ঢাকাই সিনেমা ও সাহিত্যে ‘ম্যান অন ফায়ার’
২০০৭ সালের ২৩ নভেম্বর মুক্তি পায় কাজী হায়াৎ পরিচালিত এবং মারুফ, নদী, ডন অভিনীত ‘ক্যাপ্টেন মারুফ’। চলচ্চিত্রটি ডিজিটাল ক্যামেরায় শুট করা হয়, প্রচারণা করা হয় দেশের প্রথম ডিজিটাল ফরমেটের ছবি হিসেবে। তবে সেসময় এক স্টার সিনেপ্লেক্স ছাড়া দেশে কোনো ডিজিটাল প্রদর্শনী সিস্টেম না থাকায় এনালগে রূপান্তর করে মুক্তি দিতে হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি সেসময় বেশ ভালো সাড়া ফেলেছিল।
এর ঠিক তিন মাস পরেই, ২০০৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় ইলিয়াস কাঞ্চন পরিচালিত ‘বাবা আমার বাবা’। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন, দিঘী, মৌসুমী, ফেরদৌস, শাকিল খান, মিজু আহমেদ, ওমর সানীসহ অনেকে। তারকার ছড়াছড়িতে চলচ্চিত্রটিকে বেশ ভারি মনে হলেও প্রত্যাশানুযায়ী সাফল্য পায়নি।
‘ক্যাপ্টেন মারুফ’ ও ‘বাবা আমার বাবা’; উভয় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত এ জে কুইনেলের উপন্যাস ‘ম্যান অন ফায়ার’-এর ছায়া অবলম্বনে। কাজী হায়াৎ ও ইলিয়াস কাঞ্চন, দুজনেই যথেষ্ট পরিমাণ অংশ রদবদল করে দেশীয় আদলে নির্মাণ করেছেন।
শুধু চলচ্চিত্র নয়, সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরার আগে ইতোমধ্যেই আমাদের দেশে দুইবার ‘ম্যান অব ফায়ার’ উপন্যাস আকারে পাবলিশ করা হয়ে গেছে। আশির দশকের শেষদিকে শেখ আবদুল হাকিম (নিয়মানুসারে প্রকাশ হয় কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে) লেখেন মাসুদ রানা সিরিজের অন্যতম জনপ্রিয় দুই খন্ডের উপন্যাস, ‘অগ্নিপুরুষ’। থ্রিলারটি পাঠকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আজও তা অক্ষুণ্ন রয়েছে। এর আগেই ‘কলম জাদুকর’ হুমায়ূন আহমেদ ‘ম্যান অন ফায়ার’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন উপন্যাস ‘অমানুষ’, যা পরে একদমই মৌলিক কাজ মনে হয়। অর্থাৎ, অনুবাদ না করে নিজের মতো করে বদলে নিয়েছিলেন হুমায়ূন। অন্যদিকে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজেও আগের কাহিনির সঙ্গে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা হয়েছিল। এসেছে সিরিজের পুরোনো কিছু চরিত্রও।
এই ‘ম্যান অব ফায়ার’ অবলম্বনে আমাদের ঢালিউডের পাশাপাশি হলিউডেও দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, দুইটি চলচ্চিত্রের নামই উপন্যাসের নামের। প্রথমটি মুক্তি পায় ১৯৮৭ সালে, দ্বিতীয়টি ২০০৪ সালে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ভারতেও এই বই অবলম্বনে দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। একটি হলো অর্জুন সারজা অভিনীত তামিল ছবি ‘আনাই’, অন্যটি হলো অমিতাভ বচ্চন ও অর্জুন রামপাল অভিনীত হিন্দি ছবি ‘এক আজনবি’। দুটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ২০০৫ সালে। তামিলটি ২ ডিসেম্বর আর হিন্দিটি ৯ ডিসেম্বর; অর্থাৎ মাত্র ১ সপ্তাহের ব্যবধানে! তবে দুই ছবির কোনোটিই সফল নয়, সমালোচকও ভালো রেটিং দেননি।
এবার আসা যাক মূল কেন্দ্রবিন্দুতে, যে উদ্দেশ্যে আমার আজকের এতো আলোচনা। সাধারণত দেখা যায়, ২০০০ পরবর্তী সময়ে আমাদের পরিচালকেরা কোনো বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বা উপন্যাস অবলম্বনে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে, ক্রেডিট দিতে কার্পণ্যবোধ করে। আমরা বাইরের দেশে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে দেখি, সিনেমার প্রি-ক্রেডিট অথবা পোষ্ট ক্রেডিট সিনে যেখান থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে, সেটার ক্রেডিট দিয়ে দেওয়া হয়। অথবা সেই উপন্যাস/চলচ্চিত্রের স্বত্ব কিনে, অফিসিয়ালি ঘোষণা দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়।
এই ক্ষেত্রে ঘটেছে সম্পূর্ণ উলটো ঘটনা। ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন ‘ক্যাপ্টেন মারুফ’ ও ‘বাবা আমার বাবা’; দুইটি চলচ্চিত্রেই একদম শুরুতে মূল উপন্যাস ও ঔপন্যাসিককে ক্রেডিট দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে তামিল ও হিন্দি কোনো চলচ্চিত্রেই ক্রেডিট দেওয়া হয়েছে, এমন কোনো উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ক্রেডিট ছাড়াই গল্প নিয়ে দুটি ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। অথচ সেসময় হিন্দি ও তামিল উভয় চলচ্চিত্রের বাজেট ও এরেঞ্জমেন্ট আমাদের থেকে বেশি ও বড় ছিল। ইন্টারেস্টিং না?