দেয়ালের দেশ: বিষাদগ্রস্ত এক দিনের সংসার
ভালোবাসার মানুষ নহরকে একদিন মর্গে আবিষ্কার করেন বৈশাখ। এই নহরের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে সুখের খোঁজ চালিয়ে যাওয়া বৈশাখ এবার বেরিয়ে পড়েন নহরকে নিয়ে সুখের সন্ধানে, ভাবতে থাকেন নিজেদের পুরোনো দিনগুলোর কথা। আর এভাবেই অতীত ও বর্তমানের মিশ্রণে এগিয়ে চলে মিশুক মনির ‘দেয়ালের দেশ‘।
সংসার কিংবা সম্পর্ককে বোধহয় দেশের সাথে তুলনা করাই যায়। তবে সেটা চার দেয়ালের দেশ। এই দেয়ালের ভেতরে এবং বাহিরে দুজন মানুষকে ঘিরে থাকেন আরও মানুষ এবং আরও অনেক কিছু। তবে সেই দুজন যেন নিজের জন্য ভালো থাকতেই ভুলে যায়। অন্যদের কথা ভাবতে ভাবতে নিজেদের নিয়ে ভাবাটাই হয় না। আবার যখন ভাবতে শুরু করে, তখন ব্যাপারটা কেমন যেনো স্বার্থপরতা নির্দেশ করে। তবে স্বার্থপর হলেও ভালো থাকাটা জরুরি।
আমার মতে, প্যারালালি এগোনো গল্পের অতীতের টাইমলাইনে মিশুক মনি এই দুটি বিষয়কে দেখাতে চেয়েছেন। বৈশাখ-নহর যেখানে একে-অপরকে মনে জায়গা দিয়েছে, সেখানে কঠিন বাস্তবতা এবং পারিপার্শ্বিকতা যেন অন্য কিছুই ঠিক করে দিয়েছে তাদের ভবিতব্য হিসেবে। অন্যদিকে, দিনার-কণা দম্পতির মনে এখন আর ভালোবাসাটা নেই, কিন্তু তারাও সেই একই কারণে আটকে আছেন বেড়াজালে। ট্রেইলারে গল্পের এসব অংশে কিছুটা আলোকপাত করা হলেও সিনেমায় সেটাকে নিজস্বতা বজায় রেখে ভালোভাবেই দেখিয়েছেন নির্মাতা মিশুক মনি।
স্লো ট্রিটমেন্টে এগোতে থাকা গল্পের প্রথমার্ধে অতীতের টাইমলাইনে বৈশাখ-নহরের প্রেম ও তাদের পরিস্থিতি এবং বর্তমানের টাইমলাইনে নহরকে নিয়ে বৈশাখের একদিনের সংসারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে শরিফুল রাজ-শবনম বুবলির রসায়ন দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো, সংলাপগুলোও ভালো। পাশাপাশি, প্রেমহীনতায় ভুগতে থাকা দম্পতি দিনার-কণার দিকেও দৃষ্টি দেওয়া হয়। একসাথে থাকা মানেই যে ভালো থাকা নয়-এই ব্যাপারটা এখানে ফুটে উঠেছে।
তবে প্রথমার্ধের এই যে স্টোরি বিল্ডআপ, অন্য টাইমলাইনে নহরকে নিয়ে সুখসংন্ধানী বৈশাখের কর্মকাণ্ডের পর সামনে এলো দ্বিতীয়ার্ধের যাত্রা। এখানে পরিচালক ইমোশনকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন— সেটা বেশ ভালো। এখানেও দৃশ্যপট প্রথমার্ধের মতো অতীত-বর্তমানে ঘুরপাক খেতে থাকে। আমাদের বোঝাতে থাকে যে, কিছু জিনিস মানিয়ে নিয়েই আমাদের সামনে যেতে হয়। এক্ষেত্রে সুখী হই কিংবা না হই। এজন্যই এই অংশের কিছু কিছু দৃশ্য মনে গেঁথে থাকার মতো। দর্শক হিসেবে বৈশাখ নহরের অবস্থাটার সাথে কানেক্টেড ফিল করি এই অংশের যথেষ্ট ভালো ডায়লগ এবং দৃশ্যের বেশ ভালো উপস্থাপনের কারণে। ওটিটিতে মুক্তি পেলে এই সিনেমার সংলাপগুলো বেশ সাড়া ফেলবে ধারণা করছি। যাইহোক, দ্বিতীয়ার্ধের উপস্থাপন এত্তো সুন্দর যে পর্দার ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। এই সিনেমার শেষ দৃশ্যটা আমি বোধহয় কখনো ভুলতে পারবো না। খোলা মাঠে পাশাপাশি শুয়ে আছেন বৈশাখ-নহর। তারপর…
এই সিনেমার শো স্টিলার বুবলি। পুরোটা সময় একই এক্সপ্রেশন ধরে রেখে লাশের অভিনয় করা মোটেই সহজ কাজ নয়। পাশাপাশি অতীতের টাইমলাইনে বুবলির অভিনয় দারুণ। শরীফুল রাজ বরাবরের মতোই বেশ ভালো। সিনেমায় ওনার ট্রান্সফরমেশনটা অবশ্যই লক্ষণীয়। রাজ-বুবলির রসায়নও পর্দায় দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। কন্ট্রোভার্সি এড়িয়ে রাজ এবং বুবলির উচিত ভালো কাজ করে যাওয়া। এছাড়াও স্বাগতা, শাহাদাত হোসেন, সাবেরী আলম’সহ সকলের কাজ বেশ ভালো।
সিনেমার দুটি গানই বেশ ভালো। সারাক্ষণ মনে বাজতে থাকবে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও বেশ ভালো। কারিগরি দিকগুলোতেও অনেক রিচ ‘দেয়ালের দেশ’। সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং-দারুণ, দারুণ।
এবার আসি এই সিনেমার নেগেটিভ দিকগুলোতে। আগেই বলেছিলাম,’দেয়ালের দেশ’ সিনেমায় পরিচালক নিজস্ব স্টাইলে গল্প বলতে চেয়েছেন; যেটা বেশ ভালো। তবে এখানে ব্যাপারগুলো একপাক্ষিক মনে হয়েছে। অপরপক্ষেরও তো বক্তব্য থাকা স্বাভাবিক। বিশেষ করে শাহাদাত হোসেনের দিকটা যেন একেবারেই অন্ধকারে রয়ে গেলো। আর কিছু দৃশ্য একটু বেশিই রিপিটেটিভ মনে হচ্ছিলো। ইজিলি এসব দৃশ্য বাদ দেওয়া যেতো। এর বাইরে, সিনেমায় এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে শিফট করার সময় ব্যাপারটা চোখে লাগছিলো। বোঝাই যাচ্ছে-এসব এডিটিং রুমের কারসাজি।
তো, এই ছিল আমার দৃষ্টিতে ‘দেয়ালের দেশ’। স্লো ট্রিটমেন্ট এবং কিছুটা সময় মুগ্ধ হতে চাইলে দেখতে পারেন ‘দেয়ালের দেশ’।