তারেক মাসুদ: ছবির ফেরিওয়ালা
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের সদস্য ছিলাম তখন, অবশ্য কাজ ঐ সিনেমা দেখা অব্দই। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। সালটা ইংরেজির ২০১০ বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। জানতে পারলাম তারেক মাসুদের রানওয়ে মুক্তি পাচ্ছে এবং সেটার প্রিমিয়ার চট্টগ্রামেই । সাধারণত ঢাকার বাহিরে কোন চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ারের কথা শুনিনি, তারেক মাসুদই উদ্যোগটা নিয়েছিলেন প্রথম বারের মত কোন সিনেমার প্রিমিয়ার বন্দর নগরীতে। ১৬ই ডিসেম্বর প্রিমিয়ার হবে। বিজয়ের মাসে বিজয়ের দিনে দেশাত্মবোধক একটি সিনেমা রানওয়ে, সাথে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নরসুন্দর এ ছবিটির প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ। উপস্থিত থাকবেন স্বয়ং তারেক মাসুদ আর সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করিনি সকালে গিয়েই টিকেট কেটে আনি।
ম্যাটিনি শো, বিকেল তিনটা। থিয়েটার ইন্সটিটিউটের সামনে দীর্ঘ লাইন আর টিকেট কাউন্টারের সামনের লাইনের তো শেষটা দেখতে পাইনি। ভাগ্যিস টিকেটটা সকালেই কেটে নিয়েছিলাম। ছবি শুরু হওয়ার আগে মঞ্চে উঠলেন তারেক মাসুদ – ভীষণ সুদর্শন, লম্বা । সামনা সামনি প্রথম দেখলাম তাকে, অত্যন্ত সুন্দর করে কথা বলেন।
প্রায় আধঘণ্টা বক্তব্য দিলেন। প্রথমেই বললেন, ‘আসলে ছবি শুরুর আগে আগে এভাবে বক্তব্য দেওয়াটা ভীষণ বিরক্তিকর তবুও কিছু তো বলতে হয়’। এরপর বলে গেলেন তারেক মাসুদ মাটির ময়নার নির্মাতা তারেক মাসুদ । বললেন রানওয়ের কথা, নরসুন্দরের কথা আর বললেন সিনেমার কথা বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে তার স্বপ্নের কথা।
ছবি শুরু হল, ছবি চলছে, তারেক মাসুদ মাঝে মধ্যেই হল রুমের সিটের মাঝের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটছেন। আমার পাশ দিয়েই হেটে যাচ্ছেন। আমি মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি বেশ বিরক্ত খানিক বাদে চিত্কার করে উঠলেন “আরে সাউন্ডটা ঠিক করো”। কই আমাদের তো কিছু মনে হয়নি সাউন্ড তো মনে হয় ঠিকই ছিল, কিন্তু তাঁর কাছে হয়তো ঠিক ছিলনা। কি রকম খুতঁখুঁতে মানুষ, ছবির প্রজেকশনের ক্ষেত্রে সাউন্ডের ক্ষেত্রে তার শতভাগ পারফেকশন চাই, না হলে তো ছবির কোন ইমপ্যাক্ট ই পরবেনা।
ছবিটি শেষ করে যখন বের হই দেখি মানুষের বিশাল লাইন পরবর্তী শোয়ের জন্য। তারেক মাসুদ লাইন থেকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে আছেন সাথে দুই একজন। অনেকে তার পাশ দিয়ে চলা ফেরা করছে। প্রথমে একটু ভয় করছিল যদি কথা না বলেন, তারপর ভাবলাম যে লোকটা একদিকে মাটির ময়নাকে অস্কারের মত আয়োজনে নিয়ে গেছেন, আবার অন্যদিকে কোনরকম অর্থনৈতিক লাভ লোকসানের কথা চিন্তা না করে বাংলা সিনেমার ফেরি করে বেরিয়েছেন, বাংলাদেশের এক শহর থেকে অন্য শহরে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে মানুষকে শুধুমাত্র ভালো সিনেমা দেখাবেন বলে ছুটে বেরিয়েছেন সে লোকটা আর যাই হোক অহংকারী হবেন না। আমি গেলাম, গিয়ে বললাম – স্যার ছবিটা খুব ভালো হয়েছে। তিনি হাসলেন, হাত মেলালেন এবং ধন্যবাদ দিলেন। আমি তাঁর পরবর্তী ছবির কথা জিজ্ঞেস করলাম। উনি আবারও হাসলেন বললেন ‘নিশ্চয়ই হবে আগে এটা শেষ হোক’।
পরবর্তী ছবিটি তিনি করে যেতে পারেন নি। তার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মানুষটার এখন আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল। এখন যখন বাংলাদেশের সিনেমা একটু একটু করে এগুচ্ছে এ সময়টায় তারেক মাসুদের খুব দরকার ছিল। দেশকে অনেক কিছু দেওয়ার ছিল তাঁর, হয়তো দিতে পারতেন বিশ্ব-চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান, সে গুণ তাঁর ছিল। তিনি বেঁচে আছেন এবং থাকবেন তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার রেখে যাওয়া উত্তরসূরিদের মাধ্যমে ।
তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন,সিনেমা নিয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি একদিন এই স্বপ্ন-বাজ তারেক মাসুদের উত্তরসূরিরা বিশ্ব-চলচ্চিত্রের আসরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে তুলে ধরবে। আজ এই ক্ষণজন্মা গুণী মানুষটির জন্মদিন ছিল, বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর চিরচেনা হাসি মাখা মুখটি দেখতাম পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলে।
শুভ জন্মদিন তারেক মাসুদ।
জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা