দেশভাগ নিয়ে নয়, দেশত্যাগের গল্প ‘দেশান্তর’
সতর্কতা: এ আলোচনায় ‘দেশান্তর’ সিনেমার গল্পের সারসংক্ষেপ রয়েছে
ভাই-বেরাদর গ্রুপের একজন হিসাবে আশুতোষ সুজনকে আমি চিনি প্রায় ১৬ বছর ধরে। মূলত টিভি ফিকশন নির্মাতা হিসেবেই। তার প্রথম দিকের টিভি ফিকশন ‘টিনের তলোয়ার’ দেখে ভালো লেগেছিল। তখন থেকেই সুজনের কাজের প্রতি নজর ছিল। যদিও তার সব কাজ দেখা হয় নাই।
গতকাল (২৬ সেপ্টেম্বর) দৃকে গেছিলাম ফিল্মমেকার আশুতোষ সুজনের প্রথম ছবি ‘দেশান্তর’ দেখতে। এইটা মূলত নির্মলেন্দু গুণের লেখা উপন্যাস ‘দেশান্তর’র ফিল্মি ভার্সন। ২০১০ সালে এই উপন্যাস প্রকাশ হয়। আমি এই উপন্যাস পড়ি নাই। ফিল্ম দেখা-বুঝার জন্য উপন্যাস পড়া জরুরিও না। কারণ ফিল্ম নিজেই একটা আলদা টেক্সট। ছবিটা গতবছর নভেম্বরের দিকে হলে মুক্তি পেলে সুজন দেখে মতামত জানাতে বলছিল ফেইসবুক ইনবক্সে। নানান ব্যস্ততার কারণে তখন দেখতে যেতে পারি নাই। সরকারি অনুদানের ফিল্ম বলেও মনে হয় এতো আগ্রহ জাগে নাই।
গতকাল ছবি শেষে পাবলিক আলাপে পরিচালক সুজন দাবি করতেছিলেন (উপন্যাসের বিজ্ঞাপনেও সেই দাবি আছে) এইটার কাহিনী ১৯৪৭ এর ‘দেশভাগ’কে কেন্দ্র করে। মূলত ৫১ সালের দিকের একটা ঘটনাকে নিয়ে।
১৯৪৭ সালে ইংরেজদের কবল থেকে ‘দেশভাগ’ হয়েছে নাকি ‘দেশ স্বাধীন’ হয়েছে সেই তর্কে এইখানে যাবো না। আমি ফিল্মটি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম মূলত এই ফিল্ম ‘দেশভাগ’ নিয়ে নয়, দেশত্যাগ নিয়া। মানে ছাড়া নিয়া।
ছবিটা মূলত কয়েকটা হিন্দু পরিবারের গল্প। যেখানে একটা হিন্দু পরিবার অন্য হিন্দু পরিবারের অনেকের নানান প্রলোভন এবং নানান সুবিধার কথা বলার পরেও মা-মাটি-বাপের ভিটা তথা বাংলাদেশ (তখন আসলে পাকিস্তান) ছেড়ে ভারতে চলে যেতে না চাওয়ার গল্পকে কেন্দ্র করে আগায়।
ক্যারেক্টারের নামগুলা ভুলে গেছি। ফলে যারা ছবিটি দেখেন নাই তাদের আমার লেখা বুঝতে সুবিধার জন্য আপাতত নায়ক-নায়িকার আত্মীয় পরিচয়ে গল্পটা সারে বলি (পরে আবার ছবিটি দেখার সুযোগ হলে চরিত্রের নাম লিখে দিব )।
ছবিটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার লোকেশন এবং ভাষায় বানানো। একেবারেই গ্রামের একটা প্রেক্ষাপট। যেখানে নায়িকার বয়স ১৪/১৫ হবে (আনুমানিক)। নায়িকার দুই বড় ভাই। যাদের বয়স ধরেন ১৯, ২০ হবে। বাবা ছোট গৃহস্থ। মা গৃহিণী। আশপাশের অনেকেই তখন ভারত চলে যাচ্ছে। নায়িকার বাবাকে পাশের বাড়ির কেউ কেউ এসে ভারতের আসামে চলে যেতে ফুসলাইতাছে। বাবা কোনভাবেই যেতে রাজি না। পাশের বাড়ির মানুষরা বলল, ভারতে গেলে তাদের অনেক লাভ। ঐটা হিন্দুদের দেশ। ঐখানে হিন্দুরা গর্বের সাথে থাকতে পারবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু নায়িকার বাবা রাজি না। এর পিছনে কিছু রাজনৈতিক উপলব্ধি কাজ করেছিল। ফিল্মে তার সামান্য রেফারেন্স থাকলেও পরিষ্কার করে কিছু নাই।
দুইগ্রাম পরের এক বড় গৃহস্থ একদিন নায়িকাকে রাস্তায় দেখে তার শিক্ষিত স্কুল মাস্টার ছেলের (নায়কের) জন্য বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আসে বাবার কাছে। নায়িকার বাবা বলে মেয়ে ছোট। আরও পরে বিয়া দিবে। পরে মা এবং বউয়ের সম্মতিতে বিয়া দিতে রাজি হয়। ছেলে-মেয়ের সম্মতি নেয়া তখন সমাজে রীতি ছিল না। একটা দৃশ্যে নায়কের বাবার এই দেশ ছেড়ে ভারতে না যাওয়ার একটা আলাপও নায়িকার বাবাকে এই বিয়ায় রাজি হতে বাড়তি উৎসাহ দিতে বলে দেখানো হইছে।
বিয়ের কিছুদিন পর নায়িকাকে আনতে দুইভাই বোনের শ্বশুরবাড়ি যায়। কিন্তু শ্বশুড়-শাশুড়ি বাড়ির নানান কাজের কথা বলে মেয়েকে বাপের বাড়ি আসতে দেয় না। দুইভাই রাগ করে নিজেদের বাড়ি গিয়ে বাপকে বলে। বাপ রাগ করে তখনই মেয়েকে আনতে গেলে বউয়ের বাধায় তখন না গিয়ে কয়েকদিন পরে মেয়েকে আনতে যায়। ইতিমধ্যে মেয়ের শ্বশুড়-শাশুড়ি সিদ্ধান্ত নেয় তারা দেশ ছেড়ে ভারত চলে যাবে। এইটা তারা একটু গোপনে করলেও ছেলের বউ শুনে ফেলে। নায়িকার একদিকে মায়ের বাড়িতে না যেতে পারার প্যারা। অন্যদিকে গোপনে দেশ ত্যাগের আলাপ শুনে মেয়ের মধ্যে খুবই বিষাদ জাগে। ফলে সে নানান কষ্ট-কল্পনা করতে থাকে।
এমন অবস্থায় একদিন বাবা মেয়ের শ্বশুড়বাড়ি আসলো মেয়েকে নিজের বাড়ি নিতে। শ্বশুড়-শাশুড়ির নানান বাধা সত্ত্বেও মেয়ে বাবার সাথে নিজের বাড়ি চলে গেল। গিয়ে তার শ্বশুড়-শাশুড়ির গোপনে দেশছাড়ার কথা ফাঁস করে দিল। এইটা শুনে নায়িকার বাবা খুবই ক্ষেপে মেয়ের শ্বশুড়কে গালাগালি করতে থাকে। পুরা ঘটনায় নায়ক খানিকটা অসহায় টাইপের ভূমিকায় ছিল।
পরে একদিন নায়ক এবং তার বাবা-মা নায়িকার বাসায় আসল ছেলের বউকে নিয়া ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। ‘দেশান্তর’ হতে দুইতলার মতো বিশেষ ধরনের নৌকা নিয়া ঘাটে আসল।
টের পেয়ে ছেলের বউ মানে নায়িকা পাশের এক চাচির বাসায় নিজেই গিয়া লুকায় থাকে। এই নিয়া দুই পরিবারের মধ্যে ব্যাপক হট্টগোল বাঁধে। শ্বশুড় বাড়ির লোকজন মেয়ে আটকায় রাখছে বলে গ্রামে প্রচার করে মবকে তাদের পক্ষে নিতে ঢায়।
একপক্ষ মানে মেয়ের পক্ষ দেশ ছেড়ে ভারত যাবে না। এই দেশই তাদের সব। এইখানে দরকার হলে মুসলমানের বাড়িতে থাকবে। তবু দেশ ছেড়ে, মা-মাটি-মানুষ ছেড়ে যাবে না। অন্যপক্ষ মানে ছেলে পক্ষের বাবা-মা ছেলে দেশ ছেড়ে ভারত চলে যাবে। সাথে জোড় করে ছেলের বউকেও নিয়া যাবে। কারণ বিয়ার পর শ্বশুড়বাড়ি এবং জামাই মেয়েদের সব। এইসব লজিক সামনে আনে।
তো এইসব নিয়া গ্রাম্য সালিশ বসে। সালিশে নানান পক্ষ নানান মত দিচ্ছে। খুবই উত্তেজনা। মুরব্বী মাতব্বর বলল, আমরা মেয়ের কথা শুনতে চাই। সে কী চায়? দেশে থাকবে না জামাইয়ের সাথে ভারত চলে যাবে?
পরে মেয়ে আড়াল থেকে দরবারে এসে প্রকাশ্যে তার মতামত জানায় । এই হচ্ছে গল্পের মূল কাঠামো।
অনেক উত্তেজনা এবং ইমোশন দিয়া সুজন এই গল্প ডিল করেছে। অনেক বিষয়ে ডিটেইল কাজ করেছে। বিশেষ করে সনাতন ধারার শাক্ত ঘরানার অনেক ইমেজ, রিচুয়াল এবং মিউজিক সে ব্যবহার করেছে গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। মা কালিকে দেশ মাতার সাথে একধরণের সম্পর্কিত করতে চেষ্টা করেছে। এই ফিল্মে সনাতন ধারার অনেক এথনোগ্রাফিক এলিমেন্ট আছে।
একটা বড়, ভালো ভারতমাতার বিপরীতে একটা ‘জন্মভুমি এবং খাটি বাংলাদেশ’ ব্যাপার আছে এই ফিল্মের গল্পের গাঁথনিতে। ভালো-খারাপ এইটাই আমার দেশ। এইখানে সকলের সাথে মিলে-মিশে থাকতে হবে। থাকব। যেইটা বাংলাদেশ বিরোধী বর্তমান বিজেপির চরম হিন্দুত্ববাদী বয়ানের কাউন্টার হয়ত। এইটা এই ফিল্মের ‘একধরনের জাতিবাদি’ টাচি জায়গা। যেইটা আমার ভালই লাগছে।
যদিও আমি জানি বাংলাদেশ থেকে এখন একদিকে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ বা অন্য কোন ‘ভালো দেশে’ মাইগ্রেট করছে। করতে চায়। অনেকে সুযোগের জন্য হয়ত যেতে পারছে না। গরিবরা সংগত কারণেই এর বাইরে আছেন। অন্যদিকে আমাদের হিন্দু কমিউনিটির অনেকে বিশেষ করে এইবার বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর যখন প্রচার করে যে, ‘বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা এই দেশে আসলে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে’ তখন অনেক হিন্দু এই দেশ থেকে ভারত চলে যেতে থাকে। আমার নিজের কাজের অভিজ্ঞতায় জানি, গত ১৫ বছরে এই সংখ্যাটা অনেক বড়। যাদের হয়ত দেশ ছাড়ার বেদনা আছে কিন্তু তবু বেটার জীবনের আশায় দেশ ছাড়ছে।
যারা বাংলাদেশের জনগণের টাকা লুটপাট করে এখন বিদেশে বেগমপাড়া বানাইছে তাদের কথা আর বললাম না।
তো এমন একটা অবস্থায় সুজনের এই ফিল্ম দর্শকদের মধ্যে কোন বিশেষ আবেদন তৈয়ারি করেছে কিনা জানি না।
এই ফিল্মে কিছু অতিঅভিনয় এবং ক্লিশে ব্যাপার আছে। আছে কস্টিউমের ব্যবহার নিয়া সমালোচনা। গানের ব্যবহারও সবটা ভালো লাগে নাই আমার। সাধুর সাথে সমাজের সম্পর্ক আরো অর্গানিক হতে পারত।
গল্পের বাইরে ফিল্ম হিসেবে আমার খারাপ লাগে নাই। অনেক জায়গায় মাস্টারি আছে। টিভি ফিকশনের অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রকাশ আছে। টান টান উত্তেজনায় রেখে টানা একটা গল্প বলার মুনশিয়ানা আছে। যেইটা আমাদের এখনকার অনেক খরচ করে বানানো ফিল্মে বড়ই অভাব।
আশা করি সুজন আমাদের ধারাবাহিকভাবে আরও ভাল ফিল্ম উপহার দিবে।