Select Page

নব্বই দশকের প্লেব্যাকে প্রধান আবিষ্কার আগুন

নব্বই দশকের প্লেব্যাকে প্রধান আবিষ্কার আগুন

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নিয়ে আজকের প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক রকম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে থাকে। একটা শ্রেণি তো নিজেকে জাতে তোলার জন্য ৭০-৯০ দশকে নির্মিত বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলোকে ‘বস্তাপচা’ ট্যাগ দেয়। কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, ওই বিশেষ শ্রেণি উল্লেখিত ৩ দশকের চলচ্চিত্র সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখে না।

তখন চলচ্চিত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তারা কতখানি মেধা, আন্তরিকতা ও ধৈর্য সহকারে একেকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন; তার সার্থক উদাহরণ কণ্ঠশিল্পী খান আসিফুর রহমান আগুন

উপমহাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গান।  আর যারা গান করেন তারা থাকেন দর্শকের চোখের আড়ালে অর্থাৎ দর্শক কণ্ঠ শুনবে কিন্তু পর্দায় দেখবে চলচ্চিত্রের কোন অভিনেতাকে। এই প্লেব্যাক উপমহাদেশের সংগীতশিল্পীদের কাছে অনেক আরাধ্য। উপমহাদেশের যত বড় বড় কণ্ঠশিল্পী দেশের সীমানা ছেড়ে বিদেশেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন তাদের সবাই  প্রথমে প্লেব্যাকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েই তারা খ্যাতি, অর্থ ও সম্মান পেয়েছিলেন। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

রেডিও, টেলিভিশন ও মঞ্চ— এই ৩ মাধ্যমের চেয়ে চলচ্চিত্রের নেপথ্যে গান পাওয়াটা অনেক কঠিন।  অনেকে সহজে তা রপ্তও করতে পারে না।  কারণ শিল্পী যে গানটিতে কণ্ঠ দেবে তা সিনেমার গল্পের ওপর নির্ভর করে পরিস্থিতি, চরিত্র ও অভিনেতার অভিনয়ের সঙ্গে মিল রেখে গাইতে হবে। অর্থাৎ কণ্ঠশিল্পীকে শুধু গাইলেও হবে না, গানের কথা, চলচ্চিত্রের সিকোয়েন্স ধরে অভিনয় কল্পনা করে কণ্ঠের মাধ্যমে তা প্রকাশ করতে হবে। এ কারণে প্রযোজক, পরিচালক ও সংগীত পরিচালক ৩ জনকে প্লেব্যাকের ওপরে খুব গুরুত্ব দিতে হয়।

বাবা খান আতার সঙ্গে আগুন

আমাদের ৭০-৯০ দশকের চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযোজক, পরিচালক ও সংগীত পরিচালকরা খুব নিখুঁতভাবে কাজটি করতেন; যার ফলশ্রুতিতে আগুনের গান আমরা প্রায় নিয়মিত শুনতাম। 

 ১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও ব্যবসায়িক রেকর্ড গড়া সোহানুর রহমান সোহানের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে আমরা শুধু সালমান-মৌসুমী নামের নতুন দুটি মুখ পাইনি, পেয়েছিলাম এক তরুণ ব্যান্ডশিল্পীকে যিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ খান আতাউর রহমান ও কণ্ঠশিল্পী নীলুফার ইয়াসমিন দম্পতির সন্তান খান আসিফুর রহমান আগুন।  চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার পূর্বেই দর্শক শ্রোতাদের কাছে তত দিনে ‘সাডেন’ ব্যান্ড ও একক অ্যালবাম ‘ওগো প্রেয়সী’ দিয়ে আগুন পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রের গানে সেবারই প্রথম পেলাম।

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর সবগুলো গানের পুরুষকণ্ঠ ছিলেন আগুন, সহশিল্পী  ছিলেন রুনা লায়লা। অথচ আগুনকে কোন গানে মনে হয়নি প্রথমবার প্লেব্যাক করছেন। তারা এত চমৎকারভাবে গাইলেন যে  সালমানের কণ্ঠের সঙ্গে আগুন আর মৌসুমীর কণ্ঠের সঙ্গে রুনার কণ্ঠ দারুণভাবে মিলে গিয়েছিল। আগুনের জন্মের পূর্ব থেকেই প্লেব্যাক কিংবদন্তি রুনা লায়লা, তার সঙ্গে এমন যুগলবন্দী নিঃসন্দেহে তরুণ গায়কের জন্য টার্নিং পয়েন্ট।

২৫ বছর পূর্তিতে সাডেন ব্যান্ডের কুশলীরা

সেই শুরু, এরপর আগুনকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যান্ড, একক  অডিও অ্যালবামের ব্যস্ততা ছেড়ে প্লেব্যাকে দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অসংখ্য জনপ্রিয় গান দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে প্রমাণ করেন। বিশেষ করে সালমানের যে সব ছবিতে আগুনের কণ্ঠের গান আছে যার প্রায় সবগুলোই হিট অথবা সুপারহিট। আলম খান, আলাউদ্দিন আলী, আবু তাহের, আলী হোসেন, আনোয়ার পারভেজ, সত্য সাহা, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো প্রথিতযশা সুরকার সংগীত পরিচালকরা আগুনের কণ্ঠকে চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন।

আমরা আগুনের কণ্ঠে পেয়েছিলাম গানে গানে বলি শোন সকলে, আমার জন্ম তোমার জন্য, দেখা না হলে একদিন, একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তি সেনার দল, প্রেম প্রীতি আর ভালোবাসা, পৃথিবীতে সুখ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, আমি যে তোমার কে, আমাদের ছোট নদী, এত ছোট জনম নিয়া জগতে আসিয়া’র মতো দারুণ কিছু মৌলিক গান ।

চলচ্চিত্রের পর্দার আগুন নায়কদের কণ্ঠে যেমন ছিলেন তেমনি আবার হ‌ুমায়ূন ফরীদি, ডিপজলের মতো খলনায়কের কণ্ঠেও মানিয়ে যেতেন; আবার কখনো দিলদার, সুরুজ বাঙালি, আফজাল শরীফের মতো কৌতুক অভিনেতাদের কণ্ঠেও মানিয়ে যেতেন। আগুন এতটাই প্লেব্যাকে ব্যস্ত ছিলেন যে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে আগুন হলেন ওই জগৎ থেকে ওঠে আসা এখন পর্যন্ত সর্বাধিক সংখ্যক প্লেব্যাক করা ব্যক্তি। এমনকি তৎকালীন সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, মাকসুদ, শাফিনের মতো তারকারাও আগুনের মতো প্লেব্যাকে ব্যস্ত হতে পারেননি। ব্যান্ড লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর প্লেব্যাকে বেশ কিছু জনপ্রিয় গান থাকলেও গানের সংখ্যা ও জনপ্রিয়তার বিচারে আগুন ছিলেন এগিয়ে।

সানডে মানডে ক্লোজ কইরা ডে, মাইঙ্ককারে মাইঙ্কা কী বাত্তি জ্বালাইলি, ও ছেমড়ি তোর কপাল ভালো পাগলা বাবার নজর পইরাছে, পুত কইরা দিমু তোরে’সহ ডিপজলের জন্য আগুন বেশ কিছু সস্তা চটুল গান করেছেন, যা শ্রোতাদের আহত করেছিল। কিন্তু পেশাদারির বিচারে গেলে সে সব গানে কণ্ঠ দেওয়াটা আগুনের ভুল ছিল না।

চলচ্চিত্রের গানে আগুন বেঁচে থাকবেন চিরদিন তার কণ্ঠের চিরসবুজ গানগুলোর জন্য। আগুন যদি ৯০ দশকের না হয়ে এখনকার কণ্ঠশিল্পী হতেন তাহলে তার কণ্ঠ এই ডিজিটাল প্রজন্মের সংগীত পরিচালক ও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারতো না। কারণ এখন মেধা ও মন দিয়ে মূল্যায়ন হয় না, মূল্যায়ন হয় যন্ত্র দিয়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া দিয়ে।


মন্তব্য করুন