ঢালিউডের মুভি মোগল
ছবির মানুষটিকে চেনেন? আজকের প্রজন্মের অনেকেই চিনবে না কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির নিয়মিত খবরাখবর রাখেন যারা তাদের কাছে এই মানুষটি খুব পরিচিত। তবে ক্যামেরার সামনে বা মিডিয়ার প্রচারে খুব কমই আসতেন তিনি। যার অবদান চিরকাল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি মনে রাখবে এবং রাখতে বাধ্য।
আজ থেকে দেড় বছর আগে এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন যিনি, শিল্পমনা ও ব্যবসায়ী চিন্তাভাবনা দুটিকে একত্রে করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির হয়েছেন মহারথী।
এ কে এম জাহাঙ্গীর খান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালী সময়ের খুব প্রভাবশালী নাম ছিল, তার প্রযোজনা সংস্থা আলমগীর পিকচার্স। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সব ধারাতেই ছিল এ কে এম জাহাঙ্গীর খানের পদচারণা বা অবদান।
সুভাষ দত্ত, আলমগীর কবির, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম, ইবনে মিজান, এফ কবির, কাজী হায়াতের মতো মেধাবী পরিচালকদেরই সেরা সব সিনেমা আলমগীর পিকচার্সের ব্যানারে নির্মিত। তৎকালীন সময়ে এতোটাই দাপুটে প্রযোজক ছিলেন যে তাকে ‘মুভি মোগল’ বলে সবাই সম্মান ও শ্রদ্ধা করতো। পরিবেশক ও প্রদর্শকরা আলমগীর পিকচার্সের সিনেমার জন্য অগ্রিম বুকিং দেয়ার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। বড় বড় পরিচালক, নায়ক-নায়িকারা দিনের পর দিন আলমগীর পিকচার্সের অফিসে গিয়ে বসে থাকতো শুধু এ কে এম জাহাঙ্গীর খানের দেখা পাওয়ার আশায় এবং তার কোন সিনেমায় একটা সুযোগ পাওয়ার আশায়।
‘সূর্য কন্যা’, ‘মেঘের অনেক রঙ’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘নয়ণমনি’, ‘দি ফাদার’, ‘বসুন্ধরা’, ‘শুভদা’র মতো দর্শক-সমালোচকদের মন জয় করা ক্লাসিক্যাল মাস্টারপিস সিনেমাগুলোর প্রযোজক তিনি। আবার ‘বিজয়ীনি সোনাভান’, ‘সওদাগর’, ‘আলী বাবা চল্লিশ চোর’, ‘চাকর’, ‘প্রেম দিওয়ানা’, ‘বাবার আদেশ’, ‘ডিস্কো ড্যান্সার’, ‘খলনায়ক’-এর মতো একদম বিনোদনধর্মী মাশালাদার সুপারহিট সিনেমাগুলোর নির্মাতাও এই জাহাঙ্গীর খান।
তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনায় এসেছিলেন ১৯৭৩ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর। তবে তারও আগে থেকে সিনেমার পরিবেশক ছিলেন। বাবুল চৌধুরীর ‘সেতু’ সিনেমা দিয়ে ডিস্ট্রিবিউশন শুরু করেন তিনি। আরো পরিবেশনা করেন ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’, ‘এখানে আকাশ নীল’, ‘অপবাদ’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘কী যে করি’, ‘আলিঙ্গন’, ‘নোলক’ ইত্যাদি।
১৯৮৬ সালে তার প্রযোজিত ও চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শুভদা’ ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ১৩টি সম্মাননা অর্জন করে অনন্য রেকর্ড গড়ে। ১৯৭৬ সালে প্রথম তিনি প্রযোজনা করেন ‘নয়নমণি’ ছবিটি। ৪৩টি ছবির প্রযোজক ও পরিবেশক তিনি।
এ মুভি মোগল প্রযোজিত সিনেমা টানা ২৫ সপ্তাহ, ৮১ সপ্তাহ, এমনকি ১০৩ সপ্তাহ ধরে প্রদর্শিত হয়েছে। অর্থাৎ রজতজয়ন্তী, সুবর্ণজয়ন্তী, হীরকজয়ন্তী ছুঁয়ে সগৌরবে চলেছে। বাংলাদেশে প্রথম যে ছবিটি টানা ১০৩ সপ্তাহ চলার রেকর্ড গড়েছিল, সেটি হলো আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়নমণি’।
সেই সময় কথিত ছিল যে, ‘ইন্ডাস্ট্রিতে যদি পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে চাও তাহলে জাহাঙ্গীর খান সাহেবের কাছে যাও।’ কথাটির উদাহরণ বা প্রমাণ হলেন প্রয়াত নায়ক মান্না।
ক্যারিয়ারের ৬ বছর পার হলেও মান্নার একক নায়ক হিসেবে বড় কোন সুযোগ ও সফলতা পায়নি। সুযোগ পেলেই আলমগীর পিকচার্সের অফিসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন জাহাঙ্গীর খানের দেখা পাবার আশায় কিন্তু দেখা মিলছিল না। এরই মধ্যে একক নায়ক হিসেবে ‘কাশেম মালার প্রেম’ সফলতা পায়। মান্না একদিন তার বন্ধু নবাগত পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবরকে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কারণ ‘চাকর’ সিনেমাটা নির্মাণ করে সফলতা পেয়েছিলেন।
আকবরই মান্নাকে জাহাঙ্গীর খানের সাথে সরাসরি দেখা করার সুযোগ করে দেন। ‘কাশেম মালার প্রেম’-এর মান্না দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়ে যান তখনকার শীর্ষ নায়িকা চম্পার বিপরীতে ‘প্রেম দিওয়ানা’ সিনেমায়। ব্যস, মান্নাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘প্রেম দিওয়ানা’র ব্যবসায়িক সাফল্যর পর পরবর্তীতে আলমগীর পিকচার্স থেকে নির্মিত মনতাজুর রহমান আকবরের সবগুলো সিনেমার প্রধান নায়ক যা হয়ে যান মান্না, যার বিপরীতে ছিলেন চম্পা। আলমগীর পিকচার্স থেকে নির্মিত মান্না-চম্পা জুটির সবগুলো সিনেমাই সুপারহিট।
৯০ দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের যে জ্বালাময়ী কাজী হায়াতকে আমরা পেয়েছিলাম তারও পেছনে আছেন জাহাঙ্গীর খান। আলমগীর কবিরের সহকারী হিসেবে কাজী হায়াতের সাথে জাহাঙ্গীর খানের পূর্ব থেকেই সখ্য ছিল। গুরু আলমগীর কবিরের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার পর কাজী হায়াৎ পরিচালক হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন, এগিয়ে এলেন জাহাঙ্গীর খান। কাজী হায়াৎ নির্মাণ করলেন ‘দি ফাদার’, যা সমালোচকদের মন জয় করলেও ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ।
জাহাঙ্গীর খান রেগেমেগে কাজী হায়াতকে বলে দিলেন, ‘আপনাকে দিয়ে আর আমি কোন সিনেমা নির্মাণ করবো না। আপনি আর আমার অফিসে আসবেন না।’ জাহাঙ্গীর খানের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এই অপমান কাজী হায়াতের মনে খুব লাগলো। সেদিন থেকে সংকল্প করলেন যে গুরু আলমগীর কবিরের মতো শুধু সমালোচক ও পুরস্কারের জন্য সিনেমা নির্মাণ করবেন না, এমন বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন যা দর্শক ও সমালোচক দুই শ্রেণীকেই সন্তুষ্ট করবে আবার পুরস্কারও পাবে। পরবর্তীতে কাজী হায়াৎ তা করে দেখিয়েছিলেন কিন্তু আর কখনো আলমগীর পিকচার্স বা জাহাঙ্গীর খানের প্রযোজনায় রিচালনা করেননি।
এতগুলো কথা বলার কারণ— যে ব্যক্তিটি বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী সময়ে এতো প্রভাব বিস্তার করতেন, যে ব্যক্তির সিনেমা করে অনেকেই হয়েছেন মহাতারকা সেই ব্যক্তিটি চাইলে তখন কত নায়ক-নায়িকাকে অনৈতিক কাজে ব্যবহার করে অঢেল ধন সম্পত্তি গড়তে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন, কিন্তু তিনি কখনো সেই পথে হাঁটেননি। যে পারিবারিক ও শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রে এসেছিলেন তাঁর মর্যাদা তিনি রক্ষা করেছিলেন। কখনো কোন বিনোদন পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনে নায়িকাদের নিয়ে তাঁকে জড়িয়ে কোন নেতিবাচক খবর শুনিনি। কখনও কোন নায়িকার সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ গোপন ছবি দেখিনি। কোন ধরনের মাদক ব্যবসার সাথেও তাঁর জড়িত হওয়ার খবর শুনিনি। চলচ্চিত্র শিল্পে যিনি প্রযোজক থেকে অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন নিজ গুণে।
এ কে এম জাহাঙ্গীর খান ও তার সমসাময়িক প্রযোজকরা ছিলেন এই ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠিত করার পেছনের বড় যোদ্ধা যাদের অবদান আজও এফিডিসির প্রতিটি ইট, কণা ভুলেনি। অথচ আজ এই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে ‘প্রযোজক’ নাম ব্যবহার করে কত প্রতারক, লম্পট আমরা দেখি যারা এই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে করেছে কলংকিত।
১৯৩৯ সালের ২১ এপ্রিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম চিওড়া কাজীবাড়ি মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরো নাম আবুল খায়ের মো. জাহাঙ্গীর খান। মারা যান ২০২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি হলেন ৯০ দশকে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও চিকিৎসক ঝুমু খানের বাবা।