‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’-খ্যাত গীতিকার কে জি মোস্তফা মারা গেছেন
মারা গেছেন অসামান্য জনপ্রিয় সব গানের গীতিকার কে জি মোস্তফা। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছে ৮৫ বছর।
রবিবার (৮ মে) রাত ৮টার দিকে রাজধানীর নিজ বাসায় অসুস্থবোধ করলে তাকে শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ (রাজধানীর বুকে), ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ (নাচের পুতুল)-এর মতো ক্ল্যাসিক গানের জন্য বাংলা সিনেমায় স্থায়ী আসন লাভ করেছেন কে জি মোস্তফা।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (৯ মে) বাদ জোহর কে জি মুস্তফার মরদেহ জাতীয় প্রেস ক্লাবে নেওয়া হবে। সেখানে তার জানাজা শেষে মরদেহ দাফন করা হবে।
তার লেখা গানের মধ্যে আরও রয়েছে— ওগো লাজুক লতা শুধু এই লগনে, একি চঞ্চলতায় মন ভরেছে, কোকিল যখন হৃদয়টাতে, কোন এক কবিতার সন্ধ্যায়, সম্মুখে আজ না থাকুক, জীবনটা যেন এক নকশী কাঁথা, কে স্মরণের প্রান্তরে, স্মৃতি যেন অতীতের, আগুন লেগেছে চাঁদে, আমার ছোট্ট সাধের ঘরে, আমি এক পড়ে থাকা অচেনা নুপূর, কোথায় গেল হারিয়ে আমার, এখন আমাকে আর ভালো লাগে না, কতবার ওগো জানতে চেয়েছো, কেন ছল করে ডাকো এবং শোন শহরবাসী শোন।
কে জি মোস্তফা সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবেও পরিচিত। ১ জুলাই ১৯৩৭ সালে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে তার জন্ম। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
দৈনিক ইত্তেহাদে ১৯৫৮ সালে শিক্ষানবিশ হিসেবে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। ওই বছরই ‘দৈনিক মজলুম’-এ সহ-সম্পাদক পদে নিয়োগ পান এবং পত্রিকাটির বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত বহাল ছিলেন। এরপর দীর্ঘ বিরতি। ১৯৬৮ সালে সাপ্তাহিক জনতায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা কফিলউদ্দীন চৌধুরীর প্রেস সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ওই সময় পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক প্রথম শ্রেণীর রেডিও সার্ভিসের জন্য মনোনীত হন। মুক্তিযুদ্ধের কারণে চাকরিতে যোগদান থেকে বিরত থাকেন।
স্বাধীনতার পর কে জি মোস্তফা প্রথমে ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’, পরে ‘দৈনিক স্বদেশ’ পত্রিকায় চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ‘দৈনিক জনপদে’ কূটনৈতিক রিপোর্টার ছিলেন। ওই সময় ‘নূপুর’ নামে একটি বিনোদন মাসিকও সম্পাদনা করতেন। ১৯৭৬ সালে বিলুপ্ত সংবাদপত্রের একজন সাংবাদিক হিসেবে কে জি মোস্তফা বিসিএস (তথ্য) ক্যাডারভুক্ত হন এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরে সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। পদোন্নতি পেয়ে প্রথমে সম্পাদক, পরে সিনিয়র সম্পাদক পদে উন্নীত হন। অবসর নেন ১৯৯৬ সালে। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর থেকে প্রকাশিত কিশোর পত্রিকা ‘নবারুণ’, সাহিত্য মাসিক ‘পূর্বাচল’, ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সংবাদ’ এবং সর্বশেষ ‘সচিত্র বাংলাদেশ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দক্ষতা ও কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় কিছুকাল তিনি বাংলাদেশ স্কাউটসের মুখপত্র ‘অগ্রদূত’-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন।
ছাত্রজীবন থেকে কে জি মোস্তফার কবিতা দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়ে আসছে। ১৯৬০ সাল থেকে চলচ্চিত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনে তাঁর লেখা প্রচুর গান প্রচারিত হয়। গীতিকার হিসেবে কে জি মুস্তফার লেখা সিনেমার গানগুলো খুবই জনপ্রিয়। তার গানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদ এবং বাংলাদেশের খ্যাতিমান প্রায় সব শিল্পী কণ্ঠ দিয়েছেন।
এক সময় তিনি নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালনার দিকে ঝুঁকেছিলেন। ‘মায়ার সংসার’, ‘অধিকার’ ও ‘গলি থেকে রাজপথ’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে— কাব্যগ্রন্থ; কাছে থাকো ছুঁয়ে থাকো, উড়ন্ত রুমাল, চক্ষুহীন প্রজাপতি, সাতনরী প্রাণ, আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন, এক মুঠো ভালোবাসা, প্রেম শোনে না মানা। গদ্যগ্রন্থ; কোথায় চলেছি আমি (সরস আত্মকাহিনী)। ছড়ার বই; শিশু তুমি যিশু, কন্যা তুমি অনন্যা, মজার ছড়া শিশুর পড়া।
কুমিল্লা অলক্ত সাহিত্যসংসদ, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ললিতকলা বিভাগের ‘সফেন’, ‘সৃজনী’ সংগীত গোষ্ঠী, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, বাংলাদেশ স্কাউটস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডাকসু’সহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে সম্মাননা, সংবর্ধনা ও পদক পেয়েছেন কে জি মোস্তফা।