নতুন কী আছে ‘দরদে’, যা দর্শককে হলমুখী করবে
‘দরদ’ ছবির গল্প শুরু হয় একটি দুর্ঘটনা থেকে। মাঝরাতের শুনশান রাস্তা। একজন লোক অফিস থেকে বেরিয়ে মোটরবাইক চালাতে শুরু করে। তার পিছু নেয় একটি অটো রিকশা। এলোমেলো ট্যাক্সি চালিয়ে বাইকচালককে বিপদে ফেলতে চেষ্টা করে অটোচালক। একপর্যায়ে একটি দ্রুতগামী ট্রাকের নিচে এসে পড়ে মোটরবাইক চালক। এখানেই টাইটেলে নাম দেখা যায় অনন্য মামুনের।
এরপর আমরা দেখি অটোচালক দুলু মিয়া (শাকিব খান) তার স্ত্রী ফাতেমাকে (সোনাল চৌহান) খুশি করার নানা চেষ্টা করছে। দিনভর গান গেয়ে, নৃত্য করে স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটানোর কসরৎ করছে দুলু মিয়া। দিনশেষে সে বিষন্ন হয়ে পড়ে ফাতেমার মুখে একচিলতে হাসিও দেখতে না পেয়ে। নদীর বুকে নৌকায় ভেসে ভেসে ফাতেমার উল্টো দিকে ঘুরে যখন সে তার আক্ষেপ ঝাড়ছিল তখনই ঝুপ করে নদীতে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ। ফাতেমাকে নদীতে পড়ে যেতে দেখে লাফ দেয় দুলু মিয়া।
আর তখনই ঘুম ভেঙে যায় তার। পাশের রুমে উচ্চ ভলিউমে টিভি চলছে। পর্দায় চলছে সরফরাজ খানের (রাহুল দেব) অভিনয়। আর তা দেখে উল্লসিত ফাতেমা। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্ত্রীকে বিছানায় নিয়ে আসে দুলু মিয়া। দিনের আলো ফুটলে দেখা যায়, এই টোনাটুনির সংসারের নিত্যদিনের খুনসুটি। সেখানে একটা সাধারণ আলাপ সরফরাজ খান। স্ত্রীকে খুশি করতে সরফরাজ খানের সেটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দুুলু মিয়া। সঙ্গে নেয় ভক্তের বানানো মিষ্টি।
শুটিং সেটে দুলু মিয়ার আবদারে মিষ্টি খাওয়ার পরপরই সরফরাজ খানের মৃত্যু। দুলু মিয়াই কি খুন করল ফিল্মস্টারকে? ফাতেমাও তো দায়ী করছে স্বামীকেই। নাকি শুটিং সেটের পরিচালক নায়কের লুচ্চামিতে বিরক্ত হয়ে এই কাণ্ড ঘটাল? প্রযোজক, পরিচালক, নায়িকা, নায়কের সহকারী- সবাই জড়িয়ে গেল খুনের ঘটনার সঙ্গে। পায়েল সরকারের নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে সন্ধান পেল দুলু মিয়ার। ছবির বাকি অর্ধাংশে উন্মোচিত হয় দুলু মিয়া রহস্য।
ছবিতে দুলু মিয়ার অতীত ও বর্তমানের ঘটনাগুলো এলোমেলোভাবে দেখানো হয়। ফলে কোন ঘটনাটা অতীতে ঘটছে আর কোন ঘটনাটা বর্তমানে ঘটছে তা দর্শক বুঝে উঠতে পারেন না। এভাবেই ‘দরদ‘ এর চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই যে, গল্পের সঙ্গে দর্শক জুড়তে পারেন না চিত্রনাট্যের এই বিশেষ কৌশলের কারণে। চিত্রনাট্য রচনায় যে দক্ষতার দরকার ছিল তার পরিচয় দিতে পারেননি চিত্রনাট্যকার। এই ধরনের চিত্রনাট্যকৌশল বাইরের দেশের ছবিতে হরহামেশাই দেখা যায়। সেটার অনুকরণ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন ‘দরদ’ এর চিত্রনাট্যকার। এখানে আমি কথা তুলব কামরুজ্জামান রোমান পরিচালিত, গেল ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘লিপস্টিক’ এর।
‘লিপস্টিক’ একটি সরল গল্প। পূজা চেরী একজন চিত্রনায়িকা। তার সহকারী আদর আজাদ। একের পর এক খুন হন সিনেমার প্রযোজক, পরিচালকসহ আরো কয়েকজন। খুনের সন্দেহভাজন আদর। তাকে রিমান্ডে আনলে চিত্রনাট্যে আসে একটি ফ্ল্যাশব্যাক। ‘লিপস্টিকে’র ফ্ল্যাশব্যাক আর ‘দরদে’র ফ্ল্যাশব্যাক একই রকম। ‘লিপস্টিক’ এর আতর আলী আর ‘দরদ’ এর দুলু মিয়ার অতীত হুবহু এক। (দুটি ছবিরই গল্পকার আব্দুল্লাহ জহির বাবু!)
‘দরদ’-কে ‘লিপস্টিক’ থেকে আলাদা করেছে অনন্য মামুনের চিত্রনাট্য। আর এই আলাদা করতে গিয়েই চিত্রনাট্যের লেজেগোবরে অবস্থা। এবং ‘লিপস্টিক’ থেকে ‘দরদ’ এর গোয়েন্দাপুলিশের তৎপরতা আরও বেশি বিভ্রান্তিকর। ফলে দর্শকের ‘দেমাগ খারাপ হয়ে যায়’ (‘দরদ’ এর একটি চরিত্রের সংলাপ) গল্পের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে।
‘দরদ’ এর গল্প উন্মোচন না করে চিত্রনাট্য ও চরিত্র নিয়ে বেশি আলোচনা করতে আমি অপারগ। একটু আলো ফেলি তদন্ত কর্মকর্তা পায়েল সরকারের চরিত্রের ওপর। ‘লিপস্টিক’ এ শহীদুজ্জামান সেলিম একই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে পায়েলকে কেন অন্ত:সত্তা দেখানো হল? এর তো কোনো কারণ নেই। গল্পে যদি গর্ভবতী বলে কোনো ভূমিকা না থাকে, তবে শুধু শুধু বাইরের দেশের ছবি থেকে চরিত্র ধার করার দরকার কী?
বাকী চরিত্রগুলোও ঠিকঠাক বিকশিত নয়। রাহুল দেব, রাজেশ শর্মা- কাউকেই ছবিতে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করা হয়নি। পুরো ছবি শাকিব খানের ওপর। সঙ্গে সোনাল চৌহান। আগেই বললাম, কীভাবে শাকিব খান চিত্রনাট্যের বলি হয়েছেন। সোনাল চৌহানও রক্ষা পাননি। যে চরিত্রে আপনার বিশ্বাস নেই, সেটাতে আপনি ঠিকঠাক অভিনয় কীভাবে করবেন?
যে চরিত্রটি ছেলেবেলায় ভারতের বেনারসে চলে গেছে, তার তো বংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাকে আপন করে নেয়ার কথা নয়। যুক্তি মার খেলেও কমিক উপাদান হিসেবে ভাষাটাকে ব্যবহার করা হয়েছে শাকিব খানের মুখে। সোনাল, পায়েলরা আবার কথা বলছে কলকাতার প্রমিত বাংলায়। ফলে দর্শক বিভ্রান্ত হন তারা আসলে কোন কালে কোন স্থানে গিয়ে হাজির হল।
‘দরদ’ এর সংলাপ শুনে বোঝার উপায় নেই এটা কোন অঞ্চলের গল্প। যদি বেনারস গল্পের পটভূমি হয়ে থাকে, সেখানে প্রত্যেকে কেন বাংলাভাষায় কথা বলছে? আর বাংলাভাষায় কথা বললে কোন সংলাপে কেন প্রাণ নেই? কেন চরিত্রগুলোকে বাঙালি মনে হচ্ছে না?
বেনারস এই ছবিতে নেহায়েত লোকেশন হিসেবে এসেছে। গল্পকে এখানে এনে ফেলার কোনো যুক্তি নেই। ‘লিপস্টিক’ ঢাকায় হয়েছে, তাকে তো বেনারস, কলকাতা, চেন্নাই যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি!
ছবিজুড়ে শয়ে শয়ে অসঙ্গতি। দুলুমিয়ার দরজার পাশেই হাতুড়ি পড়ে থাকে যেন পুলিশ এলে ওটা দিয়ে দরজা ভাঙা যায়! বলতে গেলে বাক্যের পর বাক্য লিখে যেতে পারব।
একটা ছবির সমস্ত অসঙ্গতি ধামাচাপা পড়ে যেতে পারে নির্মাণশৈলীর যাদুতে। সে জায়গাায় ব্যর্থ হয়েছেন অনন্য মামুন। আনতে পারেননি মার্ডারমিস্ট্রির গতি, আবার সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের প্যাঁচ খেলতে গিয়েও গিট্টু লাগিয়েছেন। ফলে ‘দরদ’ দেখে তৃপ্তি মেলে না, স্বস্তি পাওয়া যায় না।
যদি বড় বাজেটের ছবি হিসেবে চোখের আরামের কথা আসে, সেখানেও হতাশা। রঙের ব্যবহার একেবারে বাজে। টেকনিক্যাল দিকগুলো দেশি ছবিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ভারতের ভিন্ন ভাষাভাষী দর্শক কেন এই ছবি দেখবে? কী আছে নতুন যা তাদেরকে সিনেমা হলমুখী করবে? এর জবাব আমি অন্তত ‘দরদ-এ খুঁজে পাইনি।