দক্ষিণ ভারতীয় ধাঁচের সিনেমা নিয়ে ভোলবদল, কী বলছেন দীপংকর দীপন?
দক্ষিণ ভারতের অনুকরণের সিনেমা নির্মাণের বিপরীতে কথা বলে হঠাৎই তোপের মুখে পড়লেন দীপংকর দীপন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার পোস্টের জবাবে অনেকেই বলে উঠেন অতীতে তিনি এ ধাঁচের সিনেমার প্রশংসা করেছেন। খোদ ‘পুষ্পা’ নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন।
গত ৩০ মার্চ এক পোস্টে দীপংকর দীপন বলেন, “সিনেমায় যে ধরনের প্রধান চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করছেন, সে ধরনের চরিত্রের কারো সাথে আপনার মেয়ে বা বোন প্রেম করছে জানলে মেনে নিতে পারবেন? না পারলে আপনার মানসিক অবস্থানটা কি আসলে? হাতির দাঁতের মতো, দেখানোর এক আর খাওয়ার আরেক বলে মনে করেন? সত্যি কি ভাবেন সিনেমা আসল জীবনে কোন প্রভাব রাখে না। নাকি বাণিজ্যের কারণি নিজেকে ভুলিয়ে রাখছেন? কোনটা? আর যদি পুষ্পা আর রকি ভাইয়ের সাথে মেয়ে বা বোনের বিয়ে দিতে আপত্তি না থাকে, তাহলে আপনি অন্য লেভেলের জিনিস বস, মাফও চাই, দোয়াও চাই।”
এর আগের দিন এম রাহিম পরিচালিত ‘জংলি’ সিনেমার ফার্স্টলুক প্রকাশ পায়। সিয়াম আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে পোস্টারটি প্রকাশ হয়। সেই পোস্টার অনেকে পছন্দ করলেও দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার অনুকরণ বলে প্রশ্ন উঠে। ঠিক তার পরদিন স্ট্যাটাস দেন দীপংকর দীপন।
বিষয়টি নিয়ে অনেকেই বলেন, অতীতে পুষ্পা বা দাবাংয়ের মতো পুরুষালী সিনেমার প্রশংসা করলেও এখন ভোল বদল করেছেন দীপন। এ সময় তার দুটো পুরোনো পোস্ট ভাইরালও হয়।
গত বছরের ১৯ এপ্রিল সাইফ চন্দনের ‘লোকাল’ ছবি তিনি লেখেন, “খেলা হবে, সাব্বাশ সাইফ চন্দন দাদু… তুমি কিন্তু একটার পর একটা বোমা মারছো, ‘দাবাং’ মনে আছে। ‘দাবাং-১’কে বলা হয় প্রপার ইন্ডিয়ান মেইনট্রিম মুভির ভালো উদাহরণ, তার অনেক পরে ‘পুস্পা’- সেই সাব কন্টিনেন্টের মাসালা সিনেমার একটা স্ট্যান্ডার্ড। বলছি না ‘দাবাং’ বা ‘পুষ্পা’ হচ্ছে- তবে মাসালা মুভির আসল মজাটা ‘লোকালে’ আছে বলেই মনে হচ্ছে।”
একই পোস্টে দর্শকদের উদ্দেশে দীপন বলেন, ‘দর্শকদের বলি সিনেমায় বৈচিত্রকে উপভোগ করুন – নানা রকমের সিনেমা নানা স্বাদের- প্লেটে নানা স্বাদের খাবার হলেই না খাবারটা জমে। টক ঝাল মিষ্টি নানা রকমের আইটেম থাকে। যত রকমের স্বাদ তত বৈচিত্রের মজা। মিষ্টি দিয়ে শুরু করে ঝাল পার হয়ে টক দিয়ে শেষ। আবার শেষে মিষ্টি। সিনেমার বাজারটা ওরকম। নানা স্বাদের খাবার হোক সেটাই ভালো, শুধু পচে না গেলেই হয়।
খাবার ভালো হলে, নানা স্বাদই তো খাবারের জান। যে স্বাদই হোক, খাবারটা ভালো হতে হয়। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ঠিক সেরকম। বৈচিত্রকে উপভোগ করতে পারলে জীবনটা আপনার রঙীন হয়ে যাবে। জীবনকেও আপনি উপভোগ করতে শিখে যাবেন।”
এছাড়া ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি দীপংকর দীপন ‘পুষ্পা’র গান শেয়ার করে লেখেন, “‘পুষ্পা’ ম্যাজিকের মতো কাজ করছে ভারতে। ওমিক্রনের মধ্যেও ‘পুষ্পা’র জয়জয়কার থামছে না, বক্স অফিস তাই বলছে। সেই ম্যাজিকটা কোথায়। এই গানটা মধ্যে সেই ম্যাজিকটা পাওয়া যায়। বিশেষ করে আল্লুর প্রথম ডান্স স্টেপে স্যান্ডেল খুলে যাওয়া আবার গানের মধ্যেই সেটা পড়ে পরের স্টেপ দেয়া- এবং স্যান্ডেল খুলে যাবার বিষয়টাকেই স্টাইল করে তোলার মধ্যে ‘পুষ্পা’র ম্যাজিক আছে। অনেস্টি এবং সাউথ স্টাইলের পারফেক্ট ব্লেন্ডিং ‘পুষ্পা’। সাথে অদুৎ বিউটি- সব এলিমেন্টের ছোঁয়া এই গানে পাওয়া যায়।”
অবশ্য সাম্প্রতিক বিতর্কের পর দীপংকর দীপন গতকাল সোমবার (১ এপ্রিল) ‘জনতুষ্টির ভয়ানক প্রবণতা’ শিরোনামের বেশ একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে বলেন, সংখ্যাগরিষ্টদের তুষ্টি করতে চাওয়ার এ প্রবণতা বিপজ্জনক।
দীপংকর দীপন বলেন, “লাইক ভিউয়ের কারণে এবং কমেন্টস এ জনরোষের পড়ার ভয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠকে খুশি করে কথা বলার যে প্রবণতা প্রকট হয়েছে, তাতে ভুলগুলোই শুধু প্রতিষ্ঠিত হবে, কাজের কিছুই হবে না। এটা ভীষণ ক্ষতিকর। এ বিষয়ে চন্দ্রিলের একটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ । তিনি বলেছেন- ভারত পাকিস্তান ইস্যুতে ভারতের জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে বললে- তারা কালকেই যুদ্ধ লাগিয়ে দেবেন। দর্শককে ক্রিকেটের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ ঠিক করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বললে- তারা প্রতি খেলায় নিজের দলের প্রিয় খেলোয়াড়কে নির্বাচিত করতো। জনগণ যে ঠিক যে করে না- তা নয়- তবে সেটিও তারা ভালোবাসা থেকেই করে- সার্বিক বিচার করে নয়।
তার কথাটি খুব গভীর। জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় আবেগ ও ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে – আর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিশেষজ্ঞকে ডাকে। তিনি সবদিক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন। কর্তৃপক্ষও ভুল করে, সেটা যে সিদ্ধান্ত নেয়, তার সমস্যা, তার উপর আরোপ করা রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতির সমস্যা নয়। জনগণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়েও মাঝে মাঝে অথরিটিকে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাতে জনরোষ বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে দেখা যায় সেটিও ভাল। উদাহরণ দিয়ে বলছি- প্লেন যখন মিস করার উপক্রম হয়- তখন সবার কাছে মনে এয়ারপোর্টের সিকিউরি অহেতুক বাড়াবাড়ি- তার যেহেতু সময় নেই- তাকে একটু ছাড় দেয়া যেতেই পারে- সে এটা ভাবে একজন সন্ত্রাসীও এই ছাড় গলে ক্ষতিকর পদার্থ নিয়ে প্লেনে ঢুকে সবার জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারে।
জনতুষ্টি নিয়ে সবচেয়ে সংকটে থাকা যাদের ভিউয়ের উপর ভিত্তি করে পেশা চালাতে হয়। তারা অনেক সময় নিজেদের বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে জনতুষ্টি মাথায় রেখে কনটেন্ট ডিজাইন করতে হয়, এটি যেহেতু তিনি প্রকাশ করতে চান না, তখন তিনি তার যাবতীয় মেধাকে কাছে লাগান সেই কনটেন্টকে যৌক্তিক করবার জন্য। সহজ কথায় খুব সৃজনশীল ভন্ডামো করেন। তিনি জেনেশুনে আতেলীয় স্ববিরোধীরা করেন- যা কোনদিন মানেন না। এতে জনতা আরো বিভ্রান্ত হয়- ভাবে- আরে উনিও আমার ভাবনাকে ঠিক বলছেন এবং নিজেদের ভুলের প্রতি আরো বেশি বিশ্বাসী হন।
এই জনতা আবার কখনো কখনো সবার বিরুদ্ধে গিয়ে খুব ঠিক কথাও বলে ফেলে- বড় কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, ভীষণ বড় কোন অর্জন করে ফেলে। এই জনতার ফলেই আমরা বাংলাদেশটা পেয়েছি। আবার এই জনগণই চোরকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। জনগণ ঠিক করে আবার ভুলও করে। তবে দুটোই ভালবাসা ও তীব্র অনুভূতি থেকে করে। আগেও করতো- কিন্তু সমাজের শিক্ষক ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা থামিয়ে দিতেন। সেটা এখন বন্ধ হয়ে যেগেছে – সার্বিক সিদ্ধান্ত ভুল দিকে যাচ্ছে বোঝার পরেও সেই বিষয়ে পড়াশোনা করা মানুষযে জনরোষের ভয়ে জনগণের মতের স্রোতের বিরুদ্ধে কথা বলা থামিয়ে দিয়েছে- সেটা খুব মারাত্বক সমস্যা। জনতাই আবার এই প্রবণতাকে বন্ধ করতে পারেন। নীরব জনতারা কথা বলতে শুরু করলে, বিষয়টা বদলে যাবে।
আপাত দৃষ্টিতে এই সমস্যার হাত থেকে মুক্তি আছে বলে মনে হয় না, যতক্ষণ না আমরা নীরব জনতারা স্রোতের বিপরীতে কথা বলার সাহস সঞ্চয় করতে পারবো। অন্যেরা বললে তার পাশে দাঁড়াতে শিখবো, জনপ্রিয়তা কমে যাবার ভয় করবো না বা অজনপ্রিয় হবার সাহস অর্জন করতে পারবো।”
‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর বড়পর্দায় অভিষেক হয় দীপংকর দীপনের। সিনেমাটি ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। এর পরের ‘অপারেশন সুন্দরবন’ বা ‘অন্তর্জাল’ সেই উচ্চতায় যেতে পারেনি। তিনটি ছবির সঙ্গেই যুক্ত ছিল সরকারি সংস্থা। এবার নির্মাণ করছেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত নারীদের নিয়ে সিনেমা ‘ছাত্রী সংঘ’।