Select Page

‘তুফান’ অনেক হিসাব-নিকাষ বদলে দিতে এসেছে

‘তুফান’ অনেক হিসাব-নিকাষ বদলে দিতে এসেছে

একবার নয়, দুইবার নয়, ‘তুফান’-এর সাথে আমার মোলাকাত হয়েছে তিন-তিনবার। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী ৭ দিনে ৩ বার সস্ত্রীক/ সপরিবারে/ সবান্ধব গিয়েছি বছরের সবচাইতে আকাঙ্খিত এই সিনেমা প্রত্যক্ষ করতে। সত্যি বলতে, ঈদের দিন রাতে ‘তুফান’ দেখে আমার ভালো লাগেনি। মনের ভেতর বার বার এই কথাটিই জপেছিলাম: যত গর্জে তত বর্ষে না। সিনেমা সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগতভাবে সেটি জানিয়েছিলাম-ও। ঈদের আগেই কাজিনদের জন্য ঈদের তৃতীয় দিনের সিনেমা দেখার টিকেট কেটে রেখেছিলাম। বাধ্য হয়েই দ্বিতীয়বার অনিচ্ছা নিয়ে বসুন্ধরা সিটি’র ভিআইপি হলে আবারো ‘তুফান’ দেখতে হয়।

হলে গিয়ে লম্বা একটু ঘুম দেবো এই আশাতেই আয়েশ করে গা হেলিয়ে দিয়েছিলাম আরামদায়ক সিটে। তবে, সেদিন ‘তুফান’ আমার দু’চোখের পাতা এক করতে দেয়নি। আমি রীতিমত বিস্মিত হলাম। একটি সিনেমা দেখার সময় প্রজেকশন, সাউন্ড, হলের দর্শকদের নিয়ে পরিবেশ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ-তা আবারো অনুধাবন করলাম। দ্বিতীয়বার ‘তুফান’ আমার মন জয় করে নিলো। শুধু জয় করেছে বললে ভুল হবে, বাংলাদেশের পর্দায় এরকম অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটি বাংলা সিনেমা দেখবো, কস্মিণকালেও আমি ভাবিনি। এরকম প্রিমিয়াম লুক অ্যান্ড ফিলের সিনেমা এর আগে বাংলাদেশে কেন, কলকাতার মূলধারার সিনেমাতেও কখনো দেখিনি। প্রবল আগ্রহ নিয়ে গত ২৩ জুন সহকর্মী, সবান্ধবদের নিয়ে পুনরায় ‘তুফান’ দেখলাম, নতুন করে মুগ্ধ হলাম। সেদিনের পর আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে বাধ্য হচ্ছি: ‘তুফান’-মুক্তির আগে যতটা গর্জে উঠেছিল, তার চেয়েও যেন অনেক গুণ বেশি বরষেছে। যতটা প্রত্যাশা ছিল, তার চেয়ে অনেক কিছু দিয়েছে।

অবাক হয়েছি, হতাশ হয়েছি, যখন দেখেছি অনেক সিনিয়র সাংবাদিক/ লেখক তাদের লেখনীতে সিনেমার পুরো গল্প (শেষের টুইস্ট সহ) তুলে ধরেছেন। পরিচিত বা নাম না জানা অনেকেই এসব দেখে ‘তুফান’-এর রিভিউ লিখতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন এতদিন। তাদের জন্যই মনের ভাবনা তুলে ধরছি:

২ ঘন্টা ২৫ মিনিটের ‘তুফান’কে অনেকে ‘নকল’-এর দায়ে তীরবিদ্ধ করতে চাইলেও আমি তাদের অভিযোগের সঙ্গে একমত নই। কারণ বলিউড, টালিগঞ্জ, হলিউডসহ বিশ্বের অনেক কালজয়ী/জনপ্রিয় সিনেমাতেই নির্মাতারা তাদের প্রিয় সিনেমা/ প্রিয় পরিচালকের সিনেমার কিছু দৃশ্য/ লুক/ সংলাপ/ গানকে ট্রিবিউট বা সম্মান দেখানোর জন্য নিজের মত করে ব্যবহার করেন। ‘তুফান’ দেখতে গিয়েও আমি কেজিএফ/ অ্যানিমেল/ ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বাই/ রাইসসহ অনেক সিনেমার নির্যাস পেয়েছি। এমনকি প্রয়াত নায়ক সোহেল চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড, আজিজ মোহাম্মদ ভাই সংযোগ সহ ’৯০ দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপের আসিফের অনেক বাস্তব ঘটনার সঙ্গেও মিল পেয়েছি। ১৯৯৭ সালে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরামের নামানুসারে সিনেমাতেও আমরা সিআইডির নাম পাই ‘আকরাম’। তবে পর্দা কিংবা পর্দার বাইরে থেকে অনুপ্রেরণা নেয়া সব ‘ফুল’গুলো নিয়ে রায়হান রাফী এমন একটি মালা গেঁথেছেন, যা আমরা মনে রাখবো বছরের পর বছর কিংবা যুগের পর যুগ।

এই সিনেমার নায়ক অনেকে। মহানায়ক দুজন: পরিচালক রায়হান রাফী এবং অবশ্যই শাাকিব খান। পর্যাপ্ত বাজেট পেলে অনেক নির্মাতা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। তবে রায়হান রাফী অসীম সাহসিকতা নিয়ে সব সামলেছেন। ক্যারিয়ারের ৬ষ্ঠ সিনেমায় পরিচালক এতটাই ম্যাচুওরিটির সঙ্গে সবকিছু সমন্বয় করেছেন, তারিফ না করে পারা যায় না। ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে ‘তুফান’ শাকিব খানের ২৫০তম সিনেমা, সেই সঙ্গে প্রধান চরিত্রে ঈদে সিনেমা মুক্তির দিক থেকে ৯৫তম সিনেমা। এত সিনেমার অভিজ্ঞতা যার ঝুলিতে, তিনি যে ক্যারিয়ারের ২৫ বছর পার করেও এভাবে নতুন রূপে দর্শকের সামনে হাজির হবে, কে ভেবেছিল? এক্ষেত্রে রায়হান রাফীকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। পর্দায় শাকিব খান-রায়হান রাফী কেমেস্ট্রি মুগ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করেছি। ভীষণ সাহসী রায়হান রাফী অবলীলায় শাকিব খানের কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করে নিয়েছেন, যা অতীতে অনেকেই পারেননি। আবার ২৫০ সিনেমার নায়কও যে ৬ সিনেমার পরিচালককে বিশ্বাস করে ‘ডিরেক্টর্স অ্যাক্টর’ হয়ে উঠেছিলেন, তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি। শাকিব খান সুদর্শন, আমরা সবাই জানি। তবে ‘তুফান’ সিনেমায় তার দিক থেকে ভক্তরা তো বটেই, কট্টর নিন্দুকেরাও চোখ ফেরাতে পারবে না। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্যি, বলিউডের অ্যানিমেল বা কান্নাড়ার কেজিএফের নায়কদের চেয়ে কোনো অংশে শাকিব খান পিছিয়ে ছিলেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়েই ছিলেন। অ্যাকশন, ইমোশন, রোমান্স-যখন যা প্রয়োজন, শাকিব খান সর্বোচ্চটা ঢেলে দিয়েছেন। ‘তুফান’ চরিত্রে অনেক দৃশ্যে তার সংলাপবিহীন ‘সোয়াগ/ অ্যাটিটিউড’ দেখে যে কেউ বলতে বাধ্য হবেন: ‘ওএমজি’! জগতের সব সুদর্শন অভিনেতা সুঅভিনেতা হতে পারেন না। আবার সব সুঅভিনেতা সুদর্শন হতে পারেন না। নায়ক শাকিব খান ভীষণ সুদর্শন, আবার একই সাথে সুঅভিনেতা। শান্ত যখন কল্পনা করে একদিন নায়কের বেশে সুপারস্টার হয়ে ভক্তদের অটোগ্রাফ দেবে, সে দৃশ্যে বা ধোবিঘাটে অ্যাকশন দৃশ্যে শাকিব খানের লুক দেখে বা ডিল ফাইনাল করার আগে শান্ত’র হেঁটে আসা দেখে আমার আশপাশের অনেক দর্শকই সমস্বরে বলেছেন ‘ওয়াও!’ অবশ্য এরকম ‘ওয়াও’ মুহূর্ত সিনেমাতে ভুঁড়ি-ভুঁড়ি। সব মিলিয়ে ‘তুফান’কে বলা যেতে পারে শাকিব খানের শো-রিল।

বিশেষ কয়েকটি দৃশ্যের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে: জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে সিনেমার নাচের সেট থেকে বের করার দৃশ্যে শান্ত’র এক্সপ্রেশন, অডিশনের দৃশ্য, ধোবিঘাটে অ্যাকশন দৃশ্য, মসজিদে গিয়ে পাড়ার পাবর্তী বৌদির জন্য রক্ত যোগাড়ের ঘোষণা, মহল্লার সবাইকে নিয়ে শান্ত’র ‘শেষ খেলা’ সিনেমা দেখার পর বাড়ি ফিরে ক্ষোভ প্রকাশ, তুফানের এন্ট্রি, কিশোর তুফানের গল্প, সংবিধান নিয়ে তুফানের মনোলোগ, শাহনেওয়াজের মাথা কেটে হত্যা, বাশিরের সঙ্গে কুস্তির দৃশ্য, সিআইডি আকরামের এন্ট্রি, আগুনের মাঝখানে বাথটাবে তুফানের আউটবার্স্ট, অ্যান্ড ক্রেডিটের পরের দৃশ্য-প্রতিটি মুহূর্তই ছিল ‘ফুল অন এন্টারটেইনমেন্ট’। ‘ওয়ান টেইক শট’ যতবার দেখেছি, অপলক দৃষ্টিতে তব্দা খেয়ে ছিলাম। শাকিব খানের রাজকীয় ভঙ্গিতে ওয়ান টেইক শট দেয়ার মুহূর্তটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে তুফানের পিয়ানো বাজিয়ে নিজেকে খোঁজার মুহূর্তটি আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে। বিশেষ করে জালালউদ্দিন গাজী’র গল্প শেষ হবার পর তুফানের এক্সপ্রেশন, পিয়ানো বাজানো এবং গোধূলি লগ্নে নিজেকে খোঁজা-অবিশ্বাস্য সুন্দর সবকিছু।

চিত্রগ্রহণে তাহসিন রহমান চোখ ধাঁধানো নান্দনিকতা দেখিয়েছেন। শিল্প নির্দেশনায় শিহাব নুরুন্নবী ছিলেন সেরা। গর্ব হচ্ছিলো, তারা দুজনই বাংলাদেশি। আলোকসম্পাত, শব্দগ্রহণ, রঙ বিন্যাস, পোশাক পরিকল্পনা, রূপসজ্জা, ভিএফএক্স-প্রতিটি বিভাগই নিজেদের সেরাটুকু তুলে ধরেছেন। সম্পাদনা প্রথমার্ধে আরো ক্ষুরধার হতে পারতো। তবে ‘তুফান’ সিনেমার যে মানুষটির কাজ আমাকে এখনো ঘুমুতে দিচ্ছে না, তিনি আরাফাত মহসিন নিধি। দিন-রাত এখন আমার কানে ‘তুফান’-এর বিজিএম বাজে। অবিশ্বাস্য বিজিএম করেছেন তিনি। ওয়ান টেক শট, কিশোর তুফানের অপারেশন, ১৯৯০ সালে বিরোধী দলের পার্টিতে তুফানের অপারেশন, শেষ সিকোয়েন্স-প্রতিটি দৃশ্যে আরাফাত মহসিন নিধির আবহ সংগীত সিনেমাটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ব্রেভো !!!

সাধারণত প্রেমের সিনেমায় গানের আধিক্য থাকে। ‘তুফান’ অ্যাকশন সিনেমা। অথচ এ সিনেমার প্রায় প্রতিটি গানই নিজেদের জায়গায় সেরা। প্রীতম হাসানের ‘লাগে উরা ধুরা’ তো সবদিক দিয়ে এগিয়ে ছিলই এতদিন, তবে ‘দুষ্টু কোকিল’ আমার নতুন ক্রেজ। এই ক’দিনেই শতবার শোনা হয়ে গিয়েছে। কনার সুরেলা কণ্ঠ এই গানটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। এই গানে মিমি তো বটেই, শাকিব খানের মৃদু স্টেপসগুলোতেও ছিল ‘ওয়াও’ ফ্যাক্টর। ‘তুফান’-এর শিরোনাম গান গল্পে দারুণ এনার্জি দিয়েছে। আরিফ রহমান জয় দুর্দান্ত। তবে দুষ্টু কোকিল (খুনের দৃশ্য বাদে), আসবে আমার দিন এবং আমি ভেসে যাই-গানগুলো সিনেমা মুক্তির আগে প্রচারণা করা প্রয়োজন ছিল। ‘মনপুরা’ বা ‘হাওয়া’ সিনেমার গানগুলো কিন্তু দর্শকদের মুখস্থ করিয়েই তারপর হলে পাঠানো হয়েছিল। বিশেষ করে হাবিব ওয়াহিদের রোমান্টিক গানটি প্রথমবার ‘তুফান’ দেখার সময় কানে লাগেনি। দ্বিতীয়বার ভালো লাগে। তৃতীয়বার খুব ভালো লাগে। একই কথা রেহান রাসূলের ‘আসবে আমার দিন’-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

‘তুফান’-এর অভিনয়শিল্পীরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের চরিত্রে শতভাগ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। শাকিব খান ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ হবার পরও ওপার বাংলার নায়িকা মিমি চক্রবর্তীকে ভীষণ ভালো লেগেছে। সত্যি বলতে, ‘বোঝে না সে বোঝে না’ ছাড়া মিমিকে আর কোনো সিনেমায় অত ভালো লাগেনি। ‘সূচনা’র মত চরিত্রে মিমি যে এত মানিয়ে যাবেন, তার প্রতিটি মোহনীয় এক্সপ্রেশন, কথা বলার ভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস, সর্বোপরি স্ক্রিন  প্রেজেন্স ছিল ম্যাজিকাল। চঞ্চল চৌধুরীকে শাকিব খানের সিনেমায় দেখতে পারাটা কোনো অংশেই ঈদের আনন্দের থেকে কম ছিল না। চঞ্চল চৌধুরী যখন যে চরিত্রই ধারণ করেন, ভুলিয়ে দেন তিনি চঞ্চল চৌধুরী। এখানেও তাই। যদিও ভেবেছিলাম তুফান এবং আকরাম ইঁদুর-বেড়ালের মত একজন অন্যজনের পেছনে তীব্রভাবে ছুটে বেড়াবে। ততটা পাইনি। তবে শাকিব খান-চঞ্চল চৌধুরীকে একসঙ্গে যে ক’টি দৃশ্যে পেয়েছি, রীতিমত পয়সা উসুল। আশা করি, ‘তুফান টু’ তে তুফানের পাশাপাশি সিআইডি আকরাম সমান্তরাল স্পেস পাবে। ‘আয়নাবাজি’তে চঞ্চল চৌধুরীর নায়িকা নাবিলাকে ৮ বছর পর বড় পর্দায় দেখবো, তাও শাকিব খানের বিপরীতে-এই উত্তেজনা দেখার আগে পূর্ণমাত্রায় থাকলেও তিনবার ‘তুফান’ দেখতে গিয়ে প্রতিটিবারই হতাশ হয়েছি। নাবিলাকে দেখতে স্নিগ্ধ লেগেছে, তবে নাবিলার চরিত্রটি ঠিকঠাকভাবে চিত্রনাট্যে দাঁড়ায়নি। বিরতির পর নাবিলা আরো স্পেস পেতে পারতো। ’৯০ দশকে ঢাকাই সিনেমায় কোনো নারী কস্টিউম ডিজাইনার ছিলেন কিনা, জানিনা। তবে ফিকশন হিসেবেও যদি ধরি, ‘জুলি’ চরিত্রের কস্টিউম/ কথা বলার ভঙ্গি (করতেছো ক্যান? / তাকাইয়া আছো ক্যান / হাসতেছে আবার! / তোমাকে বের করে দিছে? / আমি আসলে বুঝতে পারিনাই / বুঝতে পারছি, হইছে কি) – এই সংলাপগুলো কেমন যেন আরোপিত মনে হয়েছে। জুলির ওপর শান্তর প্রেমানুভূতি কখনো দেখিনি। যে কারণে তাদের প্রেমের গল্পটাও জমেনি। হয়তো সে কারণেই বিরতির পর শান্ত’র জীবনে লম্বা সময় ধরে জুলির কোনো অস্তিত্বই দেখা যায়নি। সামনে শুধুমাত্র শাকিব খান-নাবিলা জুটিকে নিয়ে একটা ‘আস্ত’ সিনেমা চাই।  

গাজী রাকায়েতকে ‘তুফান’ সিনেমায় কাস্ট করাটা ছিল পরিচালক রাফীর অন্যতম মাস্টারস্ট্রোক। তিনি ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। মুগ্ধ করেছেন। মিশা সওদাগরকেও রায়হান রাফীর সিনেমায় দেখতে পারাটা ছিল বিশেষ পাওনা। মাত্র ৩-৪টি দৃশ্যে মিশা সওদাগর প্রমাণ করেছেন, তিনি অপ্রতিদ্বন্ধী ‘তুফান’ নায়ক শাকিব খান-খল নায়ক মিশা সওদাগর জুটির ১২৭তম সিনেমা। কুস্তির দৃশ্যে তাদের দ্বৈরথ হাত তালি দেবার মত। ফজলুর রহমান বাবু স্বভাবজাত ভালো অভিনয় করেছেন, তবে তার চরিত্রে ‘বিশেষ’ কিছু পাইনি। অতিথি চরিত্রে সালাহউদ্দিন লাভলু, শহীদুজ্জামান সেলিম, সুমন আনোয়ার, শাহরিয়ার ফেরদৌস সজীব বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। তবে তাদের মতো অভিনেতাদের কাছ থেকে পাঞ্চিং লাইন/ মনে রাখার মত সংলাপ বা আরো স্পেস আশা করেছিলাম। ওপার বাংলার অভিনেতাদের মধ্যে তুফানের কিশোর বেলার চরিত্রে যে ছেলেটি অভিনয় করেছে, দুর্দান্ত। ‘দুষ্টু কোকিল’ গানে মাত্র একটি দৃশ্যে মানব সাচদেভও দৃষ্টি কেড়েছেন। তবে ২/১ জন অভিনেতা বেশ উচ্চকিত অভিনয় করে সুঁড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করেছেন। যদিও তাদের চরিত্রগুলোই ছিল ‘ওভার দ্য টপ’। ঐ দৃশ্যগুলোতে মজার সংলাপের অভাব অনুভব করেছি। 

প্রশ্ন আসতে পারে, আজ প্রশংসা করছি যে সিনেমার, সে সিনেমা প্রথমবার দেখে কেন হতাশ হয়েছিলাম? ‘তুফান’ কি নিখুঁত সিনেমা? অবশ্যই নয়। ‘তুফান’-এও যতটা ‘ফান’ আছে, তার সঙ্গে ‘ফাঁক’-ও আছে। প্রথমবার ‘তুফান’ দেখতে গিয়ে ’৯০ দশকের ঢাকা খুঁজে পাইনি। সম্পূর্ণ কলকাতায় চিত্রায়িত ‘তুফান’-সিনেমায় মূল চরিত্রগুলো বাদে বাকি চরিত্রে ওপার বাংলার অভিনয়শিল্পীরাই অভিনয় করেছেন। পরিচালকের স্বাচ্ছন্দ্যের খাতিরে সেটি হতেই পারে। তবে অনেকের মুখে কলকাতার ভাষায় কথা বলার বিষয়টি কানে লেগেছে খুব। রায়হান রাফীর সিনেমায় আমরা মেহেরপুর, ময়মনসিংহ, নীলাদ্রির মত জায়গাগুলোকে চরিত্র হিসেবে পাই। ‘তুফান’-এ ঢাকাকে পাইনি। ক্ষুরধার সংলাপ পাইনি। ‘না পারছি গিলতে না পারছি উগলাতে’-এভাবে কি আমরা কথা বলি? জুলির কথা: দুনিয়াতে যত আর্টিস্ট, সবাই একসময় ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট ছিল। সত্যি কি তাই? আমাদের শাকিব খানও ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট ছিলেন কখনো? ‘সবসময়’ না বলে ‘অনেকে’ বলা যেত। এই সিনেমায় খুব বেশি সংলাপ নেই, যা আমরা অনেকদিন মনে রাখতে পারবো। যদিও ‘উই আর লুকিং ফর অপরাধীস্’ কিংবা কেজিএফ-এর মত ‘কি চাও তুমি? পুরা দেশ’-এই রেফারেন্সগুলো দারুণ ছিল। চিত্রনাট্য আরো ধারালো হতে পারতো, বিশেষ করে প্রথমার্ধ্বে। কমেডিগুলো আমার ভালো লাগেনি। তথ্যগত কিছু অসঙ্গতিও চোখে পড়েছে। বলা হচ্ছে: তুফানের জন্ম ১৯৬৫ সালে। কিন্তু শাহনেওয়াজকে হত্যার আগে সাল ১৯৭৬ দেখানো হয়। তার মানে ১১ বছর বয়সে তুফান প্রথম খুন করে। অথচ জালালউদ্দিন গাজী পরবর্তীতে বলেন, তুফান প্রথম খুন করে ১৫ বছর বয়সে। গল্পে আরো ডিটেইলিং থাকতে পারতো। যে ‘তুফান’-এর ছবিও তেমনভাবে কারো কাছে নেই, সে ‘তুফান’ কেন চাইছে তার বায়োপিক সিনেমা হোক? শেষ দিকে পত্রিকাওয়ালারা কিভাবে ‘তুফান’-এর এত ছবি পেয়ে যায়? জুলি কি ‘তুফান’ চরিত্র সম্পর্কে জানে? কীভাবে জানে? কোনো কিছুই আমরা জানতে পারিনা। অবশ্য বিনোদনের খাতিরে অনেক কিছুই আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। মাইনাসের চেয়ে প্লাসের পাল্লা ভারী, এতেই আমরা খুশি। হয়তো ‘তুফান ২’-এ অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে।

আমার সহকর্মী-বন্ধুদের অনেকেই প্রথমবার শাকিব খানের সিনেমা দেখতে এবার হলে গিয়েছে এবং তারা প্রত্যেকেই মুগ্ধ হয়েছে। সুতরাং, এটি মানতেই হবে, ‘তুফান’ অনেক হিসাব-নিকাষ বদলে দিতে এসেছে। বাংলা সিনেমার ব্যবসার ইতিহাসকে বদলে দেয়ার জন্য ‘তুফান’-এর মত কয়েকটি মিসাইল দরকার, ইন্ডাস্ট্রি বড় করার জন্য বছরে এরকম কয়েকটি ধামাকা দরকার। পরিচালক রায়হান রাফীকে আবারো ধন্যবাদ, দর্শকদের পালস্ বুঝে ‘তুফান’-এর মত বিনোদনমূলক সিনেমা উপহার দিয়ে নিজেকে এবং ইন্ডাস্ট্রিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। প্রযোজক আলফা আই এবং ‘তুফান’ সিনেমা সংশ্লিষ্ট এসভিএফ, চরকি-সবাইকে ধন্যবাদ আমাদের ঈদের আনন্দ আরো রঙিন করার জন্য।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র সমালোচক ও উপস্থাপক। মাছরাঙা টেলিভিশনে ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য করুন