Select Page

বাংলা চলচ্চিত্রে সাইকোপ্যাথ: পর্ব-২

বাংলা চলচ্চিত্রে সাইকোপ্যাথ: পর্ব-২

সাইকোপ্যাথ (Psychopath) একটি মানসিক অসুস্থতা যা মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় ‘Personality disorder’ নামে পরিচিত। এ ধরনের রোগ নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই হতে পারে।

সারা দুনিয়াতে বিশেষ করে হলিউড ও কোরিয়ান মুভিতে সাইকোপ্যাথদের নিয়ে বহু প্রশংসনীয় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তবে সে অনুপাতে উপমহাদেশে এই ঘরানার কাজ নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা খুব কম-ই হয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু উল্লেখযোগ্য সাইকোপ্যাথ চরিত্র নিয়ে একটি লেখা সাজিয়েছিলাম।

বাংলা চলচ্চিত্রে সাইকোপ্যাথ: পর্ব-১

আজ থাকছে এরকম আরো কিছু সাইকোপ্যাথ চরিত্র। লেখাটি সাজাতে সাহায্য করেছেন ‘হিমু সিনেমাখোর’ খ্যাত হিমেল হিমু ভাই। তার প্রতি রইলো আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

১. সোহেল – জহিরুদ্দীন পিয়ার, বিশ্বনেত্রী (১৯৯৬)

ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব নিয়ে পরিচালক বাদল খন্দকার ১৯৯৬ সালে নির্মাণ করেন সামাজিক এ্যাকশন ঘরানার ছবি ‘বিশ্বনেত্রী’; যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন শাবানা, জসিম, আমিন খান, শাহনাজ, হুমায়ুন ফরিদীসহ অনেকে। এ ছবিতে ছোট একটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করে জহিরুদ্দীন পিয়ার দর্শক-সমালোচকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। যেখানে তিনি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকা শাবানার ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। বিপথে গিয়ে তিনি একসময় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, এরপর কলেজপড়ুয়া একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে পরবর্তীতে তিনি নিজ বোন ও উক্ত মেয়ের প্রেমিককে হত্যা করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।

পবিত্র ঈদে মুক্তি পাওয়া ছবিটি ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করে।

২. সোহেল চৌধুরী – হুমায়ুন ফরীদি, রাঙা বউ (১৯৯৮)

১৯৯৬ সালে মুক্তি পাওয়া হিন্দি ছবি ‘Agni Sakshi’ এর অনুকরণে আমাদের দেশে নির্মিত হয় রোম্যান্টিক-থ্রিলার ঘরানার ছবি ‘রাঙা বউ’; কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন ভারতীয় অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, হুমায়ুন ফরীদি, আমিন খানসহ অনেকে। দুটি ছবিই ১৯৯১ সালে মুক্তি পাওয়া আমেরিকান সাইকো-থ্রিলার চলচ্চিত্র ‘Sleeping with the Enemy’ এর অনুকরণে নির্মিত।

‘রাঙা বউ’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে এক অত্যাচারী জমিদারপুত্রকে দেখতে পাওয়া যায়, যারা বংশপরম্পরায় প্রজাদের প্রতি শোষণ-নিপীড়ন চালিয়েছে। পূর্বপুরুষের রক্ত তার শরীরে প্রবাহিত হওয়ায় তিনি এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তিনি গরিব ঘরের এক সুন্দরী মেয়েকে জোরপূর্বক বিয়ে করে নিজের বাড়ীতে রাখেন, সেখানে তিনি তাকে যেমন গায়ের জোরে মারধর করেন ঠিক তেমনি তাকে ভালোবাসেন। এভাবে তিনি তার মনের সকল চাওয়া-পাওয়া তার ‘রাঙা বউ’-এর মাধ্যমে পুরণ করে থাকেন।

জমিদারপুত্রের চরিত্রে এ ছবিতে অভিনয় করেন হুমায়ুন ফরিদী। মোহাম্মদ হোসেন পরিচালিত এছবিটি অশ্লীলতা, পর্ণগ্রাফির কাটপিস এবং সরাসরি রগরগে দৃশ্য দেখানোর জন্য সে সময় ব্যাপক সমালোচিত হয়। ছবিটি প্রদর্শন পরবর্তীতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যদিও ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করেছিল।

৩. বাদশাহ – মান্না, আম্মাজান (১৯৯৯)

এক সরকারী কর্মকর্তার ছেলে বাদশাহ তার ছোটবেলায় বাবাকে হারালে, পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনাক্রমে তার চোখের সামনে তার মা ধর্ষিত হন। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনা দেখার পর থেকে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

মায়ের প্রতি তার প্রবল ভালোবাসা এবং মাকে খুশি রাখার ইচ্ছায় যেমন মন দিয়ে ভালো কাজ করে, ঠিক তেমনি মায়ের কষ্ট লাঘব করতে কোনো খারাপ কাজ করতে দ্বিধা করে না। এমন এক গল্প নিয়ে জনপ্রিয় নির্মাতা কাজী হায়াৎ ১৯৯৯ সালে নির্মাণ করেন অ্যাকশন-ড্রামা ঘরানার ছবি ‘আম্মাজান’। যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন মান্না; সাথে অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন শবনম, মৌসুমী, আমিন খান, ডিপজল সহ আরো অনেকে।

বাদশাহ চরিত্রে অভিনয় করা মান্নার পারফরম্যান্স দারুণভাবে প্রশংসিত ও আলোচিত হয়, এখনো ছবিটি সমানভাবে জনপ্রিয়। ছবিটি সেসময় ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করেছিল।

৪. আকরাম – ডিপজল, কঠিন সীমার (২০০৩)

এক সৎ পুলিশ অফিসারের ছেলে লিউকেমিয়া রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য তার bone marrow এর প্রয়োজন হয়। অসুবিধা হলো রক্তের গ্রুপ ও-নেগেটিভ এবং অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও কোনোভাবেই কম সময়ের মধ্যে এই গ্রুপের bone marrow খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরবর্তীতে একাধিক খুন করে জেলবন্দী থাকা এক আসামীর সাথে রক্তের গ্রুপ মিলে গেলে পুলিশ অফিসার এটি নিতে অস্বীকার জানায়, কারণ তিনি নিজেই এই দূর্ধর্ষ সিরিয়াল কিলারকে গ্রেফতার করেছিল, তাই স্বভাবতই খুনি চাইবে ব্যক্তিগত জেদ ধরে তার পরিবারের ক্ষতি করতে।

কিন্তু কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে অবশেষে অফিসার সেই আসামীর শরণাপন্ন হন এবং সেই কুখ্যাত আসামী ছলে-কৌশলে এই সুযোগ কাজে লাগান। এমন এক উত্তেজনাকর গল্প নিয়ে পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর নির্মাণ করেন এ্যাকশন-থ্রিলার ঘরানার ছবি ‘কঠিন সীমার’, যেখানে উক্ত আসামীর চরিত্রে অভিনয় করেন ডিপজল। এছাড়া কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন মান্না, পপি, অমিত হাসান, ময়ুরী, আহমেদ শরীফ সহ আরো অনেকে।

এটি ২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া হিন্দি ছবি ‘Jung’ এর অনুকরণে নির্মিত। তবে মূল হিন্দি ছবিটিও মৌলিক নয়, এটি ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া আমেরিকান ছবি ‘Desperate Measures’ এর অনুকরণে নির্মিত। ‘কঠিন সীমার’ ছবিটি মুক্তির পর মোটামুটি ব্যবসায়িক সফলতা পেলেও দূর্বল নির্মাণ ও দূর্বল অভিনয়ের জন্য সমালোচিত হয়, ডিপজল দারুণ এই চরিত্রটি আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হন।

৫. রানা – বাপ্পারাজ, মিসড্ কল (২০১৭)

এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বিপদে পড়া মানুষদের সহায়তার জন্য একটি বিশেষ ধরনের অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেন, যার মাধ্যমে কেউ তার ফোন নম্বরে মিসড্ কল দিলে সে উক্ত ফোনের GPS ব্যবহার করে ফোনের লোকেশন বের করে ফেলতে পারবে৷ এমন এক ইন্টারেস্টিং গল্প নিয়ে পরিচালক সাফি উদ্দিন সাফি নির্মাণ করেন রোম্যান্টিক-অ্যাকশন ঘরানার চলচ্চিত্র মিসড্ কল; যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন বাপ্পী, মুগ্ধতা, তামান্না, বাপ্পারাজ, মিশা সওদাগর, কাজী হায়াৎ-সহ অনেকে।

বাপ্পারাজ এক মানসিক বিকারগ্রস্ত ইয়াবা চোরাচালানকারীর চরিত্রে অভিনয় করেন, যিনি ‘পাগল’ নামক শব্দটি শুনলে নরপশুর মতো আচরণ শুরু করে দেন। ঘটনাক্রমে জানা যায়, এর আগে তার পিতা এবং তার দাদারও এই রোগ ছিল। ২০১৭ সালের ৩ মার্চ মুক্তি পাওয়া এছবিটি দর্শকমহলে আলোচনা তুলতে ব্যর্থ হয়, সেইসাথে দূর্বল নির্মাণ ও নির্মাণগত ত্রুটির কারণে সমালোচনার সন্মুখীন হয়।

৬. নয়নতারা – ভাবনা, ভয়ংকর সুন্দর (২০১৭)

২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জিরো ডিগ্রি’র পর পরিচালক অনিমেষ আইচ দু’বছর বাদে পুনরায় আরেকটি সাইকোলজিক্যাল চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হন। প্রখ্যাত ভারতীয় কথাসাহিত্যিক মতি নন্দীর লেখা ছোটগল্প ‘জলের ঘূর্ণি ও বকবক শব্দ’ অবলম্বনে নির্মাণ করা হয় ‘ভয়ংকর সুন্দর’; যেখানে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন নবাগতা আশনা হাবিব ভাবনা, ভারতীয় অভিনেতা পরমব্রত চ্যাটার্জী, শিল্পী সরকার অপু, লুৎফর রহমান জর্জ, ফারুক আহমেদসহ অনেকে।

ছবিতে দেখা যায়, নয়নতারা (ভাবনা) নামে এক নাবালিকা বিয়ের চাপে বাড়ী থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। বিভিন্ন বিড়ম্বনা ও অসুবিধায় পড়ে পুরান ঢাকার এক হোটেল বয় মুকু (পরমব্রত)-কে নিয়ে সে পালিয়ে বেড়ায় এবং বস্তিতে একসাথে বসবাস করা শুরু করে।

সেখানে তারা বিভিন্নরকমের সামাজিক বৈষম্য ও সংকটের সম্মুখীন হয়, যার অন্যতম হলো পানি সংকট৷ উক্ত একাধিক সংকটে বেড়াজালে নয়নতারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হলে ধীরে ধীরে তার মস্তিস্কে বিকৃতি ঘটে এবং মানসিকভাবে সে দূর্বল হয়ে যায়। একসময় পানি সংকট কেটে গেলে তারা দুজন ঘরের ভেতরে বড়ছোট ড্রাম ও বোতল দিয়ে এক বিশাল পানিভর্তি গুদামঘর তৈরি করেন! ফলশ্রুতিতে বস্তিবাসীদের মধ্যে একপ্রকার ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে উক্ত জমানো পানি নেয়ার জন্য বস্তিবাসী আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ছবিটি মুক্তির আগে ব্যাপক আলোচিত হলেও মুক্তির পর দর্শকমহলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেতে সক্ষম হয়।

এই ছিল আজকের আয়োজন। এর বাইরেও সাইকোপ্যাথ নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। সেগুলো জানাতে পারেন কমেন্টের মাধ্যমে।


মন্তব্য করুন