ঢাকা টু বোম্বে: জগাখিচুড়ির অপর নাম
পোস্টারে বড় করে লেখা ডিজিটাল সিনেমা আর বড় করে আমাদের শাকিব খান। শাকিব খান আর ডিজিটালের কম্বিনেশনটা কেমন হবে তা দেখতে ঢুকে পড়লাম হলে। সিনেমার প্রথম কয় মিনিট হলের পর্দার দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করতে চাইছিলাম এটা ডিজিটাল সিনেমা। ঘোলা স্ক্রিন, পর্যাপ্ত পরিমাণ পোকামাকড় (আগেকার বাংলা সিনেমায় যেইসব বস্তুকে স্ক্রিনের উপর লাফাতে দেখা যেত) আর লাল-নীল-সবুজ মানুষগুলো নিয়ে শুরু হল ডিজিটাল(!?) সিনেমা ঢাকা টু বোমে (থুরি বোম্বে)।
শুরুতেই আমাদের হিরোকে গ্যাদাকালে পাচারকারীরা তার মা ও মামার সামনে তুলে নিয়ে যায়। এই প্রথম দেখলাম কোনো মায়ের সামনে তার সন্তানকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে অথচ মা বাধা দিচ্ছে না, শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলছে। বিনা বাধায় পাচারকারীর হাত ধরে নায়ক চলে গেলেন ইন্ডিয়ায়। নায়কের ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখানো হলো খুব চমৎকারভাবে। আশায় বুক বাধবেন না, ওটা ‘প্রিন্স’ সিনেমার কাটপিস ছিল। কাউকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে যে অন্য সিনেমার কাটপিস ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে তা উত্তমভাবেই দেখালেন আমাদের উত্তম আকাশ।
পিচ্চি শাকিব মুম্বাই গিয়ে পাচারকারীদের হাত থেকে পালিয়ে যায়। তারপর খাবার চুরি করে দৌঁড়াতে গিয়ে রাস্তায় উষ্টা খেয়ে পড়ে। তখন এক পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করে – “তোমার বাসা কাহা হে?” এই হিন্দিতে ভুল আছে কিনা জানি না। তবে অন্যান্য হিন্দির মতো শোনায়নি। কখন যে রাত হচ্ছিল আর কখন যে দিন হচ্ছিল তা বোঝা বড় মুশকিল ছিল। এ পর্যায়ে শাকিব একটু বড় হয়। তাকে দেখা গেল রাতের বেলায় এক রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিতে। অপরদিকে দুইটা মেয়েকে লেকের ধার দিয়ে গল্প করতে করতে হাটতে দেখা গেল দিনের বেলায়। মেয়ে দুটির কথোপকথন ছিল এমন-
- কাল জো পিকচার চালা ও তু দেখা হে?
- হুম দেখা হে
- বহুত আচ্ছা থা। বাংলাদেশ কা পিকচার। ঢাকা টু বোম্বে
হিন্দি ভাষায় মেয়েরা যে “থা” বলে তা জানা ছিল না। আমারও ভুল হতে পারে কারণ ডিরেক্টর ‘ঢাকা টু বোম্বে’ সিনেমা মুম্বাইতে চালিয়ে হিট করে ফেলেছেন। উল্লেখ্য এই সিনেমার শুরুতে বেশিরভাগ দৃশ্যে কাটপিস ব্যবহার করা হয়েছে। মেয়ে দুটির উপর বখাটেরা হামলা করে আর পিচ্চি শাকিব রেস্টুরেন্ট থেকে এসে তাদের বাচায়।
এবার শুরু হল প্রিন্সসহ বেশ কয়েকটি সিনেমার কাটপিস শো। শাকিবের পেছনের দৃশ্য নড়ে বেড়াচ্ছে অথচ শাকিব সেই তুলনায় নড়ছে না। পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড চেঞ্জ করে দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছে সেটি আপনার চোখ এড়াবে না। ঠিক এই মুহূর্তে এক অতি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। শাকিব একটা সিগারেট খেয়ে ছুড়ে মারলেন আর ইয়া বড় একটা গাড়ি বিস্ফোরিত হয়ে দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। অভিনব দৃশ্য সিগারেট থেকে গাড়ি দ্বিখন্ডিত। তবে এটাও কাটপিস।
এবার দেখা গেল সিনেমার শুটিং চলছে। হিরো ভিলেনদের ধরতে গিয়েই পড়ে যাচ্ছে (মনে হচ্ছিল ইচ্ছাকৃতভাবেই পড়ছে)। “তু এক হিজরা হে”। ডিরেক্টর গালিটা কাকে দিলেন বুঝতে একটু সময় নিলাম। শাকিব দিলো হো হো করে হেসে। ডিরেক্টর হাসি শুনে শাকিবকে অভিনয়টা করে দেখাতে বলল। একটু ঢিসুম ঢিসুম করেই শাকিব হয়ে গেল মুম্বাই সিনেমার হিরো। হা ভাই আর কোনো উপায় নাই, এতো সহজেই মুম্বাই সিনেমার হিরো হওয়া যায়। দু মিনিট শুটিং-এর দৃশ্য দেখা গেল। দুই মিনিটের দৃশ্যে যা বুঝালাম পুরো সিনেমার শুটিং ওই রাস্তাটার ধারেই হয়েছে মানে এক জায়গাতেই গান, এক জায়গাতেই রোমান্স, এক জায়গাতেই ফাইট, এক জায়গাতেই আবেগী ডায়ালগ ইত্যাদি।
এবার দেখলাম একটা দেয়ালে লেখা “This is our mumbai city” দেয়ালটিতে রা-ওয়ান, শোলে, এম এল এ ফাটাকেস্টসহ আরো কয়েকটি সিনেমার হল পোস্টার। মানে ডিরেক্টর এফডিসির কোনো এক ফ্লোরকে এভাবে সাজিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন এটাই মুম্বাই সিটি। সিনেমায় এতো কাটপিস ব্যবহার করা হয়েছে যা ধরতে পারলে আপনি ভিড়মি খাবেন। এবার দেখলাম সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমার একটি দৃশ্য যেখানে ভিলেনরা ভিড়ের মাঝে কারো পিছু নিয়েছে। শাকিব আর সাহারা রাজপথ থেকে পেছনে তাকিয়ে ভিলেনদের গতিবিধি লক্ষ্য করে পালিয়ে যাচ্ছে। ওরে বাপরে! তারা হেঁটেই পাহাড়ি এলাকায় চলে এলো। কিন্তু আমার জানামতে মুম্বাই মুল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ। শহর থেকে হেঁটে এমন পাহাড়ি এলাকায় চলে আসা মানতে পারলাম না তবুও মানলাম। এবার শুরু হলো গান। গানে সাহারা যখন শাকিবের সামনে আসছিল আমি পেছনে শাকিবকে খুজে পাচ্ছিলাম না 😛
গান শেষে দেখা গেল তারা বর্ডারের কাছে চলে এসেছে। বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশেও চলে এলো। আমি তো টাস্কিত(!) নদিয়া, কোলকাতা না, ডাইরেক্ট মুম্বাই থেকে হেঁটে তারা বাংলাদেশে চলে এলো। পারোও বটে গুরু। এদিকে কাবিলা ঢাকায় চলে এসেছে। শাকিব কাবিলা কে ফোন দিলো। কিন্তু এই পুরো বিষয়টা আমার মাথায় ঢুকল না। হিসাব অনুযায়ী শাকিব ভারতীয় সিম বাংলাদেশে এনে কাবিলাকে ফোন দিয়েছে। কাবিলার বাংলাদেশি নাম্বার কিভাবে পেলেন তাও প্রশ্নবোধক। তিনি আদৌ কাবিলার বাংলাদেশি নাম্বারে ফোন দিয়েছিলেন কিনা তাও প্রশ্নবোধক।
এবার শাকিব সাহারাকে বলল “আমি ঢাকার বাড্ডা নামক গ্রামে যাবো” বাড্ডা গ্রাম(!) বাড্ডা গ্রাম(!!)
বাড্ডা গ্রামে দেখা গেলো একটা টং দোকানে লেখা “এখানে চা, কপি পাওয়া যায়”। মনে মনে বললাম “আপ্নারা মুম্বাই থেকে হেটে বাংলাদেশে এসেছেন একটু কফি খেয়ে জিরিয়ে নিন”
শাকিবকে যে পাচার করেছিল তার মেয়ে বনলতার জন্মদিন। লেখা দেখলাম “HAPPY BIRTHDAY BANLATA” ভাই noun এর ভুল নাই মানলাম, তাই বলে বনলতাকে মুরাদ টাকলাভাবে BANLATA লিখবেন?
পার্কে BANLATA আর BANLATA’র কুকুর টমি ঘুরে বেড়াচ্ছে। উলালা উলালা গান শোনা গেল। বনলতার মুখ স্থির ছিল, টমিকে মুখ নাড়াতে দেখা গেল। গানটা কোন দিক থেকে আসছিল ইঙ্গিত পেলাম।
এক দৃশ্যে দেখলাম বনলতাকে তার তিন বান্ধবী বলে “তোর বাবা পাচারকারী”। বনলতা কাঁদতে কাঁদতে তার বাবার কাছে বিচার দেয়। এতে কিছু গুন্ডা সেই তিনটা মেয়েকে ধর্ষণ করে। এই দৃশ্যটা এতোটা দৃষ্টিকটু ভাবে না দেখালেও হত। মেয়ে তিনটা আত্মহত্যা করতে যাবে আর শাকিব এসে তাদের বাঁচায়। মেয়ে তিনটা বলে “আমাদের বেচে থেকে কী লাভ? আমাদের কে বিয়ে করবে? আপনি আমাদের বিয়ে করবেন?” শাকিব বলে “হ্যাঁ আমি তোমাদের বিয়ে করব।“ বাউরে বাউ! শাকিব তো লোক সুবিধার না। একবারে চারটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে।
এবার শাকিবের সিনেমা “রোড মাস্টার” (হিন্দীতে লেখা ছিল কষ্ট করে পড়েছি) মুম্বাইতে রিলিজ হয়ে হিট হয়ে যায়। আমি তো ভাবছিলাম ডিরেক্টর মুম্বাইয়ের কথা ভুলেই গেছেন। আবার দেখলাম কাটপিসের ছড়াছড়ি। ডার্টি পিকচার সিনেমার হল থেকে পাইরেসি করার দৃশ্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। আর রোড মাস্টার সিনেমার সে আরেক অবস্থা। এই সিনেমার মাঝেও কাটপিস, কাটপিস দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড চেঞ্জ।
সামনে থেকে এক জোড়া কপোত কপোতিকে উঠে যেতে দেখলাম। মেয়েটা ছেলেটাকে বলছে “আর কোনোদিন যদি আমাকে বাংলা সিনেমা দেখাতে নিয়ে এসেছ তবে খবর আছে” ছেলেটা আমাকে বলল “একা একা বসে কী দেখছেন? চলেন ভাই” আমি বললাম “অনেকদিন আমার মাথাটা বরফের মতো জমে আছে। সিনেমা দেখে বরফকে বাষ্প করছি” আমি যে সারিতে বসে ছিলাম সেই সারি, সামনের কিছু সারি, পেছনের কিছু সারি সব ফাঁকা ছিল। কেমন যেন ভুতুড়ে পরিবেশে বাকি সিনেমা দেখলাম।
জাহাজের ভিতর ভিলেনদের সাথে শাকিবের ফাইট হল। চারজন কসাই চাপাতি নিয়ে শাকিবের উপর আক্রমণ করল। শাকিব চাপাতিকে শূন্যে ছুড়ে দিল। একটা #চাপাতি শাকিবের হাতে ফিরে এলো, বাকি তিনটা কোথায় গেলো জানি না। চাপাতি দিয়ে শাকিব সবার হাত কাটা শুরু করলেন। হাত কাটার পর সবার অনুভূতি কিছুই না। নো চিল্লানি, যেন শাকিব চুল কেটে নিয়েছে তাদের। আর চিল্লাবেই বা কিভাবে? হাত কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলো অথচ মাটিতে এক ফোটা রক্তও পড়তে দেখা গেল না। দারুল ব্যপার। আরো মজার ব্যপার –হাত কাটার পর পরই শরীরের ডান-বাম পাশটা ত্রিভুজের মতো ফুলে উঠেছে। জামার ভিতরে হাত গুটিয়ে রাখা এতো স্পষ্ট কেন তা বুঝতে চাইলাম না। শাকিবের সিনেমা দেখব আর আশ্চর্য সব দৃশ্য দেখব না তা কী হয়!
শেষ দৃশ্যে দেখা গেলো শাকিবের হুবহু একটা পুতুল তৈরি করা হলো (সম্ভবত #মোম দিয়ে) আর সেটা ভিলেনদের কাছে হস্তান্তর করা হল। কিন্তু কী আশ্চর্য কী আশ্চর্য! পুতুল হেটে হেটে ভিলেনদের কাছে গেলো ভিলেনরা তাকে গুলি করল রক্ত পড়ল। পুতুলের উপর নিশ্চয়ই কালো জাদুর প্রভাব পড়েছিল। আপনি যদি প্রেশারের রোগী হন তবে সিনেমাটা দেখবেন না, প্রেশার বেড়ে যাবে। আপনি হার্টের রোগী হলে হার্ট অ্যাটাক হবে। গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখতে গেলে আপনার ব্রেকআপ হবে। আত্মহত্যাপ্রবণ হলে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা হবে। এই সিনেমা দেখলে আপনি মনপুরার কথা ভুলে যাবেন। তাই আপনাদের বলব রিস্ক নেয়ার দরকার নেই। আর সিরিয়াসলি একটা কথা বলতে চাই, এ ধরনের সিনেমা বয়কট করুন। এ ধরনের সিনেমা বয়কট না করলে ডিরেক্টর আবার এমন সিনেমা বানাবে। চলচ্চিত্রে যে আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছে তা অচিরেই শেষ হওয়ার ঝুঁকি রাখে এ সব সিনেমার জন্য। শাকিব আবারও প্রমাণ করলেন একমাত্র একমাত্র একমাত্র তার দ্বারাই সম্ভব। গরুর গোবর দিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস তৈরি হয়, ডিরেক্টরের মগজ দিয়ে…
মনে হচ্ছে অসাধারণ একটা সিনেমা হয়েছে, আসলে আপনি যেটাকে কাটপিস বলেছেন তা কিন্তু ডিরেক্টর কপিরাইট করে এনেছে 😉 সুতরাং সিনেমাতে শাকিবের সাথে যে শাহরুখকে নাচতে দেখেন নাই এইটা আপনার ভাগ্যি আর ডিরেক্টরের দয়া, তবে ভাবছি মন খারাপের এই দিনগুলোতে এই সিনেমাটা আমার জন্য ভালোই হবে, কি বলেন ?
কয়েকদিন আগে শুনলাম,শাকিব দেখেশুনে কাজ করবেন। এই তার “দেখেশুনে” কাজ করার নমুন!!
স্বল্পাপ্ত জ্ঞানের কারনে কাটপিস কপিরাইট কথা টা শুনে হাসলাম ষাইফ ভাই
কয়েক রোযার সওয়াব আপনি পেয়ে গেছেন ভাই।
আমি প্রথম ২০ মিনিট দেইখাই আইসা পড়ছি।
আপনি শেষ পর্যন্ত ছিলেন। আপনার ক্ষমতা আছে ?
কিন্তু এই সিনেমা দেখা মানে ক্ষমতার অপব্যবহার করা
জুবায়েদ ভাই অনেক দিন ধরে মাথাটা জমে বরফ হয়ে ছিল .। বাষ্পীভূত করার প্রয়জন মনে করছিলাম
স্বল্পাপ্ত জ্ঞানের কারনে কাটপিস কপিরাইট কথা টা শুনে হাসলাম ষাইফ ভাই
জুবায়েদ ভাই অনেক দিন ধরে মাথাটা জমে বরফ হয়ে ছিল .। বাষ্পীভূত করার প্রয়জন মনে করছিলাম
আমি ট্রেলার দেখেই বুঝেছিলাম যে ছবিটা কেমন হবে ।আপানাদের ক্ষমতা দেখি আমার থেকেও কম !!
আমরা ক্ষমতা আর ধৈর্যের কারনে পুরষ্কারের দাবী রাখি
Tselim Rezaa ভাই।
পুরষ্কারবাবদ আপনি উত্তম আকাশের আগামী চলচ্চিতের একটা টিকেট পাবেন আমার পক্ষ থেকে।
বিঃদ্রঃ শুধু আপনার টিকেট-ই দেব। গার্লফ্রেন্ডের হিসেব আপনার কাছে।