিসেবে দেখা গেছে। সম্ভবত কোনো এক সপ্তাহে এ সিনেমার কয়েকটি শো কোনো এক প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছিল। আবার ভিকি জাহেদ পরিচালিত ‘কার্নিশ’ নামে সিনেমায় একই কায়দায় প্রদর্শিত হয়েছে। অথচ না তানজিন তিশা সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, না ভিকি জাহেদ সিনেমা বানিয়েছিলেন। দুটোই ছিল টিভি-ফিকশন। পরে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম সেন্সর করিয়ে সিনেমা আকারে মুক্তি দেয়। যা দর্শকের কাছ থেকে সাড়া না পেলেও ভিকি জাহেদ কিন্তু থিয়েট্রিক্যাল সিনেমার নির্মাতা। তিনি যদি এখন ‘অভিষেক সিনেমা’ উল্লেখ করে বড় কোনো ফেস্টিভ্যালে নিজের ভবিষ্যৎ কোনো নির্মাণ যুক্ত করতে চান, সেখানে ভুল তথ্য দেয়ার অভিযোগ উঠতে পারে। খোঁজ নিয়ে দেখেন, এ অবসরে নিজেদের অজান্তে কত কত পরিচালকের প্রথম সিনেমাটি হলে মুক্তি পেয়ে গেছে!
সিনেমা ব্যবসায় ইমপ্রেস টেলিফিল্ম একইদিনে সিনেমা ও ছোটপর্দায় মুক্তির বিরল এক ট্রেন্ড চালু করেছে। দয়া করে আবার এইচবিও ম্যাক্সে ‘ব্ল্যাক উইডো’র মতো সিনেমার প্রিমিয়ারের সঙ্গে এক করবেন না, করোনার আপদকালীন সেই পরিস্থিতি আর নেই। যদিও সেদিন একজনকে ঠাট্টা করতে দেখলাম, কী বোকা নেটফ্লিক্স! তারা হিট সিরিজগুলো সিনেমা হলে মুক্তি দিয়ে বড় অংকের অর্থ কামানোর সুযোগ হারাচ্ছে! বাংলাদেশ থেকে শেখার কত কী আছে!
যাই হোক, চরকি প্রসঙ্গে আলাপে অবধারিতভাবে চলে এল ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। দুঃখজনক হলেও কোনো সিনেমার দর্শক আর এ প্রতিষ্ঠানের লোগো বিশ্বাস করে না। অথচ অস্বীকারের উপায় নেই যে তাদের প্রযোজনয় নির্মিত হয়েছে চমৎকার কিছু ছবি। কিন্তু ইমপ্রেস এখন শুধু টেলিফিল্ম অর্থেই ইমপ্রেস জাগায়। এখন ইমপ্রেসের সর্বশেষ সিনেমা সিনেমা কাণ্ড দিয়ে লেখার ইতি টানা যেতে পারে। তা হলো মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘৮৪০’। ইমপ্রেসের সঙ্গে একাধিক জনপ্রিয় কাজ করেছেন এ নির্মাতা। সর্বশেষ সিনেমাটি যখন মুক্তি পায়, তার কয়েকদিন আগে দর্শকদের পক্ষে জানা ছিল না, এটি কী ধরনের কনটেন্ট। তবে খানিকটা অস্বস্তিসহ লক্ষ্য করা যায়, সিনেমা হিসেবে যখন প্রেক্ষাগৃহে ‘৮৪০’ প্রদর্শিত হচ্ছিল তার কিছুদিনের মধ্যেই কয়েক পর্বের সিরিজ আকারে এর প্রচার। বিষয়টি যতই অভিনব না কেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একে ‘ব্র্যান্ড ইমপ্রেস টেলিফিল্মের’ অতীতের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে খুব একটা ভুল হবে না। এ বিষয়ে বেশি কিছু আর না বলে অন্য একটা নোক্তা দেয়া যাক। কয়েক বছর আগে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সঙ্গে যুক্ত চ্যানেল আইয়ে ‘সাত ভাই চম্পা’ শিরোনামের শ’খানেক বা এর বেশি পর্বের একটি সিরিজ প্রচার হয়েছিল। যা কিনা এখন সেন্সর সনদ নিয়ে তিন পর্বের সিনেমা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ওটিটি প্লাটফর্মের শোভা বাড়াচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ’৩৬-২৪-৩৬’ এর মতো ‘৮৪০’ এর প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ছবিয়াল।
মজার আরেকটি তথ্য দেয়ার লোভ না সামলে আলাপটি শেষ করবে। পরপর শাকিব খানের সঙ্গে সিনেমা করে আলোচনায় এসেছিল শাপলা মিডিয়া নামের প্রতিষ্ঠান। তাদের ব্যানারে ‘মাফিয়া’ নামের বড় একটি সিরিজ হয়েছিল। কিন্তু নির্মাণের পর নির্মাতারা সিদ্ধান্ত নেন সাত পর্বের সিনেমা আকারে মুক্তির। এরপর এক বা দুটি পর্ব সিনেমা আকারে মুক্তি পায়। পরে আবার এটি সিরিজ আকারে কোনো একটি চ্যানেলের প্রচারের পর আবার সিনেমা আকারে ইউটিউবে ফেরত এসেছে। ওটিটির জন্য নির্মিত কনটেন্ট সিনেমা হিসেবে মুক্তির আরো উদাহরণ দেয়া যাবে। তবে আপাতত এখানেই থামি।
আমরা ধারণা এ আলাপ কৌতুককর অর্থে বা কাউকে হেয় করার জন্য তোলা হয় নাই; তা আপনারা বুঝতে পারবেন। সিনেমা যে সামগ্রিকভাবে প্রেক্ষাগৃহ কেন্দ্রিক ভাবনা ও পরিকল্পনা থেকে নির্মাণ; ব্র্যান্ড ভ্যালুর প্রসঙ্গ টেনে সেটাই বলতে চেয়েছি।