‘নদী ও নারী’র সাদেক খান
বাংলা সাহিত্যে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের কথা উঠলেই একবাক্যে আসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি ও অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম। প্রথম উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে দুই সিনেমা, পরেরটি নিয়ে একটি। পাকিস্তান আমলের জাগো হুয়া সাভেরার নির্মাতা এ জে কারদার এসেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আর বাংলাদেশ আমলে পদ্মা নদীর মাঝি ও তিতাস একটি নদীর নাম বানিয়েছেন যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গের দুই নির্মাতা গৌতম ঘোষ ও ঋত্বিক কুমার ঘটক। উপন্যাস দুটির লেখকদের শিকড় তখনকার পূর্ববঙ্গে হলেও শেষ জীবনে কেউ সেখানে থাকেননি।
এমন গল্পের ফাঁকে অল্প করে শোনা যায় অথবা যায় না নদী ও নারীর নাম। পশ্চিমবঙ্গে থিতু হওয়া হুমায়ূন কবিরের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন সাদেক খান। ১৯৬৫ সালের ৩০ জুলাই মুক্তি পায়।
নদী ও নারীর কয়েক বছর পেছনে ফিরলে আমরা দেখি জাগো হুয়া সাভেরায় প্রযোজনা সহকারী ছিলেন সাদেক। যার নায়ক ছিলেন খান আতাউর রহমান, তখন পোশাকি নাম ছিল আনিস ও সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। সব মিলিয়ে জাগো হুয়া সাভেরা ঢাকার উদীয়মান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তোলপাড় করার মতো ঘটনা। সেই সিনেমা ৬৯তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ক্ল্যাসিক বিভাগে প্রদর্শিত হলো ২০১৬ সালের ১৫ মে। কাকতালীয়ভাবে তার পরদিন (১৬ মে) মারা যান সাদেক খান।
পদ্মা নদীর মাঝি অবলম্বনে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ লেখেন জাগো হুয়া সাভেরার চিত্রনাট্য। ১৯৫৯ সালে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারে জমা দেওয়া হয় সিনেমাটি। একই বছর মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নেয় তা স্বর্ণপদক। পরের বছর নির্মিত হয় গ্রামবাংলার কাহিনিনির্ভর আরেক স্মরণীয় সিনেমা আসিয়া। পরিচালনা করেন ফতেহ লোহানী। আসিয়া উল্লেখ করার কারণ একটাই নদী ও নারীকে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা আকারে দেখানো।
হুমায়ূন কবিরের ইংরেজি উপন্যাস নদী ও নারী প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় তার বাংলা তরজমা। সাদেক খানের পরিচালনায় প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেন আবদুল খালেক ও রওশন আরা। আরও ছিলেন সুভাষ দত্ত, মাসুদ খান ও গোলাম মুস্তাফা। প্রধান সহকারী ও শিল্প নির্দেশক হিসেবে ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মূর্তজা বশীর। আবেদ হোসেন খানের সংগীত পরিচালনায় গানে কণ্ঠ দেন আবদুল আলীম ও নীনা হামিদ। চিত্রগ্রহণে ছিলেন উইলিয়াম।
নদী ও নারীর জন্য নির্মাতার শ্রম প্রতিটি দৃশ্যে বোঝা যায়। নতুন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সম্পূর্ণ আউটডোর চিত্রায়ণ নিশ্চয় অনেকটা ঝুঁকির কাজÑব্যয় ও শ্রম দুই দিক থেকে। বাস্তবসম্মত করতে তা-ই করা হয়েছিল।
জাগো হুয়া সাভেরায় তুলে ধরা হয়েছে জেলেজীবনের আখ্যান। আবেগ-অনুভূতির পাশাপাশির উৎপাদনব্যবস্থার নানা দিক, সম্পর্কের ধরন উঠে এসেছে। নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তো বটেই। একইভাবে, নদী ও নারীতে জীবনের সমান্তরালে তুলে ধরা হয়েছে নদীকে। তবে জেলেজীবন নয়, হালচাষ করে দিনাতিপাত করা মানুষের গল্প। নতুন চর জাগিয়ে তোলে নতুন আশাবাদ। কীভাবে কয়েকজন মানুষ একখ- জমি চাষ করে কৃষির পত্তন করে, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জনপদ, তৈরি হয় নানা প্রতিষ্ঠান। যার রেশে ধরে আসে হিংসা, বিভেদ, আবার মিলনও। একসময় সে জনপদ হারিয়ে যায় নদীর গর্ভে। আবারও নতুন চর খোঁজার পালা। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার গল্প যেমন হয়। হ্যাঁ, মানুষের এগিয়ে যাওয়ার গল্প! এমন একটা গল্পকে বাণিজ্যিক ঝুঁকি চিন্তা না করে নির্মাণের পর্যায়ে যিনি নিয়ে যান, তাকেই নায়ক বললে ভুল হয় না।
নিজের আত্মজীবনীতে ছবিটি সম্পর্কে চিত্রশিল্পী মূর্তজা বশীর লেখেন, ‘সাদেক খান তাঁর আর্ট এনসেম্বল গ্যালারিতে পরিচালক পদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেন। প্রেসক্লাবের উল্টোদিকের ভবনের দোতলায় ছিল সেই গ্যালারি। সাদেক “লুব্ধক” নামে একটা প্রোডাকশন হাউসও করেছেন। সেখান থেকে নদী ও নারী সিনেমাটি করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাদেক জানতেন যে চলচ্চিত্রশিল্পের প্রতি আমার বিশেষ অনুরাগ রয়েছে। সাদেক আগে একটি উর্দু ছবি করতে চাইলেন, তার স্ক্রিপ্ট লিখতে বললেন আমাকে। কারওয়া নামে চলচ্চিত্রটির কাহিনি, চিত্রনাট্য আমি তৈরি করলাম।’
‘হুমায়ূন কবিরের নদী ও নারী উপন্যাসটির চিত্রনাট্যও করলাম। বলা যায়, কাহিনির আমূল পরিবর্তন করলাম। নতুন নতুন চরিত্র সৃষ্টি তো করেছিলামই, সেই সঙ্গে উপন্যাসের কোনো কোনো চরিত্রের সংলাপের ক্ষেত্রে একজনেরটা আরেকজনের মুখে বসিয়ে দিয়েছি। অবশ্য ঔপন্যাসিকের অনুমতি নেওয়ার জন্য চিত্রনাট্য পাঠানো হয়েছিল। চিত্রনাট্য পড়ে হুমায়ূন কবির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। সিনেমাটি অবশ্য চলেনি। গুলিস্তান হলে প্রদর্শিত হতে পেরেছিল মাত্র দুই দিন। খুবই এক্সপেরিমেন্টাল ছিল ছবিটি। ব্ল্যাঙ্ক ফ্রেম, ফ্রিজশট, ফ্ল্যাশব্যাকের আধিক্যÑএসব টেকনিক সেকালের নিরিখে বেশ অগ্রসর ছিল।’
মূর্তজা বশীর বলছেন, নদী ও নারী ওই সময়ের তুলনায় অগ্রসর ছিল। তিনি টেকনিকের কথা বলছেন। কিন্তু আমরা গল্প নিয়েও একই কথা বলতে পারি। ১৯৬১ সালে জহির রায়হান পরিচালিত কখনো আসেনির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, দেশের জনগণ বিশ বছর পরে যে ছবি দেখবে বলে আশা করেছিলেন, বিশ বছর আগেই দেশের তরুণেরা সে ছবি তাদের উপহার দিলেন।
সে ‘বিশ বছর’ এখনো চলছে। গ্রাম-সম্পর্কিত অনেক সিনেমা আমরা দেখেছি। একই ধারার গল্পের পুনরুৎপাদন বললে ভুল হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। অথবা বৃহত্তর কোনো অর্থ দাঁড় করানোর সিনেমা খুবই কম পাওয়া গেছে।
অনলাইনে নদী ও নারীর ১ ঘণ্টা ১৮ মিনিট দৈর্ঘ্যরে ভিডিও পাওয়া যায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ধরনের ক্ল্যাসিক মুভিগুলো নতুন করে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তেমন দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই। এ ছাড়া ১৫টির মতো প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন সাদেক খান। তার প্রযোজিত সিনেমার মধ্যে রয়েছে কারওয়া, ক্যায়েসে কহু।
নারী ও নদীর হাল ধরা নিয়ে সাদেক খানকে নায়ক বলছিলাম। তিনি সত্যি সত্যিই নায়ক হয়েছিলেন। ‘দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও’তে (১৯৫৮) তাকে নায়ক করেন এজে কারদার। গল্পের পটভূমি ঐতিহাসিক। গৌতম বুদ্ধের সময়ের এক কুমার যুবক ভালোবাসে একই গ্রামের গরিব মেয়ে কান্তিকে। সে জটিলতায় উঠে আসে সামাজিক গল্প। কাহিনি লেখেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক সৈয়দ নূরুদ্দিন। সংলাপ ও গান লেখেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। সাদেক খানের বিপরীতে অভিনয় করেন ইভা। এর মাধ্যমে সিনে জগতে পা রাখেন রানী সরকার। কিন্তু পরিবেশনা সম্পর্কিত জটিলতায় সিনেমাটি অসমাপ্ত থেকে যায়। পরে মহীউদ্দিনের ‘রাজা এলো শহরে’ (১৯৬৪) চলচ্চিত্রে নায়ক হন সাদেক খান।
১৯৩২ সালের ২১ জুন মুন্সীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা এ গুণী ব্যক্তিত্ব পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রে সক্রিয় থাকেননি। সাংবাদিকতায় দেখা গেছে বাকি জীবন। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তবে তাঁর আজীবনের অবদান অনুযায়ী বাংলাদেশের মূলধারার সংস্কৃতিসেবীদের জগতে তিনি আদরণীয় ছিলেন না বিশেষ। কোনো মহৎ শিল্পীকেই অবশ্য এরূপ দীনতা স্পর্শ করে না।
*লেখাটি সাম্প্রতিক দেশকালে পূর্ব প্রকাশিত