‘দামাল’ এখন পর্যন্ত রাফীর শ্রেষ্ঠ সিনেমা
‘পরান’ আমার ভালো লেগেছিল। আক্ষেপের কিছু জায়গা থাকলেও ‘পরান’ যে পরিচালক রায়হান রাফীর সেরা কাজ, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ-ই ছিল না। সেই পরিচালক যখন গত কিছুদিন ধরে বলছিলেন, ‘দামাল’ তার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সিনেমা, ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে এই সিনেমা’-এসব শুনে অস্ফুটস্বরে বলেছি, ‘বেশি বেশি! নিজের ঢোল নিজে কেউ এত পেটায়?’ তবে আজ টিকেট কেটে সপরিবারে ‘দামাল’ দেখার পর আমার যে উপলব্ধি, তা হলো: পরিচালক রায়হান রাফীর এবার চুপ করে বসে থাকলেই হবে। কারণ এখন ‘দামাল’ টিমের হয়ে ঢোল বাজাবে দর্শক।
আমার মত দর্শক। যারা বাংলাদেশের সিনেমায় এমন কিছু দেখতে চায়, যা আগে দেখা যায়নি। এমন কিছু অনুভব করতে চায়, যা তাদের শেকড়ের কথা বলে, অস্তিত্বের কথা বলে। এমন কিছু সারাজীবন বয়ে বেড়াতে চায়, যা তাদের বিনোদিত করবে, সেই সাথে আলোড়িত করবে। ‘দামাল’ সেই অংকে অবশ্যই রায়হান রাফীর এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ সিনেমা। সিনেমা দেখা শেষ করে আমার ঘোলা চোখে আশেপাশে বসে থাকা অনেককেই আমি অশ্রুসিক্ত হতে দেখেছি। এই চোখের পানি দেশের জন্য। এই চোখের পানি বাংলা সিনেমায় এমন নবজাগরণের জন্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, ফুটবল বা অন্য কোনো খেলা নিয়ে বাংলাদেশের সিনেমায় মানের দিকে আপস না করে এত গতিশীল কাজ এর আগে আমি দেখিনি। ‘দামাল’ টিমকে এজন্য টুপি খোলা অভিনন্দন। প্রযোজক ইমপ্রেস টেলিফিল্মকে এ ধরনের সিনেমাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য ধন্যবাদ।
সত্যি বলতে, ‘দেবী’ এবং ‘হাওয়া’র পর কোনো সিনেমার প্রচার-প্রচারণা আমাকে তুষ্ট করতে পারেনি। তবে ‘দামাল’ টিম রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সিনেমা মুক্তির আগে তাদের অ্যাগ্রেসিভ প্রমোশনের জন্য। সেটাই ভয় ছিল। ‘দামাল’ পারবে তো ‘পরাণ’-এর জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে যেতে? প্রচারণায় তাক লাগিয়ে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণ করতে? উত্তর: ‘দামাল’ পেরেছে। সফলতার সাথে পেরেছে। সিনেমার অনেক দৃশ্যে আমার গুজবাম্প হয়েছে, আবেগী হয়েছি, অজান্তেই হাত তালি দিয়েছি, শিস বাজিয়েছি।
সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণায় একটি সিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ সাজানো বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। যা ‘দামাল’ করে দেখেেিয়ছে। মেইনস্ট্রিম দর্শকদের হাত তালি দেয়ার অনেক দৃশ্য বা সংলাপ রয়েছে সিনেমায়। যদিও দৈর্ঘ্য আরো ১০ মিনিট চাইলেই কমিয়ে নেয়া যেত। ‘মন পোষ মানে না’ গানটি না থাকলে বা আরো কিছু সাবপ্লট না থাকলে গল্পে এমন কোনো ক্ষতি হতো না। তবে ছবির রংবিন্যাস, চিত্রগ্রহণ, আবহসংগীত, সাউন্ড, শিল্প নির্দেশনা, কস্টিউম, মেকআপ-প্রতিটি বিভাগই দুর্দান্ত। সুমন সরকারের চিত্রগ্রহণ সবসময়ই পছন্দ করি। এবার তিনি আরেকবার মুগ্ধ করলেন। গানের মধ্যে: ‘ঘুরঘুর পোকা’ গানটির আরো বেশি প্রচারণা হলে হয়তো আরেকটি ‘সাদা সাদা কালা কালা’ হতে পারতো। পর্দায় গানটি দেখতে দারুণ লেগেছে। সিনেমার শেষে প্রচারণার জন্য নির্মিত ‘দামাল’ টাইটেল গানটি দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। মনের তৃষ্ণা মিটেছে।
‘দামাল’ সিনেমায় কে সবচাইতে ভালো অভিনয় করেছে? এর উত্তর আমার জানা নেই। প্রত্যেক অভিনেতাই দরদ দিয়ে কাজ করেছেন। পরিচালকের স্বপ্নকে স্পর্শ করতে পেরেছেন। পরিচালক রাফীও একটি মাত্র দৃশ্যের অভিনেতাদের থেকেও সেরা কাজটি আদায় করে নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, ছোট-বড় প্রায় প্রতিটি চরিত্রের সঠিক চরিত্রায়ণ হয়েছে এ সিনেমায়।
সিয়াম আহমেদকে আমি ‘দুর্জয়’ চরিত্রে যতবার দেখছিলাম, ততবার বলছিলাম, ‘বাহ!’ আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয় তারকারা অনসাম্বল কাস্টের সিনেমায় খুব একটা অভিনয় করেন না বা করার সাহস পান না। সিয়াম ‘পাপ পুন্য’ সিনেমায় চঞ্চল চৌধুরীর মত জায়েন্টের সামনেও সাবলীল অভিনয় করেছেন, ‘মৃধা বনাম মৃধা’ সিনেমায়ও লেজেন্ড তারিক আনাম খানের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন, ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমায়ও সমসাময়িক নায়কদের সাথে অভিনয় করেছেন, এবার ‘দামাল’ সিনেমায়ও অসংখ্য অভিনেতার ভিড়ের মধ্যে নিজের জায়গাটা বের করে এনেছেন। শরীফুল রাজের সাথে তার দৃশ্যগুলোতে দুজনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়নি, বরং শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে দুজনের জন্য। ‘দুর্জয়’ চরিত্রটি সিয়ামের ক্যারিয়ারে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শরীফুল রাজ আবারো চমকে দিয়েছে আমাদের সবাইকে। আইসক্রীমের ‘নাদিম’-ই যে ‘ন ডরাই’-এর ‘সোহেল’ আমি ভুলে গিয়েছিলাম। ঠিক সেভাবে ‘ন ডরাই’-এর সোহেলই যে ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’র ‘আবির’ কিংবা ‘গুণিন’-এর ‘রমিজ’, ‘পরাণ’-এর রোমান, ‘হাওয়া’র ‘ইব্রাহিম’-আমি মেলাতে পারিনি। প্রতিটি সিনেমায় রাজ ভুলিয়ে দেন তিনি রাজ। চরিত্রের সাথে মিলেমিশে একাকার। এ সিনেমায় রাজের গোল করার দৃশ্যে হলের সব দর্শক একসাথে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়েছেন। আমিও ছিলাম সে দলে। রাজের জয়যাত্রা এভাবেই চলতে থাকুক।
মুক্তিযোদ্ধা বা ফুটবলারদের পাশে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’-এর সিনেমায় কোনো নারী চরিত্র জ্বলে ওঠার কথা না। তবে বিদ্যা সিনহা মীম ‘হাসনা’ চরিত্র দিয়ে আরেকবার মুগ্ধ করলেন আমাদের। দুদিন আগেও কেউ ভাবতে পারতাম না, মীম কোনো সিনেমায় কাউকে কুপিয়ে মেরে ফেলবেন। এখন মীম চরিত্রের প্রতি শতভাগ বিশ্বস্ত, সাবলীল, শক্তিশালী। ‘দামাল’ সিনেমায় গল্প যতই এগিয়েছে, মীমও নিজের আলোটুকুু একটু একটু করে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। অভিনন্দন মীমকে।
অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে সুমিত সেনগুপ্ত কম সুযোগ পেলেও চোখ দিয়ে অভিনয় করেছেন। সুমিতের প্রতিভার ঝলক আরো দেখতে চাই পর্দায়। রাশেদ মামুন অপু আবারো মুগ্ধ করেছেন। বিশেষ করে তার অভিনীত শেষ দৃশ্যে দর্শক হেসেছে, গালি দিয়েছে। পাশ থেকে একজন দর্শককে বলতে শুনেছি, ‘এই লোকটাকে দেখতে ইচ্ছা করেনা। সিনেমায় সবসময় ঝামেলা পাকায়’। এই মন্তব্যটিই রাশেদ মামুন অপুর সবচেয়ে বড় জয়।
একে আজাদ সেতু সিয়ামের সাথে প্রথম পরিচয়ের দৃশ্যে ভীষণ শক্তিশালী। ফরহাদ লিমন, টাইগার রবি, সাঈদ বাবু, প্রয়াত কায়েস চৌধুরী, মিলি বাশার, শাহনাজ সুমি, সমু চৌধুরী, আহসান হাবিব নাসিম এবং সামিয়া অথৈ-বৃষ্টি-পূজা; প্রত্যেকেই নিজেদের চরিত্রে সৎ ছিলেন। বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। ইন্তেখাব দিনার যে মাপের অভিনেতা, তার কাছ থেকে প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। তার কাছ থেকে আরেকটু বেশি কিছু পেলে মন্দ হতো না।
খালি চোখটা আরেকটু বিস্তৃত করলে অবশ্য আরো কিছু আক্ষেপ বা সমালোচনার জায়গা চিহ্নিত করা যাবে। তবে সেই পান্ডিত্য এখানে জাহির না করে নির্মাতাকেই সেসব বলতে চাই। আপাতত: সবাই দলে বলে ‘দামাল’ দেখে নিতে পারেন। কারণ ‘পরান’, ‘হাওয়া’র পর ‘দামাল’ হতে পারে আরেকটি ঝড়। দেশে তো বটেই, বিদেশে থাকা বাংলাদেশি দর্শকরা এ সিনেমা দেখে আবেগে ভাসবেন, দেশকে মিস করবেন-নিশ্চিত করে বলা যায়। পরিচালক রায়হান রাফীর কাছ থেকে প্রত্যাশা বেড়ে গেল।
‘দামাল’ টিম: Take a bow !!!