নাটকীয়, তবুও ম্যাড়মেড়ে ‘বীরত্ব’
বীরত্ব; ধরন: সোশ্যাল ড্রামা; পরিচালনা: সাইদুল ইসলাম রানা; অভিনয়: ইমন, নিশাত নওয়ার সালওয়া, ইন্তেখাব দিনার, নিপুণ, আহসান হাবিব নাসিম, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পী সরকার অপু, মাহমুদুর রহমান মিঠু, মনিরা মিঠুসহ অনেকে; প্রযোজনা: পিং পং এন্টারটেইনমেন্ট; মুক্তি: ১৬ সেপ্টেম্বর
ইন্তেখাব দিনার ও ইমন
ইমন পেশায় চিকিৎসক। ঘটনাক্রমে সে একটি পতিতালয়ে যায় এবং সেখানকার নারীদের যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক শিক্ষা দেয়। এক সময় তিনি পতিতালয়ের আড়ালে নারী-শিশু পাচার ও মাদক চোরাচালানের ইন্ধন খুঁজে পান। এই সবকিছুর মূলে রয়েছে আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়া ব্যবসায়ী মুসা আহমেদ (ইন্তেখাব দিনার)। তিনি তার রাইট হ্যান্ড দিয়ে সমস্ত চোরাকারবারি কন্ট্রোল করে থাকেন। ডাক্তারি পড়ুয়া ইমন কীভাবে এই বড় মাফিয়া গ্যাং-এর বিপক্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং তিনি কীভাবে মোকাবেলা করে, সেই গল্প নিয়ে ‘বীরত্ব’।
ছবির ভালো দিকগুলো
গল্পটি প্রথমার্ধে একটু গতানুগতিক মনে হচ্ছিল। বাহুবলী টাইপ চরিত্র থাকবে, তিনি পারেন না এমন কিছু নেই। একটা সৎ-সাধারণ চরিত্র থাকবে, যিনি সৎভাবে মানুষের সেবা করতে চান। ঘটনাচক্রে এই দুই ধারার মানুষ একে-অন্যের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে। এই ধরনের ক্লিশে স্টোরিলাইন আমরা বহু সিনেমায় দেখেছি।
তবে আমার ধারণা কিছুটা ভাঙে সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে। সীমারেখা যতটুকু আন্দাজ করেছিলাম, গল্পটি তার থেকেও বেশি ডালপালা মেলেছে এ অংশে গিয়ে। যার ফলে সিনেমাটি শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের নতুন কিছু দিতে পারে। আর গল্পের শেষটা করা হয়েছে খুব সুন্দরভাবে, যার কারণে একটু হলেও ‘বীরত্ব’ দেখে তৃপ্তি পাওয়া গেছে।
পার্শ্বচরিত্রদের পোক্ত অভিনয়: ভালো লেগেছে নিপুণ ও আহসান হাবিব নাসিমের অভিনয়। নিপুণের চরিত্রের ব্যপ্তি ছিল প্রথমার্ধে, তবে তার পারফরম্যান্স ভালো ছিল। অন্যদিকে নাসিমের ব্যপ্তি ও গুরুত্ব লিড রোল থেকে কোনো অংশে কম না! তাকে শুরুতে চিনতে পারিনি। লুক, গেটআপ, অভিনয়ের প্যাটার্নে খুব ভালো পরিবর্তন আনতে পেরেছেন তিনি।
ইন্তেখাব দিনারও খুব দারুণ একটা পারফরম্যান্স দিয়েছেন। তবে আফসোসের বিষয় হলো, তার চরিত্রটা একদম টিপিক্যাল ভিলেনের মতো। বিশেষ কোনো বৈচিত্র্য নেই। তাই তার শক্তিশালী অভিনয় থাকা সত্ত্বেও এটি নিয়ে বেশি উচ্ছ্বাসা প্রকাশ করা যায় না।
এ ছাড়া প্রচুর ক্যামিও রয়েছে। ছোটখাট চরিত্রে মিডিয়ার সব পরিচিত মুখদের নেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছিল, যেদিকে দেখছি সেখানেই পরিচিত মুখ দেখতে পাচ্ছি! তো পরীক্ষিত অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে ভালো পারফরম্যান্সই পাওয়া গেছে।
চিত্রগ্রহণ: কারিগরি অংশের এই দিকটার প্রশংসা আলাদাভাবে করতেই হয়। পরিচালক সাইদুল ইসলাম রানার প্রথম চলচ্চিত্র। তবে ধারণা করছি তিনি এর আগে টিভি মিডিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন। টিভির পরিচালক বিরুদ্ধে আমাদের একটা কমন অভিযোগ থাকে, তাদের সিনেমায় সিনেম্যাটিক ফিল পাওয়া যায় না। নাটক-নাটক লাগে। এই সিনেমায় আমার সেটা মনে হয়নি। বরং হরেক রকমের ক্যামেরাওয়ার্ক দেখতে পাওয়া গেছে। ড্রোন শট, এরিয়াল শটের যথাযথ ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এইদিকটা ভালো লেগেছে
ছবির খারাপ দিকগুলো
চিত্রনাট্য ও সংলাপ: গল্প ভালো হলেও ‘বীরত্ব’-এর চিত্রনাট্য খুবই সমতল, একইসাথে ম্যাড়মেড়ে। এমন না যে, পর্দায় কিছু হচ্ছে না। হচ্ছে, সবই হচ্ছে। নাচ-গান-মারামারি-ড্রামা সবই হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে ইমোশনের খুবই অভাব। চিত্রনাট্যে সেরকম ভালোভাবে কোনো উত্থান-পতন তৈরিই হয়নি! কোনো বিশেষ সিকোয়েন্সের জন্যে আগাম কোনো বিল্ডআপ দেওয়া হয়নি। শুধু আমাদের চোখের সামনে আসছে, আর বেরিয়ে যাচ্ছে।
কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সিনেমার দৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও বেশির ভাগ সংলাপ ও পাঞ্চলাইন আরোপিত মনে হয়। একটা নাটকীয় ঢংয়ে সংলাপগুলো সাজানো, যার কারণে একটু-আধটু ক্লিশেও লাগে!
বিজিএম, এডিটিং ও অন্যান্য কারিগরি দিক: কারিগরি বিভাগে মধ্যে শুধুমাত্র ডিওপির কাজটাই একটু মনমতো পাওয়া গেছে। বাকি কোনো কাজই ভালো হয়নি। সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর লেগেছে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। সিনগুলোকে যথাযথভাবে তুলে আনতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কোনো ভুমিকাই রাখতে পারেনি। বরং অনেক সিকোয়েন্সের ভ্যালু নষ্ট করে দিয়েছে। খুবই খাপছাড়া কাজ হয়েছে।
গল্প অনুসারে এ সিনেমার দৈর্ঘ্য বেশ বড়। ২ ঘণ্টা ৩২ মিনিটের জায়গায় ১৫-২০ মিনিট কম হলেও ক্ষতি ছিল না, কিছু সিকোয়েন্স কাট করে ফেলা যেতো। বাকি সবগুলো ডিপার্টমেন্ট থেকে এভারেজ মানের আউটপুট পাওয়া গেছে।
মূল চরিত্রদের অভিনয়: ‘বীরত্ব’ সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইমন ও নিশাত নওয়ার সালওয়া। ইমন যথারীতি এবারও লিড রোল নিয়ে একটি সিনেমা ডুবিয়েছে। ইমন-নিরব সিনেমাতে কাজ করছে প্রায় ১ যুগেরও বেশি সময় হতে চললো। এখনো উনারা এদের পজিশন শক্ত করতে পারেনি, শুধুমাত্র দূর্বল পর্দা উপস্থিতির কারণে।
ইমনের উপস্থিতি এত দূর্বল যে একটিবারের জন্যও উনাকে এই গল্পের ‘বীর’ মনে হয়নি। অবশ্য এর পেছনে কাস্টিংয়েরও দায়ভার আছে। আপনারাই দেখুন, কাদের বিরুদ্ধে ইমনকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে? ইন্তেখাব দিনার, আহসান হাবিব নাসিমদের মতো শক্তিশালী অভিনেতাদের বিরুদ্ধে। তাদের সামনে তো ইমনের ক্যাপাবিলিটি বাচ্চাদের মতোই!
নতুন নায়িকা নিশাত নওয়ার সালওয়ার অভিনয়ও ভালোলাগেনি। তার অভিব্যক্তিতে প্রচুর জড়তা আছে, নতুন হিসেবে অবশ্য এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। অভিনয়ও গড়পড়তা। সবমিলিয়ে উন্নতির জায়গা রয়েছে।
‘বীরত্ব’ একবার দেখার মতো সিনেমা। আগাগোড়া কমার্শিয়াল ফরমেটে বানানো, কিন্তু বোরিং লাগার মতো প্রচুর মোমেন্ট আছে এখানে। তবে পরিবার নিয়ে দেখা যাবে।
রেটিং: ৫/১০