‘তুফান’ যেন বড় সাইজের হাওয়াই মিঠাই
‘তুফান’ যেমনই হোক, সিনেমাটা দেখতে হবে সেই সিদ্ধান্ত দর্শককে আগেই নিতে বাধ্য করেছে এর টিজার, হাইপ, প্রমোশন সব। এখন দিনশেষে ‘তুফান’ সিনেমা হিসাবে কেমন, সেটাই আসল কথা। প্রতীকি অর্থে আমার কাছে একে দেখতে লেগেছে ‘হাওয়াই মিঠাই’র মত, বড় সাইজ আর টকটকে রঙ হলেও মুখে দিলেই হাওয়া।
গল্প : তুফান নব্বই দশকের ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাংস্টার যে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সব নিয়ন্ত্রণ করছে৷ তবে মাত্রাতিরিক্ত আধিপত্যের কারনে রাজনৈতিক নেতারাই তুফানকে আর চায় না। অন্যদিকে হুবহু একই চেহারার অন্য আরেকজন যার নাম শান্ত কাজ করে সিনেমায় নায়কের পেছনে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসাবে যার স্বপ্ন পর্দার মেইন হিরো হবার। কস্টিউম ডিজাইনার এক মেয়ের ভালবাসা পেয়ে শান্ত লেগে থেকেও ফিল্মের লাইনে হোচট খায়। তুফান আর শান্ত’র কিভাবে দেখা হয়, তুফানের সর্বশেষ পরিণতি কী – সেটা নিয়েই বাকি সিনেমা।
পজিটিভ : সিনেমাটা রায়হান রাফীর চেয়ে বেশি শাকিব খানের। অন্যভাবে বললে রাফী শাকিবকে এক সিনেমায় দুই রোলে দারুনভাবে প্রেজেন্ট করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে শাকিবের অভিনয় স্বত্বার যে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছে, ‘তুফান’ তাতে সেঞ্চুরি হাকানো এক ম্যাচ। শাকিবের এঙ্গার, কামনেস, ইমোশন, পিঞ্চ, রোমান্স দুর্দান্ত! নাবিলা শান্ত ক্যারেক্টারের প্রেমিকা হিসাবে মানানসই তবে খুব ভাইটাল কোন রোল মনে হয় নি। সেই হিসাবে মিমিই ভাল প্রজেকশন পেয়েছে, নাচে গানে অভিনয়ে ভাল করেছে। চঞ্চল এসেছে গল্পের তিনভাগের শেষভাবে, তবে শেষপর্যন্ত তার কমিক টাইমিং আর সাইলেন্ট কিলার চরিত্র আকরাম দর্শককে খুব রিলিফ দিয়েছে। ভাল করেছে গাজী রাকায়েত তবে এক্সপেক্টেশন আরো বেশি ছিল। ফজলুর রহমান বাবু ঠিকঠাক৷ তাহসিনের ক্যামেরা, হাবিবের গান, ওয়ানটেক শট, বিস্ফোরণের দৃশ্য ভাল লেগেছে৷ বিজিএম গা শিউরে ওঠার মত, সাউন্ড ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড লেভেলের। সিনেমার বাজেট বেশি এটা পরতে পরতে বোঝা গেছে, বলতেই হবে। চঞ্চল চৌধুরীর কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। ডায়লগ আর চালবাজিতে তার ক্যারেক্টার রাফীর আগের সিনেমার পুলিশ চরিত্রগুলোর মতই তবে উপভোগ্য। ‘তুফান টু’তে চঞ্চল, যীশুকে কিভাবে আনা হয় সেটা দেখার আগ্রহ আছে। আদনান আদীব খান ‘আয়নাবাজি’র ডায়লগ রাইটার ছিলেন বলে তার অনেক ইন্সপিরেশন ছিল যেগুলো ভাল।
নেগেটিভ : ‘তুফান’র টেকনিক্যালিটি, ডিরেকশন, প্রডাকশন লা জওয়াব তবে সমস্যাটা ‘তুফান’ চরিত্র নিয়েই৷ যাকে বলা হচ্ছে খুব বুদ্ধিমান, চতুর সে অনায়াসে শুধু ফায়ার আর শুট করলো প্রায় পুরো সিনেমা। যে বলছে, ‘মানুষ অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না’ সে একটু পর তুফানের ব্যাকস্টোরি বলতে গিয়ে বলছে তুফান জন্ম নিয়েছে রাক্ষস হয়ে মা কে মেরে। শিশু জন্মের সময় মা মারা গেলে, শিশুটি কি করে রাক্ষস হয় আমার জানা নেই। তুফান থেকে শান্তর লাইফস্টাইলে সময় বেশি দেয়া হয়েছে শুরুতে তাই ফার্স্ট হাফ বোরিং৷ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, ‘তুফান’ বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে নির্মিত এটা শুধুই মুখে বলা। কোন আইকনিক জায়গায় শুট হয় নি, নায়ক সোহান চৌধুরী হত্যা ছাড়া বাস্তবের কোন মাফিয়ার সাথে মিল নেই, কলকাতার অভিনয়শিল্পীদের নেয়ায় এক্সেন্ট থেকে শুরু করে আর্ট ডিজাইন সব বাক্সবন্দি লেগেছে৷ ‘তুফান’ কেজিএফ বা এনিম্যাল না তবে সেগুলোর ইন্সপিরেশন এত বেশি যে চোখে লেগেছে। সিনেমার শেষ কয়েক মিনিট রাফী নিজের জনরায় ফিমেল বিট্রেয়াল আর সিক্যুয়াল ক্লিফ হ্যাঙ্গার দিয়ে শেষ করলেও তৃপ্তি মেটে নি। রাফীর সিনেমা মানেই কাস্টিং দারুন এবং তারা খেলার জায়গা পায়। কিন্তু এখানে শুধু কাস্টিং ভারী করার জন্য মিশা, শহীদুজ্জামান সেলিম, সালাউদ্দিন লাভলু বা সুমন আনোয়ারকে নেয়া এমনটাই মনে হলো। এক্টর আদনান আদীব বা গাউসুল আলম শাওন খুব বোরিং ও তাদের সুড়সুড়ি কমেডি ওয়ার্ক করে নি। সিনেমার সেট ডিজাইন বিশেষ করে শান্তর এলাকার সেট ও মানুষ সব কলকাতার বলে মেকি লেগেছে। গানে ‘লুটপুট গ্যায়া’ থেকে শুরু করে ‘ড্রিমগার্ল’র ‘দিল কা টেলিফোন’ই যেন কানে বেজেছে। রাফী অনেক বেশি অবসেসড ছিল কেইজিএফের যশের প্রতি, যেজন্য দেশী গ্যাংস্টারের কোন ফ্লেভার পাওয়া গেল না।
পরিশেষ : শাকিবিয়ানদের জন্য ‘তুফান’ সাউথ মাসালা লেভেলের আনন্দ দেবে তবে নিউট্রাল দর্শক হয়তো মাত্রাতিরিক্ত ও অযৌক্তিক কিছু ফায়ারিংয়ে বিরক্ত হবেন। শাকিবের এত্ত ভাল পারফরম্যান্স থাকার পরেও ‘তুফান’ দিনশেষে আফসোস আর হতাশার গল্প।
রেটিং : ৭/১০