Select Page

‘দেলুপি’ আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ছবি

‘দেলুপি’ আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ছবি

হেনরিক ইবসেন? এখন আর মনে পড়ছে না, শুধু মনে আছে ইউরোপের কোনো এক নাট্যকার তার নাটক যখন মঞ্চায়িত হতো, তিনি মঞ্চের সামনে প্রমাণ সাইজের একটি ঘড়ি রেখে দিতেন, যেখানে চলতি সময় সেট করা থাকত। তিনি বোঝাতে চাইতেন মঞ্চে যে গল্পই প্রদর্শিত হোক না কেন তা সত্যি নয়, সত্যি সামনে রাখা ঘড়ি, যে প্রকৃত সময় জানান দিচ্ছে সব সময়।

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম ও দল নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘দেলুপি’র শুরুর দিকেই আমার সেই বাস্তব ও অবাস্তবের ফিলোসফি মনে পড়ল। যাত্রা দলের অভিনেতা যখন রাজার চরিত্রে অভিনয়ের রিহার্সাল দিচ্ছেন তার মাঝখানেই লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা কমদামি মোবাইলটা বেজে উঠে ছন্দপতন ঘটায়। যেন জানান দেয় এরা প্রকৃত রাজা নয় কখনো, রাজার অভিনয় করে মাত্র! যেন নামেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, আসলে সবই কথার কথা। সত্য নয় মোটেও।

দেলুপি সত্যিকারভাবে আমাদের ছবি। আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ছবি। সে শুধু গল্পে নয়, বরং সামগ্রিক নির্মাণে। অভিনয়, সংলাপ, ক্যামেরা, সংগীত সবকিছুতে এবং সততায়ও। ছবি নির্মাণে ছবির প্রতি, শিল্পের প্রতি সৎ থাকা জরুরী, যার অভাবে বাংলাদেশে এখন অনেক আন্তর্জাতিক মানের ছবি আমরা পাই কিন্তু কোথায় যেন মনে হয় সে ছবি ভাষায় বাংলা কিন্তু আদতে সে ছবি বাঁধা পড়ে থাকে ধার করা শিল্পবোধে। সে হোক ক্যামেরায়, হোক চিত্রনাট্য বা সম্পাদনায় কিংবা ফিল্ম ফিলসফিতে। দেলুপি দেখে মনে হয়েছে এটা বাংলা ছবি। বাংলাদেশের ছবি। এটা তথাকথিত আর্ট ফিল্ম নয় আবার কমার্শিয়াল ফিল্মও না। এই ছবিতে হলিউড, কোরিয়া, সাউথ ইন্ডিয়ার গন্ধ নেই। থাকলে আছে বাংলা সংস্কৃতির গন্ধ। আর চেনা গন্ধ সঙ্গে করে সমানতালে আধুনিক ও সমসাময়িক। এই ছবি দর্শককে যেমন আনন্দ দেবে একই সাথে ভাবতে চাইলে ভাবাবে। তবে না-ভাবলেও রস গ্রহণে কোনো সমস্যা হবে না।

দেলুপি খুলনা অঞ্চলের দেলুটি ইউনিয়নের গল্প। ছবিতে সেই দেলুটি প্রতিনিধিত্ব করে পুরো বাংলাদেশের। ২০২৪ এর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যায় তরুণদের গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। দেলুপি সিনেমার শুরুতেই ‘প্রধানমন্ত্রী পলাইছে…’ সংলাপে পরিচালক জানান দেয় তিনি আমাদের সময়ের গল্পটাই বলবেন।

প্রকৃত শিল্পী যারা তারা সময়ের পালস ধরতে পারেন খুব সহজে। তাই সময়ের গল্প বলতে বলতে সময়ের স্রোতে যে নানান বাঁক থাকে, দ্বন্ধ থাকে সেটি তারা তাদের শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন। অভ্যুত্থানের পরপরই নির্মাণ করা দেলুপি ছবিতে জাকির চেয়ারম্যানের মুখে শুনতে পাই ‘দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি যা, তাতে যাত্রা হবে না কাওয়ালি হবে ও ঠিকঠাকভাবে বুঝে উঠতে পারতিছিনে!’ বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এক বছর আগের এই সংলাপ এক বছর পর সমাজের সেই দ্বান্ধিক চেহারাটা যেন স্পষ্ট করে তুলছে। ছবি মুক্তি পেলো ১৪ নভেম্বর আর তার দুদিন আগেই ময়মনসিংহের একজন যাত্রা শিল্পীকে প্রকাশ্যে চুল কেটে, মুখে কালি দিয়ে, ভিডিও ধারণ করে হেনস্তা করা হলো। দেলুপি এইভাবে সময়ের কথা বলতে বলতে আগামীর ইংগিতও দিয়ে গেছে নানান দৃশ্যে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে সাধারণ মানুষের সংলাপের ভেতর দিয়ে দেলুপি আরও ইংগিত দিয়ে যায় এই বলে – যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ!

এই যে আমাদের রাষ্ট্র রাজনীতি ঘিরে ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’ প্রবচনকে আমরা সত্যি করে তুলেছি দিনের পর দিন এর দারুণ চিত্রায়ন আছে দেলুপি সিনেমার পরতে পরতে। ছবিতে জাকির চেয়ারম্যানের চরিত্রটির কথাই যদি বলতে চাই, যাকে ছবির শুরুতেই দেখা যায় জলে বৃষ্টিতে কাদায় উদ্ভ্রান্তের মতো ক্ষমতাসীন দলের চেয়ারম্যানের দাপটে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, সেই জাকির চেয়ারম্যানই প্রধানমন্ত্রী ও তার দলবল পালিয়ে গেলে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে সাধারণ মানুষের জন্য বিভীষিকা হয়ে। তারপর সেই একই রকম ক্ষমতার দাপট, চাঁদাবাজি, জনগণের সম্পদ কেড়ে নিয়ে নিজের অফিস সাজানো, দুর্বল মাঝির নৌকা ভাড়া না-দেওয়া, বাঁশের টাকা মেরে দেওয়া, মাছের ন্যায্যমূল্য না-দেওয়া, বেড়িবাঁধকে পুজি করে কৌশলে অন্যের জমি দখল করে নেওয়ার দৃশ্য দেখিয়ে আবারও সেই পুরোনো দুষ্ট রাজনীতির ফিরে আসারই ইংগিত রাখেন পরিচালক। এরমধ্যে একমাত্র আশার আলো মিহির নামের তরুণ নেতৃত্ব। এই চরিত্রটি যেন জুলাই অভ্যুত্থানেরই প্রতিনিধিত্ব করে।

ছবিটি দেখে দর্শক হিসেবে আমার একমাত্র অসন্তোষ শেষটা নিয়ে। শেষটা হ্যাপি এন্ডিং। পার্থ ও নুপুরের বিয়ের আনন্দময় দৃশ্যে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে সিনেমার স্পিরিট অনুসারে ছবিটির শেষ হতে পারত বেড়িবাঁধের মানববন্ধনের মধ্য দিয়ে। অভ্যুত্থানের পর থেকে আমরা যে ইনক্লুসিভ রাজনীতির স্বপ্ন দেখেছি, বেড়িবাঁধের দৃশ্য সেই স্বপ্নের দিকে ধাবিত হওয়ার অনুপ্রেরণার সিকোয়েন্স, যার রেশ নিয়ে দর্শক সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে মনে হয় খারাপ হতো না। মানববন্ধনটি আয়োজনে জাকির চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে মিহিরের প্রশ্নটি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ না থাকলে রাজনীতি করবেন কাদের নিয়ে?

প্রেম, রাজনীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামাজিক সাংস্কৃতিক টানাপড়েন এমন বিবিধ ছোট ছোট অসাধারণ গল্পের বয়ান ছবিটি জুড়ে। চলচ্চিত্রে অপেশাদার অচেনা সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দুর্দান্ত অভিনয় করে গেছে। জাকির, মিহির, পার্থ, নুপুর, পলাশ, যাত্রাদলে অভিনয় করা পার্থর বাবা-মাসহ সকলেই। সংগীতের ব্যবহার ছিল চমৎকার। পুজোর উৎসবের গান আনন্দদায়ক লেগেছে। অসাধারণ ছিল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও রতু মুখার্জীর সুরে প্রায় ষাট বছর আগে সুমন কল্যাণপুরের গাওয়া ‘মনে করো আমি নেই’ গানটি যখন পার্থর মা চরিত্রে অভিনয় করা যাত্রাশিল্পী তার অভিনেতা স্বামীকে সাথে নিয়ে হারমোনিয়ামে গানটি গায়। গানের সাথে সাথে যে দৃশ্যায়ন পর্দায় ভেসে ওঠে তা ছিল ভীষণ সুন্দর।

শাটিকাপ ও সিনপাটের ধারাবাহিকতায় তাওকীর দেলুপি নির্মাণে আমাদের চলচ্চিত্রে যে আশার ইঙ্গিত দিয়ে রাখলো, তাতে বাংলা চলচ্চিত্রের অনুরাগী হিসেবে আমি আনন্দিত। এইসব তারুণ্যের হাত ধরেই আমাদের চলচ্চিত্র স্বকীয় বৈশিষ্ট নিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে যাবে বলে স্বপ্ন বোধহয় দেখতেই পারি।


About The Author

আহমেদ বাবলু

আমি প্রতিদিন জন্ম নিই আমি প্রতিদিন যাই মরে প্রতিদিন যাই ভেঙ্গে আবার প্রতিদিন উঠি গ'ড়ে

Leave a reply