দেশের ছবি, মাটির ছবি, নারীদের ছবি
অনেকদিন পর একটা ভালো জাতের বাংলাদেশি সিনেমা দেখলাম। মাটির প্রজার দেশে। দেশের ছবি, দেশের মাটির ছবি, এ দেশের নারীদের ছবি, মায়েদের ছবি— মূলত একটা coming-of-age গল্প একটা কিশোর ছেলের। নাম- জামাল। পিতৃহারা জামাল একদিন একা বোধ করা শুরু করে, কারণ তার একমাত্র খেলার সাথী কিশোরীর বিয়ে হয়ে গেছে।
মেয়েটার মার ভূমিকায় রোকেয়া প্রাচী ছোট চরিত্রে অনবদ্য। গোসলের পর উঠোনে বসে বাঙ্গালী নারীর ভেজা চুলের ঝাটকানির কড়কড়া শব্দেই সিনেমার অসাধারণ শব্দ নির্দেশনার পরিচায়ক।
শুরু থেকেই নজরকাড়া সিনেমাটোগ্রাফি, আবহ সঙ্গীত ও সম্পাদনায় মনে হচ্ছিল বিশেষ কিছু দেখছি, সাধারণ গ্রামের নাটক না। যেই মান তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’য় পেয়েছিলাম। গিয়াসুদ্দিন সেলিমের সিনেমায় পেয়েছিলাম।
তবে ‘মাটির প্রজার দেশে’ আরও বেশি মাটির কাছের, আরও সুন্দর করে চিত্রায়িত, অভিনয়, সংলাপ সবকিছু ছাপিয়ে মনে হয়েছে গোছানো চিত্রনাট্যকে অতি দক্ষতার সাথে পরিচালনা করা হয়েছে। মুভি শেষে দেখি আসলেই চিত্রনাট্য ও পরিচালনা একজনেরই করা – বিজন।
বাংলাদেশি ছবি বেশিরভাগ সময়েই সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হলেও সেটা ধরে রাখতে পারে না, ‘মাটির প্রজার দেশে’ কখনো সেটা মনে হয়নি। গ্রামবাংলার চিরাচরিত সারল্যের পাশাপাশি কঠিন বাস্তবতা এসে ধাক্কা দিয়ে গেছে। হ্যাঁ, কাহিনীতে খুঁত ধরতে চাইলে ধরাই যায়। দেশবিদেশের একইধরনের জীবনমুখী ছবি দেখতে বসলে উন্নতির অনেক জায়গা ধরা পড়তে বাধ্য।
তবে সবশেষে এ ভেবেই ভালো লাগছে এ দেশে এখনও আন্তর্জাতিকমানের ছবি হচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই মানের একটা সিনেমা প্রেক্ষাগৃহ পায় না, ওটিটিগুলোতেও জায়গা হয় না। নিশ্চয়ই দাম পায় নাই, হয়ত অনুদানের ছবির ট্রিটমেন্ট পেয়েছিল।
আমার ধারণা বাংলাদেশে ভালো নির্মাতাদের মার্কেটিং জ্ঞান কম। লক্ষী-মওলানা চরিত্রগুলোয় দু-একজন তারকা থাকলেই হয়ে যেত। খুব কঠিন কোন চরিত্র না। পরিচালক কাজ করলেই অভিনয় বের করে নিতে পারতেন। আর তারকাদের তো এসব সিনেমা ফ্রি করা উচিত। অনায়াসে জাতীয় পুরষ্কার জুটে যায়। ছোট ছেলেটা জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছে জানি।
মুভিটা ফ্রি দেখতে চাইলে beuff dot org এ রেজিস্ট্রেশান করুন। সাথে ‘শুনতে কি পাও’, ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এর মত কিছু ভালো ছবিও পাবেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফেস্টিভ্যাল শুরুর পরপরই সেখানে ‘ন ডরাই’ মুভি সোল্ড আউট। মানুষ হুমড়ি খেয়ে ‘ন ডরাই’ দেখবে, যেটার গুনগত মান নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ আছে, অথচ ‘মাটির প্রজার দেশে’ যতবার রেজিস্ট্রেশান করছি, পাচ্ছি। কারণ কেউ দেখছে না। ‘আর্ট ফিল্ম’ বলতে যদি একঘেয়ে কিছু ভেবে থাকেন, ভুল করবেন। ‘মাটির প্রজার দেশে’ বাংলাদেশ থেকে অস্কারে পাঠানোর মতই সিনেমা। কিছু দৃশ্য এখনও মনে লেগে আছে।
ফেস্টিভ্যালটি ৩০শে জুন পর্যন্ত চলবে।