Select Page

দ্য মিউচুয়াল ‘গ্রোথগ্রাফিতি’: কেইস ‘তুফান’

দ্য মিউচুয়াল ‘গ্রোথগ্রাফিতি’: কেইস ‘তুফান’

শাকিব খানের ক্যারিয়ারের ২৫০তম সিনেমার নাম ‘তুফান’। জনি নামে পৃথিবীতে সাড়ে ৭ হাজার মানুষ থাকলেও প্রত্যেক জনি যেমন আলাদা, অনুরূপ একই নামে কলকাতায় মিঠুন চক্রবর্তী এবং বোম্বেতে অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা থাকলেও জনি চৌধুরী, জনি ডেপ, জনি সিন্সের জগত অমিলের আস্তানা।

শাকিব খান যদি আর কোনোদিন কোনো সিনেমায় অভিনয় না করেন তবু বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম, আমার বিচারে, কমার্শিয়াল মাসালা সিনেমা তার মাধ্যমে দেখে ফেললাম। ‘তুফান’ সেই সিনেমা যা কলকাতার রাজ চক্রবর্তী বা অন্য যারা মাসালা ফিল্মমেকার আছে, তারা আজও নির্মাণ করতে পারেনি। কথাটা অপার ঔদ্ধত্য সহকারে বলছি, কারণ অনুর্ধ্ব ৪১ বয়সী ৯৭ শতাংশ বাঙালির চাইতে কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমা বেশি দেখা হয়েছে আমার।

মাসালা ফিল্মের প্রথম অনুঘটক কোন স্ক্রিনে দেখা হচ্ছে। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম বা হইচইয়ে যতই দেখেন একাকী অথবা সবান্ধব, মোবাইল স্ক্রিনে বা হোম থিয়েটার বানিয়ে— সিনেমা হলের অভিজ্ঞতার সাথে তারা ন্যূনতম তুলনাযোগ্য নয়। এর সাথে একমাত্র মিল পাবেন স্টেডিয়ামে বসে ক্রিকেট বা ফুটবল দেখার। একটা চার বা ছক্কায় কিংবা উইকেটের পতনে সমগ্র স্টেডিয়ামে যেমন কল্লোল শোনা যায়, হল অভ্যন্তরের আলো-আঁধারিতে নায়ক বা ভিলেনের সাথে দর্শকের যে একাত্মতা বা উচ্ছ্বাস, সে এক অধিবৃত্তীয় আকৃতি ধারণ করে যেন।

কলকাতার জিৎ বা দেব যেসব মাসালা ফিল্মে অ্যাক্টিং করে, হোক সেটা বস কিংবা পাগলু, কয়েক দৃশ্যের মধ্যেই হাই তোলা শুরু হয়, কারণ প্রায় সবগুলোই তেলুগু সিনেমার সিন টু সিন কপি। মিঠুন চক্রবর্তীর ফাটাকেস্ট বা গুরু কপি হলেও এ শ্রেণিতে পড়ে না, কারণ মিঠুনের বয়সের কারণে প্লট এবং ক্যারেক্টার ডিজাইনে বেশ কিছু ফ্যাক্টর কম্প্রোমাইজ করতে হয়।

তুফান কতটুকু রায়হান রাফীর, কতখানিই বা শাকিব খানের? যে প্লটে বা ল্যান্ডস্কেপে রাফী তার প্রজেক্ট ডিজাইন করেছে তাতে শাকিব খানের বাইরে তার দ্বিতীয় কোনো অপশন কি ছিল? পরাণ বা সুড়ঙ্গের ক্যানভাস খুবই ছোট, লিনিয়ার স্টোরিটেলিং, সেখানে রাজ, নিশো বা যে কোনো পারফরমার নিলেও পারফরম্যান্স খুব আহামরি হেরফের হতো না। জায়ান্ট স্ক্রিনে আরিফিন শুভ বা সিয়াম সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলছে— ‘তুফান হতে অ্যাটিচুড লাগে’, সেই ফিলটাই আসবে না।

গল্পটা যদি শাকিব খানের পয়েন্ট থেকে বলি, এই একই শাকিব খান যখন ডায়ালগ দিত ‘বসের সাথে পাঙ্গা আর যমের সাথে পাঞ্জা সেইম টু সেইম’— শুনলে তামাশা বোধ করতাম।

কিংবা গ্যালারি থেকে জয়া আহসানের ‘মা আ আ রো’ ডায়লগের সেই ট্রল উপকরণ সিনেমা, কানে দুল বেঢপ ফিগারের শাকিব খান যে ‘পাংকু জামাই’ সিনেমা করে, কিংবা ‘গড ইজ ওয়ান লাইফ ইজ ওয়ান নাম্বার ওয়ান শাকিব খান’ শুনলে আমরা শাকিব খানকে মূলত মজুর শ্রেণির হিরো বানিয়ে দিই অনায়াসে। অনবরত তেলুগু নকল কাহিনীর ঘেরাটপে শাকিব খান ছিল ঠোঁটে লিপস্টিক আর উদ্ভট কালার-কম্বিনেশন পোশাকের হাস্যকর প্যাকেজ।

তার ব্যাপারে আমার ইমপ্রেশন ছিল না, তবে একটা দীর্ঘ অনুচ্ছেদের স্টেটমেন্ট ছিল, যা ঘরোয়া আলাপে কয়েকজনের সাথে শেয়ারও করেছি।

স্টেটমেন্টটা পাবলিক করি:

‘বাংলা সিনেমায় অসংখ্য নায়ক অভিনয় করলেও সুদর্শন মাত্র ৪ জন। আলমগীর, ওয়াসিম, আমিন খান এবং শাকিব খান।

[যেহেতু লেখাটি অনলাইনে প্রকাশিত হবে, এ প্রসঙ্গ কয়েকটি অপ্রাসঙ্গিক লাইন যুক্ত করে দিই৷ গত বছর একটা জরিপ চালাই, বাংলা সিনেমার সবচাইতে সুদর্শন নায়ককে। নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সালমান শাহ ও রাজ্জাক। আমার দৈহিক সৌন্দর্য সংজ্ঞায় অন্যান্য উপকরণের পাশাপাশি হাইটও ভাইটাল ফ্যাক্টর। উল্লিখিত ৪ জনের ২ জন ৬ ফুট ছাড়ানো (আলমগীর ও আমিন খান), ২ জন ৬ ফুট ছুঁইছুঁই। সালমান শাহ ও রাজ্জাকের হাইট ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির আশপাশে। এ ধরনের সুদর্শনদের সাধারণত ‘চকলেট বয়’ বলা হয়।]

তো ৪ সুদর্শন হিরোর মধ্যে ওয়াসিম ছিলেন সেই যুগের ফোক-ফ্যান্টাসি সিনেমা কিং, টানা ২ বার মিস্টার পাকিস্তান অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন।

স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয়া এবং শাবানার আড়ালে ঢাকা পড়ায় আলমগীরকে ফিল্ম নিয়ে কেন যেন সিরিয়াস মনে হয়নি (যদিও ৯ বার ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। এগুলো রাজনৈতিক লবিং হওয়ার চান্সই বেশি)।

মান্না-ডিপজল বিরোধের প্রক্সি ক্যারেক্টার হওয়ায় আর দ্বিতীয় সারির নায়িকাদের সাথে অতিমাত্রায় কাজ করায় আমিন খান গোল্লায় গেছে, অ্য্যাক্টিংও কিছুটা দুর্বল, যদিও অভিষেক ফিল্ম ‘অবুঝ দুটি মন’ ছিল সুপার ডুপার হিট।

শাকিব খান যদি ডায়লগ ডেলিভারিটা ঠিকমত শিখত আর অপু বিশ্বাসের চাইতে পূর্ণিমার সাথে বেশি কাজ করত, তার ফেসভ্যালুটার বেটার ইউটিলাইজ হতো। কিন্তু অযোগ্য পরিচালকের আখড়ায় কে তার লেভেল আপগ্রেড করবে!

ফলে শাকিবের মধ্যে ন্যাচারাল রিসোর্স ছিল, কাজে লাগানোর লোকের অভাবেই বয়স ৪৫ পার করে ফেলেছিল’।

স্টেটমেন্ট শেষ। গ্রোথগ্রাফিতিতে জোরারোপ করা যাক।

‘গ্রোথগ্রাফিতি’ শব্দটা প্রথম কয়নেজ করেছিলাম ‘হেনরিয়েটা’ নামে পছন্দের এক নারীকে লেখা চিঠিতে। তুফান দেখবার পরে বোধ করলাম শাকিব খান এবং রায়হান রাফী পরস্পরের ‘গ্রোথগ্রাফিতি’; বিপুল প্রফিটেবল কোলাবরেশন!  শাকিব খানের যে ফিটনেস এবং লুকিং দেখা গেল, কারো সাধ্য আছে অনুমান করবার যে এই ব্যক্তি সিনেমা লাইনে আছে ১৯৯৯ থেকে!

শাকিব খানের ব্যাপারে বললাম। হোয়াট অ্যাবাউট রাফী?

একজন পরিচালকের মুনশিয়ানা পরিমাপের অনেকরকম সূচক থাকে। আমি প্রায়োরিটি দিই কাস্টিং ব্রিলিয়ান্স এবং ক্যারেক্টার ডিজাইনে।

তুফানের ক্যারেক্টার ডিজাইন প্রিন্সিপালে আমি অভিভূত। তুমি কে, কত বড় প্রোফাইল ম্যাটার করছে না, তোমার ক্যারেক্টারের রেডিয়াস কতটুকু সেটাই মূখ্য।

যে জন্য কমার্শিয়াল সিনেমার ফরমুলা ভিলেন মিশা সওদাগর ৩ সিকুয়েন্সেই সমাপ্ত। কিন্তু যদি তার ক্যারেক্টারের রেডিয়াস পরিমাপ করি, সে বলছে- যে পোলা ১৫ তে শাহনেওয়াজরে মারতে পারে, ২৫ এ সে কী করবে; এ তো বিরাট রত্ন; ও একদিন ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে খেলব’। এরপরে আইকনিক কুস্তির দৃশ্য। এরকম পৃথুল শরীরে বালির মধ্যে যেভাবে কুস্তি করলো শাকিবের সাথে, মিশার সমগ্র ক্যারিয়ারে এরকম দৃশ্য কয়টা?

শহীদুজ্জামান সেলিমের ক্যারেক্টারটার রেডিয়াস বাড়ে এক তুলনারহিত ডার্ক কমিকাল সংলাপে। এরকম তীব্র উইটি সংলাপ আমার জন্য অশ্রুতপূর্ব।

সিকুয়েন্সটা বলি। জোতদার সেলিমকে উড়ো চিঠি পাঠানো হয়েছে দখলকৃত জমি ছেড়ে দিতে, নয়ত হত্যার হুমকি। তার অনুচর পরামর্শ দিচ্ছে কিশোর তুফানের বাবার সাথে আলাপে বসবার। তার ডায়লগ

– এই চিঠির পরে আমার তো আর কথা বলা সাজে না। যা বলার তারাই বলবে। তাদের খবর দাও

– কারা?

– মুনকার-নাকীর!

পরের দৃশ্যই বীভৎস জবাইয়ের ঘটনা।

মাসালা সিনেমার মূল আকর্ষণ ম্যাসকুলিনিটি, যার মূল ট্যাগলাইন- দুষ্টের দমন। একটু গভীরে তলিয়ে দেখলে মানুষ আদতে ভায়োলেন্স লাভার। দুষ্টকে দমন করা হয় মহাভায়োলেন্সের মধ্য দিয়েই।

ভিলেন ভায়োলেন্স করলে আমরা সিমপ্যাথেটিক হই, নায়ক কচুকাটা করলে মনে হয় সে বঞ্চনার শোধ নিচ্ছে। ফলে ভায়োলেন্স মাসালা সিনেমার ভায়োলিন। তুফানের ভায়োলেন্সগুলো ডিজাইন করা হয়েছে ক্যারেক্টারের রেডিয়াস ম্যাক্সিমাইজেশন নিশ্চিত করে।

সুমন আনোয়ারের ক্যারেক্টারটা যদি দেখি, জনশ্রুতি আছে সে ঘুমের মধ্যেও খুন করে। দোলনায় ঝিমুচ্ছে, পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইছে বাবা, সুমন আনোয়ার ভীষণ ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে গুলি করে- ‘ঘুমাইতেছি না বাল, কান ঝালাপালা কইরা দিল কথা কইয়া’।

সালাহউদ্দিন লাভলু যখন বলে- ‘ওই তুই মাটিতে বয়’, আমরা একটা সংলাপেই সেই ক্যারেক্টারের অতীত-বর্তমান সব বুঝে যাই৷ যদি অভিনেতার নাম বাদ দিয়ে ক্যারেক্টার চিন্তা করি, মনে হবে তাদের কোথাও দেখেছি, শুনেছি তাদের গল্প। নিজের শহরে, উপজেলায়। হয়তবা ভিন্ন নাম ভিন্ন তাদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস।

চঞ্চল চৌধুরীর এন্ট্রি সিন যদি দেখি- সে ভাত খাচ্ছে৷ মাতৃভক্ত বায়েজিদ বোস্তামীর রেফারেন্স দিচ্ছে, মায়ের রান্না করা খাবার খাচ্ছে, যে কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন উপেক্ষা করতে পারে অনায়াসে।

ক্ষমতা চিরকালই নীতি-নৈতিকতাহীন, ব্যক্তি যত বেশি cunning and cruel হবে ক্ষমতার তত কাছাকাছি তার অবস্থান। ক্ষমতাবান মাত্রই জানে ক্ষমতা আর তার মাঝে মাত্র ‘এক বুলেট দূরত্ব’!

তুফানে cunning and cruel এর সঙ্গে ক্ষমতার তৃতীয় একটি মাত্রা যুক্ত হয়, এর নামকরণ করা যেতে পারে goosebump comedy; প্রতিটি ক্ষমতার আস্ফালন চ্যানেলিং পরিস্থিতিতে আমরা ক্ষমতার এই তৃতীয় মাত্রার বহির্প্রকাশ দেখি। যেমন তুফান বিষাক্ত মিষ্টি খাইয়ে তালাত তথা সুমন আনোয়ারের সমগ্র গ্যাংকে হত্যা করলো, একজন মাত্র বেঁচে আছে। সে মুহূর্তের সংলাপ

– কিরে তুই মিষ্টি খাস নাই?

– ভাই আমার ডায়বেটিস

– তর আবার কবে থাইকা ডায়বেটিস হইলো?

– আপনে মিষ্টি আনার পর থাইকা

– তুই শালা জাউড়া আছোস, তোরে আমার পছন্দ হইছে।

ক্যারেক্টারের রেডিয়াসের পাশাপাশি যদি ব্যাকস্টোরি এবং কেমিস্ট্রি নিই, তুফান, মিমি চক্রবর্তী, রাজ নামের ফিল্মস্টার, এবং চঞ্চল চৌধুরী এই চারজনকে আমলে নেয়া যেতে পারে।

তুফান: যে শিশু জন্ম মুহূর্তে মাকে হারায়, এবং তাকে উপস্থাপন করা হয় ‘মারে খাইছে’, ধরেই নেয়া যায় শৈশব কেটেছে অনাদরে, অবজ্ঞায়। ফলে মানুষের প্রতি তার একটাই অনুভূতি- ‘ঘৃণা’; ১৫ বয়সে চোখের সামনে বাবাকে জবাই হতে দেখলে সে ‘ডিহিউম্যানাইজেশন’ প্রকল্প নিবে, এতে বিস্মিত হই না। গাজী রাকায়েতের এক সংলাপেই তার কোর ক্যারেক্টার প্রকাশিত হয়-’তুফান বাঘ না, সিংহও না, তুফান হইলো রাক্ষস’, এবং মিমির প্রতি তুফানের রোমান্টিক আহ্বানে তা প্রতিষ্ঠা পায়- ‘আমার মানুষ ভালো লাগে না, তোমারে ভালো লাগে, কারণ তুমি মানুষ না, পরী’! যেহেতু জীবনভর সহস্র মানুষের ইন্টারভিউ নিয়েছি, এবং বায়োগ্রাফি পড়েছি, তুফান ক্যারেক্টারটাকে অপরিচিত লাগে না। এ ধরনের মানুষের একটাই ইমোশন- ‘অ্যাচিভমেন্ট’, অন্য সবাই তার কাছে কেবলই ‘প্রয়োজন’, তাদের মেয়াদ ততক্ষণই যতক্ষণ প্রয়োজন পূরণে সক্ষম। যখনই থ্রেট অথবা লায়াবিলিটি হয়ে উঠবে, বুলেট খরচ কর৷ কিংবা কন্টিনিউয়াস গ্রোথ নীতিতে যে থাকবে না, তাকেও মুছে ফেল—

‘আমি আসমানে উড়তে চাই, যে পারবো না অরে আমি জমিনেই পুইতা দিমু’।

চঞ্চল: তালাশ বা ক্রাইম ওয়াচ ধরনের অনুষ্ঠানগুলো হাল আমলে জনপ্রিয় হলেও সেই ৯০ এর বিটিভি যুগেই ‘পরিপ্রেক্ষিত’ নামের একটা ক্রাইম ম্যাগাজিন আমরা দেখেছি। তৎকালীন কয়েকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী, যেমন সুইডেন আসলাম, বিকাশ, যোসেফ গ্রেফতার হওয়ার পরে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি এবং গ্রেফতারের কাহিনী আমরা জেনেছিলাম সেই অনুষ্ঠানসূত্রে। এই সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে লাইমলাইটে আসে একজন পুলিশ অফিসার, পরবর্তীতে সে নিজেও ক্রিমিনালি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়। কর্মকর্তার নাম ‘এসি আকরাম’! স্ক্রিনে চঞ্চলের ক্যারেক্টারের নাম বলামাত্র সিনেমার ইন্টারপ্রেটেশন বদলাতে থাকে। নায়ক সোহেল চৌধুরী খুন হয়েছিলেন গুলশান বা বনানীতে এক নাইট ক্লাবে নারীইস্যুতে কোনো এক ডনের সাথে মারামারির জের হিসেবে। আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বাংলা সিনেমায় যে একজন মাফিয়া এবং নায়ক সালমান শাহর মৃত্যুতেও যার নাম আসে, তুফানের গল্পে সে না থেকেও যেন থেকে যায়। এবং সিনেমার অন্তিম টুইস্টে চঞ্চলের ইউটার্নকেও অবধারিত লাগবে যদি এসি আকরামের গল্পটা কারো মনে থাকে৷ মালায়লাম সিনেমা ‘জ্যাক এন্ড ড্যানিয়েল’ কারো দেখা থাকলে, সেই প্যাটার্নটাও কমন পড়ে যাবে।

মিমি চক্রবর্তী: মিমির ক্যারেক্টারের বিবরণীতে পাই সে কলকাতার মেয়ে, যুদ্ধের আগে বাংলাদেশে এসেছিল, যুদ্ধের কারণে আটকে পড়ে। এরপর ভাগ্যের ফেরে বার ড্যান্সার। তুফানের সঙ্গে তার প্রথম ইন্টারেকশনই ট্রমাটিক। আইটেম গানে পারফর্ম করছে, আচমকা পাশের পুরুষ যে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক নিহত হলো ওপেন ফায়ারে! তুফানের সাথে তার সম্পর্কটা গিভ অ্যান্ড টেক এর। গিভের বিপরীতে টেকের পরিমাণ বেশি। একজন সামান্য বার ড্যান্সার সমকালীন সিনেমার সবচাইতে ক্ষমতাশালী এবং হিট নায়িকা, সে তো তুফানের উপর ভর করেই। যে তুফান আসমানে উড়তে চায়, সে তার পায়ে জুতা পরিয়ে দিয়ে বলছে- ‘পা দুটো খুব সুন্দর’; সমকালীন ফেসবুকে পরীমনি বা অন্যান্য মডেলদের সাথে ক্ষমতাবানদের গিভ অ্যান্ড টেক ডিলিংসের যেসব মুখরোচক গল্প শোনা যায়, ৯০ দশকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘অপরাধ জগত’ পড়লে জানবার কথা নায়িকা এবং মাফিয়া জন্মলগ্ন থেকেই দুজন দুজনার। তুফানকে ধরিয়ে দেয়াটা তার মানবিকতা নয় নিজেকে বাঁচানোর মরিয়া কৌশল। এই স্টেটমেন্টের রেফারেন্স হতে পারে গাজী রাকায়েত হত্যা। তুফানের ফাদার ফিগার, যেমনটা সম্রাট আকবরের ছিল বৈরাম খান। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে রাজসাক্ষি হতে রাজি হলে তুফানের একটাই অপশন খোলা ছিল- তাকে হত্যা করা। এই প্রথম আমরা তুফানকে দেখি নিজে গুলি না করে অন্য একজনকে আদেশ দিতে, তারও হাত কাঁপলে তুফান এক নাগাড়ে ৫-৬টা গুলি করে দেয়। চরম ক্রাইসিস মুহূর্তে তুফানের তাকেই মনে পড়ে, যদিও খুন করেছিল নিজেকে বাঁচাতেই। দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত সুলতান সুলেমান সিরিজ যে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সে সূত্রে জানবার কথা পুত্র এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হত্যা করে নিজে বেদনার্ত হলেও ক্ষমতাধর্মের কাছে সে ছিল জিম্মি। মিমির পয়েন্ট থেকে যদি দেখি, তুফান নিজের সবচাইতে আপন মানুষের বুকেই যেহেতু গুলি চালাতে পারে, তার যৌবন ফুরালে বা অন্য নারীতে মজলে তুফানের বুলেটে তার নামও লেখা হবে মুহূর্তেই।

ফিল্মস্টার রাজ: এত বড় সুপারস্টার সেও চ্যালেঞ্জ বোধ করে একজন ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট যখন তার চাইতে লম্বা এবং সুদর্শন হয়। তার ক্ষমতার বহির্প্রকাশ পাই, যখন সে লাল রঙ অপছন্দ করে বলে রক্তের দৃশ্যেও লাল ব্যবহার না করার নির্দেশ দেয়। তার মন রক্ষার্থে পরিচালক সমগ্র শুটিং ক্রুদের শেখায় ‘রক্তের রং সবুজ, ঠিক আছে না’? একটা মাসালা ফিল্মে এমন দুর্দান্ত স্যাটারিকাল এক্সপ্রেশন তেলুগুতে মাঝেমধ্যেই দেখা গেলেও বাংলা ভাষায় দেখিনি এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

এ সূত্রেই কিছু কানেক্টিং ডট পাওয়া যায়। যেমন ৯০ দশকের মহল্লাভিত্তিক সম্প্রীতি, ঐক্য, সালমান শাহ-মৌসুমি ক্রেজ গল্পের নানা লেয়ারে আসতেই থাকে। নাইন্টিজ কিডদের সেগুলো অচেনা লাগবার কারণ থাকতে পারে না।

সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের দৃশ্যায়ন সিনেমাতে অনেকভাবেই হয়েছে, হবে আগামীতে। মাঝরাতে একজন হিন্দু প্রসূতির প্রসব বেদনা উঠেছে, তাকে হাসপাতালে নিচ্ছে মুসলিম যুবক, এবং তার জন্য রক্ত যোগাড় করতে মসজিদের ইমামকে ঘুম থেকে জাগিয়ে মসজিদের মাইকে রক্তের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে, উপমহাদেশের সাম্প্রতিক উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং সাম্প্রদায়িকতার চরম আস্ফালনের রাজনীতিতে, এই দৃশ্যটা নিসন্দেহে একটা মাইলফলক!

তুফান কি নকল সিনেমা?

এ প্রসঙ্গে ইন্টারনেটে পাওয়া এক জনপ্রিয় উদ্ধৃতি ব্যবহার্য: দুই-একটা জায়গা থেকে টুকলিফাই করলে চুরি, অসংখ্য জায়গা থেকে করলে সেটা গবেষণা।

তুফানের গল্পটা ধার করা নয়, নিজস্ব, কিন্তু স্টোরিটেলিং থিমে বেশ কিছু সিনেমা মনে পড়তে পারে আপনার।

আমার যা যা মনে পড়েছে

১. শাকিব খানের লুকিং খানিকটা অ্যানিমেল সিনেমার রনবীর কাপুর ধাঁচের। আবার তাকে পরিচয় করানো হচ্ছে ‘রাক্ষস’ হিসেবে। যেহেতু অ্যানিমেল কয়েকশ কোটি টাকা ইনকাম করা সিনেমা, রাক্ষস থিমটাকে সহজে কানেক্ট করতে অ্যানিমেলের লুকিং যদি ব্যবহার করা হয় তাকে সিম্বলিক হিসেবেই দেখা যায়।

২. কয়েকটা অস্ত্র কেজিএফ সিনেমার মতো। শাকিবের ড্রেস আপেও ইয়াশের উপস্থিতি লক্ষণীয়। গুগলে পড়াশোনা করে জানলাম সিনেমার বেশিরভাগ শুটিং হয়েছে ভারতে, সেট ডিজাইন করেছে ‘বাহুবলী’ সিনেমার সেট ডিজাইনার। শাকিব খানের সহযোগীদের যে চেহারা এবং বাহ্যিক জেইশ্চার, তা যে কোনো তেলুগু সিনেমার কমন টেম্পলেট। এতে রায়হান রাফী কোনোপ্রকার কম্পিটিটিভ এবং কমার্শিয়াল অ্যাডভান্টেজ কি পেল? যদি সে ফিল্মটা বাইরের দেশে বা ভারতেও রিলিজ দেয় ভিন্ন ভাষায় ডাবিং করে, কিছুটা পেতে পারে৷ তবে সেসব মার্কেটেও এটা বাংলাদেশী সিনেমা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। তাই তেলুগায়নটা সে চাইলে অ্যাভয়েড করতে পারত, তাতে লাভ বৈ ক্ষতি হতো না।

৩. মান্নার এক নকল কাহিনীর কমার্শিয়াল সিনেমা ‘ঠাণ্ডা মাথার খুনী’, যেখানে মূল ভিলেন বাপ মান্না, নায়ক পুত্র মান্না। এরকম ৩-৪টা আলাদা সিনেমা আছে যেখানে মান্নার দ্বৈত রোল। তবে কোনোটাই ঠাণ্ডা মাথার খুনী প্যাটার্নের নয়। তুফান মান্নার সেই সিনেমার সাথে একেবারেই মিলে না, আমার তবু মনে পড়েছে। তুমুল হিট ‘লাগে উড়াধুরা’ গানের সুর মাতাল রাজ্জাকের বিখ্যাত গান ‘আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল গো মরার কোকিলে’ থেকে নেয়া হয়েছে এটা ইউটিউবেই উল্লেখ আছে, তবে ইন্টারেস্টিংলি হলে যখন গানটা দেখছিলাম, সেট আপ এবং বিট মিলিয়ে শাহরুখ খানের জাওয়ান সিনেমার অন্তিম আইটেম গান ‘Ramaiya re vastavaiya aiya ho’ এর প্রথমাংশের সাথে কোথাও একটা মিল খুঁজে পাই৷ ইংরেজি সিনেমা ‘Devil’s double’ এবং শাহরুখ খানের ‘ডন’ থেকেও টুইস্টের প্যাটার্ন অনুপ্রাণিত। জ্যাক অ্যান্ড ড্যানিয়েল ইতোমধ্যেই বলেছি। ‘দুষ্টু কোকিল ডাকেরে কু কু কু’ গানটা পার্টি গান হিসেবে ফাটাফাটি, মিমি চক্রবর্তীর নাচও। তবে গানের দৃশ্যায়ন খুব ক্ষুদ্র গণ্ডিতে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল ঘরোয়া পার্টি, নাইট ক্লাব ফিলিংটা মিসিং; আরো কিছু ক্যারেক্টার রাখা উচিত ছিল মনে হয়েছে ফ্রেমে। এর চাইতেও প্রবলেমিটিক গানের কু কু কু অংশটা; ৩০ বছর আগেই খলনায়ক সিনেমায় ‘চলিকা পিছে ক্যা হ্যায়’ গানে মাধুরী দীক্ষিতের সেই নাচ এবং গানের শুরুতে ‘কু কু কু’ রিদমটা যেরকম কাল্ট ফিগার হয়ে গেছে, তাতে দুষ্টু কোকিল ডাকাডাকি করে নিহত হলেও ওই গানকে বিট করতে পারবে না। মিউজিক ডিরেক্টর এই অংশটা অন্য কোনো ফ্রেজ বা কী-ওয়ার্ড দিয়ে রিপ্লেস করতেই পারত। তেলুগুর মহেশ বাবু অভিনীত ‘বিজনেসম্যান’ সিনেমার জিৎ  ভারসন ‘বস’ এর আইটেম গানে স্টার্টিং লাইন- ‘ঝিংকু নাকুর নাক্কু নাকুর নাক্কু নাকুর না না’; এর অর্থ খুঁজলে আদৌ কিছু পাওয়া যাবে? হয়তবা যে গানের রিদম কপি করেছে, তার সাথে সঙ্গতি রেখে একটা লাইন তৈরি করেছে, কিন্তু মিউজিকের সাথে শুনলে হল ভাইব পাওয়া যায়। দুষ্টু কোকিলও এই তরিকায় ‘খলনায়ক’কে এড়াতে পারত। তবে আমার মূল অবজার্ভেশন অন্যত্র।

তুফান নিয়ে মানুষের আগ্রহের অনেক কারণের মধ্যে ‘লাগে উড়াধুরা’ গানও অন্যতম। প্রীতম হাসান মিউজিক কম্পোজার হিসেবে ভারসেটাইল এবং ইউনিক। তবে গায়ক হিসেবে মাঝারি বা নিম্ন মাঝারি। লো বা মিড পিচের গানে সে চলনসই, হাই স্কেলে গাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে মনে হলো। উড়াধুরা গানের প্রথম অংশ শুনলে স্মুথ লাগে, কিন্তু যখনই ‘তোমারে যে দেখলে পরে তোমারে যে দেখলে পরে পুরা মাথা ঘুরায় গো, লাগে উড়াধুরা’ অংশটা আসে, ডিসটর্টেড লাগে, কারণ তার গলার রেঞ্জ কম। প্রীতমেরই কম্পোজিশনে কোক স্টুডিওতে ‘মা লো মা’ গাওয়া সাগর দেওয়ান যদি ‘লাগে উড়াধুরা’ গাইত, আমার মনে হয়েছে স্রেফ গান হিসেবে সেটা আরো বলিষ্ঠ হতো। কিন্তু ফিল্ম যতটা আর্ট, সমপরিমাণ কমার্সও। গানের দৃশ্যায়নে প্রীতমের ফেসভ্যালু এবং নাচের যে আকর্ষণ, সাগর দেওয়ান  সেই স্তরে উন্নীত হয়নি এখনো। তাই ফিল্মিং গ্রাউন্ডে ওই খামতিটুকু কম্প্রোমাইজ করা কৌশলগত পয়েন্টে ঠিকই আছে।

এতগুলো সিনেমা মনে পড়াটা কি তুফানের ডিসক্রেডিট? একেবারেই না। দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বা হালের তর্কবাগীশ মোহাম্মদ ইকবালের সিনেমা দেখাকালীন উপহাসের বাইরে কোনো অনুভূতি তো আজও তৈরি হলো না। ইউটিউবে ‘বিষে ভরা নাগিন’ আজও ছলাৎ হাসে, নায়ক এই শাকিব খানই! তুফান একবারও ভাবতে দিবে না এটা এফডিসির রদ্দি প্রোডাক্ট।

বাংলাদেশে যারা কমার্শিয়াল সিনেমা বানায়, একমাত্র কাজী হায়াতকে মনে হতো কিছুটা রিসোর্সফুল। তার দাঙ্গা, ধর, কষ্ট— এই তিনটা ফিল্মের স্টোরিলাইন এবং ক্যারেক্টার ডিজাইন ডার্ক এবং ডিপ। বাজে স্ক্রিনপ্লে এবং আর্ট ডিরেকশনের কারণে ফিল্ম তিনটা একটা নির্দিষ্ট দর্শকশ্রেণির বাইরে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, হয়তবা হায়াতের মেধা অতটুকুই। এছাড়া কোনো বাংলাদেশি কমার্শিয়াল ফিল্মারকে আমলযোগ্য লাগেনি।

রায়হান রাফীকে পেলাম যার সঙ্গে ক্যারেক্টার, কাস্টিং, স্ক্রিনপ্লে বিষয়ে ৫ ঘণ্টা গল্প করার রিসোর্স রয়েছে মনে হলো।

রাফীর কাস্টিং ব্রিলিয়ান্স বিষয়ে একটা অনুচ্ছেদ লেখা উচিত।

প্রথমেই নাবিলা। আরবান এলিট শ্রেণিতে ‘আয়নাবাজি’ এখনো সতেজ সম্ভবত। চঞ্চল চৌধুরীকে কাস্টিং করলেই হতো। কিন্তু আমরা যদি চঞ্চলের সংলাপ এবং ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনকে ব্যবচ্ছেদ করি ‘বোঝো নাই ব্যাপারটা?’, লাইনটা একটু ভিন্ন ওয়ার্ডিংয়ে এখানেও উপস্থিত। অর্থাৎ চঞ্চলকে আয়নাবাজি অ্যাঙ্গেল থেকে কানেক্ট করার প্রয়াস। নাবিলার কাস্টিং আয়নাবাজিকে আরো আলোচনায় রাখতেই। তার পারফরম্যান্স সন্তোষজনক, তবে বাচনভঙ্গি আর বডি মুভমেন্টে জয়া আহসানকে অনুসরণের চেষ্টা বাদ দিলে স্বতন্ত্র আইডেন্টিটি তৈরি হবে।

মূল ব্রিলিয়ান্স মিমি চক্রবর্তী। যেহেতু এসভিএফ ফিল্মসের ইনভেস্টমেন্ট আছে, কলকাতা থেকে নায়িকা কাস্টিং করতে হতো। ভাবছিলাম কে হতে পারে?

মাসালা ফিল্মে আমরা দেখে অভ্যস্ত নুসরাত, শুভশ্রী, সায়ন্তিকা, শ্রাবন্তী, কোয়েল মল্লিক। নুসরাত বাদে বাকিরা নায়িকা থেকে ভাবী হওয়ার স্টেজে পৌঁছে গেছে প্রায়। হাল আমলে রুক্ষ্মিনী৷ কিন্তু ৫ ফুট ৯-১০ ইঞ্চির নায়িকা বাংলাদেশি সিনেমার জন্য খানিকটা বেমানান হত অনুমান করি। মিমি চক্রবর্তীর মাসালা ফিল্ম বলতে তেলুগু মাগাধিরার কলকাতা ভারসন ‘যোদ্ধা’! অন্য যেসব কমার্শিয়াল ফিল্ম সেগুলো মূলত রোমান্টিক জনরার৷ বাংলাদেশে তার পরিচিতির সিগনেচার ফিল্ম সম্ভবত ‘বোঝে না সে বোঝে না’! মিমির অ্যাক্টিং স্কিল মাসালা ফিল্মের নায়িকাদের চাইতে কিছুটা বেটার; ভারি এবং মাদকতাপূর্ণ ভয়েস যৌনাবেদনময়তার ক্ষেত্রে তার একটা এসেট বলা যেতে পারে। কিন্তু সেই নায়িকা ‘দুষ্টু কোকিল’ গানে পারফর্ম করতে পারবে এটা কি কলকাতার কোনো পরিচালক ভেবেছিল কোনোদিন? ফলে মিমির ক্যারিয়ারের জন্যও এটা নিজেকে পুনরাবিষ্কার জার্নি। মিমির পলিটিক্যাল ইনভলভমেন্টও এখানে বাড়তি ফ্যাক্টর।

তুফানকে কোন জনরাভুক্ত করা যায়? আমি একে পলিটিক্যাল ড্রামা ক্যাটেগরিতে রাখব।

যদি সাবটেক্সটগুলো দেখি

তুফান বলছে ‘আমার টার্গেট পুরো দেশ’। দেশ তার হাতে তুলে দিতে হবে।

স্বরাস্ট্রমন্ত্রী বাবু সংলাপ দিচ্ছে ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ’; এই শতাব্দীর শুরুর দিকের শিশু-কিশোরদের খুব চেনা লাগার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার সংলাপটিকে।

আমরা একটা টার্ম শুনি ‘তৃতীয় শক্তি’, বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৯০ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত যারা ক্রনোলজিকালি অনুসরণ করেছেন, তারা ভিন্ন টেক্সটচারে একটা বিকল্প প্রেজেন্টেশন বা ন্যারেটিভ ডিকোড না করে উপায় থাকে না, যদি তুফানকে ব্যক্তির চাইতে ‘power megalomania’ কনসেপ্ট হিসেবে দেখি এক অদ্ভুত সাররিয়াল পৃথিবীর খোলস অবমুক্ত হয়, প্রায় প্রতিটি স্বল্পোন্নত দেশ যে রোগের সহজ শিকার।

রাফীর আরেকটি ব্রিলিয়ান্স ক্যারেক্টারের মধ্যে কনট্রাস্টের মধ্য দিয়ে কোহেরেন্স তৈরি করা।

শাকিব খানের দ্বৈত চরিত্র। শান্ত এবং তুফান। দুজনই অনাথ। একজন ফিল্মে একটা সুযোগের অপেক্ষায় ঘুরতে ঘুরতে নিঃশেষিত প্রায়। বহু সংগ্রামের পরে একটা সিনেমায় সেকেন্ড লিড পেল, সেই উচ্ছ্বাসে এলাকাবাসীরা গেল হলে, কিন্তু  তার দৃশ্যগুলো থেকে তাকে ছেটে ফেলে দেয়া হলো। তার সংলাপ ‘আমার কি স্বপ্ন দেখারও অধিকার নাই’, শুনলে মন আর্দ্র হবে। সে প্রস্তুতি নেয় আত্মহত্যার। তার জীবনে কেবলই রিজেকশন। সে আশা খুঁজে মহল্লাবাসীদের মাঝে, প্রেমিকার কাছে।

তুফানের অবস্থা শান্তর চাইতেও খারাপ। অত্যাচার আর অবহেলাই তার প্রতিদিনকার চিত্র। সেখান থেকে সে বলে- ‘বশির ভাই জানতো না আমি ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে না, ন্যাশনাল লেভেলে খেলুম’, এবং আইকনিক লাইন- ‘তুফান পোষ মানে না, পোষ মানায়’

দুই শাকিবের যখন সাক্ষাৎ হলো, আমরা কনট্রাস্টপূর্ণ কোহেরেন্সটা দেখি এক লাইনে- ‘চেহারায় মিল থাকলেই হয় না। এটিচুড লাগে’।

নাবিলা এবং মিমি। নাবিলা একজন স্ট্রাগলিং কস্টিউম ডিজাইনার। কিন্তু দৃঢ়ভাবে জানে একদিন সে বড় হবে। সে নিজের কাজটাতেই মনোযোগ বাড়ায়। প্রেমিকা হিসেবে সে পজেসিভ এবং কেয়ারিং।

মিমির স্ট্রাগলটা প্রথম থেকেই এক্সিসটেন্সিয়াল ক্রাইসিস। তার বড় হওয়ার ফাউন্ডেশন দুর্বল। তার প্রেম নয় কামুকতাই ক্যাপিটাল। তাদের কোহেরেন্স ঘটে লাগে উড়াধুরা গানে। নাবিলার ডিজাইনকৃত কস্টিউমে নাচছে নতুন নায়ক শান্তর সঙ্গে যে দেখতে তুফানের মতো। নাবিলা প্রশ্ন করছে শান্তকে- ‘তোর নায়িকা কে’, উত্তরও দিচ্ছে নিজেই। অন্যদিকে মিমি নিজে নায়িকা, স্ক্রিনে, কিন্তু অফ ক্যামেরায় শান্ত একটা অমীমাংসিত পাজল। সিগারেট ঠোঁটে কামুক দৃষ্টিতে জুনিয়র আর্টিস্ট শান্তকে দেখে যখন নাবিলাকে বলে ‘ও ভীষণ সুন্দর’ এবং ঈর্ষাবশত নাবিলা শান্তকে প্লেবয় হিসেবে আখ্যায়িত করে, তার মন্তব্য ‘আই লাইক ব্যাড বয়েস’, সমগ্র কেমিস্ট্রিটাকে পৃথক এক ডাইমেনশন থেকে বুঝবার ইঙ্গিত দেয় আসলে।

মাসালা ফিল্মে এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উপকরণ খেয়াল করার আবশ্যকতা নাই আসলে। অ্যাকশন, নাচানাচি, সাউন্ড দিয়ে মোহিত করাই যথেষ্ট। কিন্তু রাফী সব শ্রেণির জন্যই রসদ রেখেছে, এটাই তার কমার্শিয়াল ব্রিলিয়ান্সের সিগনেচার।

‘তুফান-২’ নির্মিত হবে। সিক্যুয়েলে আমি মনে করি নাবিলা, মিমি, এবং শান্তরূপী শাকিব চরিত্রের উপস্থিতি অনাবশ্যক। স্টোরিলাইনে অপ্রত্যাশিত কোনো ক্লাইম্যাক্স বা প্লট আসুক।

হোয়াট নেক্সট?

পরিচালকের মুনশিয়ানা সূচকে আরেকটা প্রায়োরিটি সে নিজে স্টার জন্ম দিতে পারে কিনা। শাকিব খানকে তৈরিতে রায়হান রাফীর অবদান নেই৷ আমি খুঁজছিলাম সমকালীন ইন্ডাস্ট্রিতে কেউ কি আছে যাকে রাফী রিডিফাইন এবং রিডিজাইন করতে পারে। তল্লাশি শেষে ‘রোশান’ নামের একটা ছেলেকে পেলাম। লুকিং, হাইট, ফিটনেস, ভয়েস সবই অনুকূলে। অ্যাক্টিং স্কিল তুলনামূলক দুর্বল, জেইশ্চার একটু অপরিশীলিত। কিন্তু ঘষামাজা করলে একে অনেক বড় বানানো সম্ভব। শাকিবের বয়স ৪৫, রোশান সম্ভবত ৩০ এর আশপাশে। বয়স বাড়লে নায়িকা হয় মা-ভাবী, নায়ক প্রেম করে হাঁটুর বয়সী নায়িকার সাথে, কিন্তু পরিচালকের বাড়ে ব্যাপ্তি আর বিস্তৃতি। তাই রাফীর জন্য ‘রোশান’ হতে পারে একটা এক্সপেরিমেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট কেইসভ তুফানের আলাপে রোশানের প্রসঙ্গ তুললাম, কারণ রাফীকে আমার পরিচালক হিসেবে ব্রিলিয়ান্ট মনে হয়েছে। হেনরিয়েটাকে ভেবে কয়নেজ করা ‘গ্রোথগ্রাফিতি’ শব্দটা তার জন্য প্রয়োগ করায় হয়তবা সিলেবাসের বাইরে থেকেও দু-একটা প্রশ্ন এবং প্রসঙ্গ সওয়ারি করে দিলাম।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়

লেখক ও বায়োপিক এনালিস্ট

মন্তব্য করুন