তুমি ছুঁয়ে দিলে মন –মনে রবে আজীবন …
মন আজ আকাশের মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে উড়ে গাইছে যেন-
আমি তোমাকে আরো কাছে থেকে ,তুমি আমাকে আরো কাছে থেকে…
তবে ভালোবাসা দাও ভালোবাসা নাও…
চোখের সামনে কিশোর ছেলের অস্থির প্রেমের পাগলামী দেখতে একটুও বিরক্ত লাগছেনা। ছেলেটা গাইছে আর মাঝে মাঝে ইশারায় খেলা করছে তার মুচকি মুচকি হাসি, আবির নীলার প্রেমের প্রতিটা মুহূর্ত ক্যামেরা চমৎকার ভাবে ধারন করতে সক্ষম হয়েছে। কিশোর আবিরের চঞ্চলতা, অসহায়তা।কিশোরী নীলার লাজুক হাসি, বাবার সামনে ভীত উপস্থিতি, কথা বলতে না পারা সব কিছুই খুব স্বাভাবিক লেগেছে। ছবির শুরুটা একটা ফ্যাক্টরিকে কেন্দ্র করে, কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই দর্শক বুঝতে পারে –এটা একদম নিরেট প্রেমের গল্প যেখানে আছে নানা রকম ক্লাইমেক্স, রূদ্ধশ্বাস অপেক্ষা।টানা আড়াই ঘন্টা ছবির পরিচালক হল শুদ্ধ দর্শককে এ সি ছাড়াই প্লাস্টিকের আসনে বসিয়ে রাখতে পেরেছেন, এক কথায় শিহাব শাহীন সফল।অন্ততপক্ষে আমি নিজে জীবনেও প্রেমের ছবি শেষ করতে পারিনা। কিন্তু নায়ক আবীরের ভূমিকায় আরেফিন শুভর হঠাত বদলে যাওয়া, আচমকা নীলা অর্থাৎ জাকিয়া বারী মমকে বুকের মাঝে টেনে এনেও আচমকা ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দেওয়া-সব মিলিয়ে প্রশ্ন জেগেছিল – কেন ? এই কেনর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল নানা রকম চরিত্রর সাথে, পরিচিত হলাম অসাধারন কিছু গানের সাথে।
ইউটিউবে প্রথম দেখলাম –তুমি ছুঁয়ে দিলে মনের হাজার হাজার ভিজিটর, শেয়ার ,লাইক। তখন থেকেই অপেক্ষায় ছিলাম, আজ এই ভরা বর্ষায় এক রাশ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সপ্তাহের শেষ দিন বেছে নিলাম, এদিকে বলাকায় মেরামতের কাজ চলছে। কোন এসি কাজ করছেনা, কিংবা তারা ইচ্ছে করেই বন্ধ রেখেছে। এ দেশে ছবির মান যতোই ভালো হোক, হলের মান কবে ভালো হবে তা কেবল বিধাতাই বলতে পারেন। একের পর এক জোড়ায় জোড়ায় দর্শক প্রবেশ করছে, তখনি বুঝে ফেললাম-এই ছবি ব্যবসা সফল না হয়ে পারেনা। সবার স্মার্ট ফোনে তাহসান আর কনার কন্ঠ। খুব ভালো লাগছে-নতুন প্রজন্ম হলে গিয়ে সিনেমা দেখছে। আর দেখবেই বা না কেন, অসাধারন সিনেমাটগ্রাফি পুরো ছবি জুড়ে। আমাদের দেশের সেরা লোকেশন যেন পর্দায় ভেসে বেড়াচ্ছে। ছবির কাহিনী, সংলাপ, চরিত্রায়ন, ক্যামেরার কাজ কোনটাতেই যেন গাফলতি ছিল না। এক নিমিষে বসে শেষ করে দেবার মতন অসাধারন প্রেমের গল্প।
আমি গল্প বলে দেব না, শুধু কিছু বিশেষ জায়গার কথা উল্লেখ করবো। ছবির প্রযোজনায় সারা যাকেরের নাম দেখে প্রথমটায় ভেবেই নিয়েছিলাম কোন একটা মায়ের ভূমিকায় তিনি নিশ্চই আছেন। কিন্তু না, মজার বিষয় হচ্ছে এই ছবিতে নেগেটিভ অথচ প্রেমে দিওয়ানা ড্যানি ভাই ছিলেন ইরেশ যাকের। তার পোষাক, কথার ভঙ্গি এমন ভাবে বদলে ফেলেছেন প্রথমটায় আমি খুব ধাক্কা খেলাম। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না-আসলেই ইরেশ যাকের, এবার বলা যায় –ইরেশ যাকের বাবা মায়ের পরিচয়ের সাথে নিজের জন্যে আলাদা একটি পরিচয় বহন করবেন আজীবন। এই চরিত্র তাকে বাংলা ছবির ইতিহাসে স্মরনীয় করে রাখবে। আর একটা চরিত্র যাকে আমরা হর হামেশাই ভিলেন রূপে দেখে অভ্যস্থ। তিনি আর কেউ নন –আমাদের অতি প্রিয় মিশা সওদাগর। খুব সাধারন নিরীহ দুলাভাইয়ের চরিত্রে তাকে যে দেখতে পাবো কেউ বুঝি আশাই করিনি। তার অনবদ্য সংলাপ আর গোবেচারা টাইপের আচরন সত্যি মুগ্ধ করেছে, হাততালি পড়েছে কয়েকবার।
প্রেমিক নায়ক হিসেবে আরেফিন শুভ অনেক আগেই সফল। এই ছেলেকে দেখলেই যে কোন মেয়ের খুব মায়া হবে। তার হাসি, বাচন ভঙ্গি, কান্না কান্না ভাব সব মিলিয়ে পার্ফেক্ট নির্বাচন আবির চরিত্রে শুভ। আর জাকিয়া বারী মমর অভিনয় নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই দেখে আসছি, যে কোন চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে সে অনেক পারদর্শি। লাজুক ও ভীতু নীলার চরিত্রে জীবনের শ্রেষ্ঠটুকুই দিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। পাশাপাশি আলীরাজ এবং অন্যান্য যারা সব সময় নেগেটিভ চরিত্র করে আসছেন তাদের অভিনয় ছিল গতানুগতিক, কেবল নীলার মায়ের চরিত্র অনেক খানি দূর্বল লেগেছে। আর সুষমার মতো অভিনেত্রীকে অভিনয় করার আরো অনেক জায়গা দেওয়া উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।কারন আবিরের বোন হিসেবে চরিত্রটি খুবি গুরুত্ব বহন করে এবং সুষমা খুবই দক্ষ অভিনেত্রী। হাতীর বাচ্চাটাকে কিন্তু দর্শক খুবি পছন্দ করেছে।
পোষাক ডিজাইন যিনি করেছেন তার রুচির প্রশংসা আমাকে করতেই হবে। কোন দৃশ্যে কি পোশাক যায় এ ব্যাপারে তিনি ভালোই খেয়াল রেখেছেন তা স্পষ্ট। তবে নীলাকে শুরুতে লাল কামিজে একবার দৌঁড়াতে দেখে একদম শেষ বেলায় লাল শাড়ীতে দেখে একিরকম লেগেছে যদিও মেকআপে ভিন্নতা ছিল। বিয়ের শাড়ি লাল হতেই হবে এমন কোন মানে নেই। আর একটা বিষয়, মমর মুখে মেকাপের আধিক্য মাত্রাতিরিক্ত ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। যারা আমরা এই বিষয়টা নিয়ে ভাবি তারা খেয়াল রাখি-যদি চোখে কাজল বা ভ্রু গভীর করে আঁকা হয় তাহলে লিপস্টিক হবে হালকা। আর মমর ঠোঁট এমনিতেই মোটা, বানিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করলেই যে মোটা করে লিপ লাইনার টানতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই। ক্যামেরা ক্লোজ করলে খুব চোখে লাগছিল বিষয়টা। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জাদরেল বাবার ভয়ে মমর বুকের ভেতর আবিরের জন্যে যে আকুতি লুকিয়ে ছিল তা তার অসাধারন অভিনয় গুনে দর্শকের মন ছুঁতে পেরেছে। তবে মম যখন নাচের দৃশ্যে ছিল তখন অযথাই ক্যামেরা উপর থেকে ধরা হয়েছে, এ জন্য তাকে সব সময় বড় গলার কামিজে দেখা যায়। এই জোর করে নারীর শরীর দেখানোর অপ্রাসঙ্গিক চেষ্টা পরিচালকের কর্মদক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ওখানে যদি কোন বিছানার দৃশ্য থাকতো তাহলে কিন্তু চোখে লাগতো না, অযাচিতভাবে জুরে দেওয়া যে কোন কিছুই দর্শকের চোখের আড়াল হয় না।
আবির যখন নীলাকে ফেলে চলে গেল ঢাকার বাসায় তখন তার মধ্যে কোন অপরাধবোধ ছিল না, কিন্তু বাবার দেওয়া ছোট্ট একটা থাপ্পড় তাকে বদলে দিল। এই জায়গাটাতে অনেক তাড়াহুড়ো হয়ে গেছে মনে হলো। এতো বড় অন্যায় করার পর নিজেকে শোধরাতে একটা মানুষের সময় লাগে। যে সময় নিয়ে নীলাকে সে সরি বলেছে তার চাইতে বেশি সময় তার নিজেকে নিয়ে ভাবা দরকার ছিল। পুরো বিষয়টা একটা গানের মাধ্যমে তুলে ধরাতে খুব হালকা হয়ে গেছে ব্যপারটা। তবে শুভর সাবলীল অভিনয়ের কারনে ছোট ছোট বিষয়গুলো অতোটা ধরা পড়েনি।
ছবির শেষে এসে আবির যখন নীলাকে নিয়ে পানিতে লাফ দেয় তখন কিন্তু আমরা ধরেই নিয়েছিলাম – গেল, আর একটা “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে তারা ভেসে ওঠে, এখানেই পরিচালকের কারিশমা। বেশিরভাগ দর্শক ধরেই নিয়েছিল ছবির বুঝি পর্দা নামলো, কিন্তু ছবির শেষে যে এতো ক্লাইমেক্স থাকতে পারে তা আমরা ভাবতেও পারিনি। গতানুগতিক প্রেমের কাহিনী ছাপিয়ে গেছে এই ছবির পান্ডুলিপি। সফল নাট্যকার এবং পরিচালক শিহাব শাহীনকে এজন্য স্পেশাল ধন্যবাদ।
মিশা সওদাগরের একটি সংলাপ ধরেই ইতি টানছি – সব কিছুর একটা ভালো দিক আছে, মন্দ দিকও আছে।
এই ছবির ভালো দিক – দেশের প্রেমিক পুরুষরা আর কোন দিন মনের মানুষকে ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দেবে না।
মন্দ দিক – যে হারে ফেইসবুক প্রেম বাড়ছে, দু’দিন পর পর ছেলে মেয়েরা একে অন্যের হাত ধরে পালিয়ে যাবে।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরন – এই জন্যে কিন্তু পরিচালককে অবশ্যই দায়ী করা যাবে না। প্রেম শাশ্বত, প্রেম সুন্দর। আর বাংলা ছবি এমন স্নিগ্ধ প্রেমের ছোঁয়া যুগে যুগে পাক সেটাই কামনা সকলের।
-রোদেলা নীলা