নাটক ও চলচ্চিত্রের পার্থক্য এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটের দীর্ঘনাটক
কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একজনের সাথে তর্ক হয়েছিল বর্তমানের বেশকিছু চলচ্চিত্রকে সে লম্বা নাটক আখ্যায়িত করায়। সেই ভাবনা থেকেই এই লেখার প্রয়াস।
চলচ্চিত্র বা সিনেমার আদিকালে খুব সহজেই বলা হতো সিনেমা হচ্ছে চলমান চিত্র। যা অন্য কলায় অনুপস্থিত ছিল। কালের পরিক্রমায় সেই চলমান চিত্রে যুক্ত হয়েছে শব্দ, কাহিনী, সংবাদ, সংগীত, নৃত্যকলা, চিত্রকলা, সাহিত্য, নাটকের নাটকীয়তা, ক্যামেরার নানান খেলা, রঙ্গের খেলা, আলোছায়ার খেলা, এডিটিং এর নানা কলাকৌশল, বিজ্ঞানের নানান জটিল আবিষ্কার। মোদ্দাকথা চৌষট্টি কলার সকল কলার সংমিশ্রণে তৈরী হয়েছে এক নতুন ও অসম্ভব শক্তিশালী ভাষা। যে কারনে সারা পৃথিবীতে এর এত জনপ্রিয়তা। আমরা কি পারছি এই শক্তিশালী ভাষার যথাযথ ব্যবহার করতে ?
আমাদের মুরুব্বীরা দেখেছেন আমাদের চলচ্চিত্রের উত্থান ও পতন। আমাদের চলচ্চিত্রের এই পতন কেন? কিভাবে? সে প্রসঙ্গের অবতারনা করতে চাচ্ছিনা। কারন সেটা নিয়ে বিগত দিনে নানামুনীর দ্বারা ঢের আলোচনা হয়েছে। আমার সেই ফেসবুক বন্ধু যখন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন বর্তমানের কিছু চলচ্চিত্র আর টিভি নাটকের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? বর্তমানের টিভি নাটকের নির্মাণ কৌশল ও কিছু সিনেমার নির্মান কৌশলের মধ্যে পার্থক্যের মাত্রা কতটুকু? আমি ক্ষনিকের জন্য দ্বিধান্বিত হয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে পার্থক্য খোঁজার আগে এটা জানা জরুরী একটি স্বার্থক চলচ্চিত্র কি?
নাটকের স্থান যখন ছিল মঞ্চে তখন দর্শকের প্রতিক্রিয়াই বলে দিত নাটকটি স্বার্থক না ব্যর্থ। মঞ্চের নাটকের সাথে দর্শকের যে সরাসরি সম্পর্ক তা সিনেমায় অনুপস্থিত। এখানে সম্পর্ক স্থাপিত হয় ক্যামেরার মাধ্যমে, অনেকটা অন্যের জবানীতে কোন নাটকীয় ঘটনার বিবরন শোনার মতো। বর্ণনাদাতার নাট্যরসের উপর নির্ভর করে শ্রোতা কতটুকু প্রভাবিত হবে। সিনেমার ক্যামেরা এই বর্ননাদাতার ভুমিকা গ্রহন করে। আর তাই পুরো ব্যপারটি এমন হয়ে যায় যে, পরিচালক তার আজ্ঞাধীন ক্যামেরার সাহায্যে গল্পটি কিভাবে পরিবেশন করে শিল্পরসের সঞ্চার করছেন। এই ব্যপারটি প্রথম অনুধাবন করেছিলেন অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন মার্কিন পরিচালক ডি. ডব্লিউ গ্রিফিথ। জর্জ মেলিয়েস যেভাবে কাহিনীচিত্র নির্মান শুরু করলেন গ্রিফিথ তার সাথে যুক্ত করলেন ক্যামেরার নানান ধরনের শট ও দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন, দৃশ্যবস্তুর সুক্ষতম পর্যবেক্ষন, আলোক সম্পাতের নাটকীয় বৈচিত্র, বিষয়বস্তুর বিরাট প্রসার ও মাহাত্ব্য। গ্রিফিথ গল্প বলার প্রয়োজনে ক্যামেরার শটের খেলা, আলোছায়ার খেলা ও সর্বোপরী সম্পাদনার যাদু জোড়ে দিয়ে সিনেমাতে এক মায়াবী প্রাণের সুচনা করলেন। সেই মায়াবী যাদু আজও বারবার দেখার জন্য সব মানুষ ছুটে চলে সিনেমা থিয়েটারে।
চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বুঝতে হবে দর্শক কি বুঝে, কি চায়, কিসে খুশী হয়। দর্শক চায় নিটোল প্লট সম্বলিত কাহিনী – তা রোমান্টিক হোক বা কমেডি হোক কিংবা ট্র্যাজিডিই হোক, সমসাময়িক হোক বা পৌরানিক বা ঐতিহাসিক হোক অথবা লোকগাথা। দর্শক চায় গতিময় কাহিনী। অনেক সময় একটা হাল্কা গল্পকেও ছুটতে হয় উদ্দাম বেগে, আর সেই সঙ্গে ছুটে চলে মানুষ, ঘোড়া, মোটরগাড়ী, প্লেন ইত্যাদি সবকিছুই। এদের সঙ্গে ক্যামেরাও যদি ছোটে, তবেই দর্শকের মনও এই ছুটার সঙ্গে একাত্ব হয়ে ছুটে চলতে পারে। এই ক্যামেরার গতির সঙ্গে আবার এডিটিং এর শট-পরিবর্তনযুক্ত গতি যুক্ত হয়ে পুরো গতিটাই আরো দশগুন বেড়ে যেতে পারে। এই গতিময় কাহিনীতে যদি থাকে নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত, সুদর্শন নায়ক-নায়িকা, মনোরম বহির্দৃশ্যাবলি ও ছিমছাম সুদৃশ্য পরিবেশ, শ্রুতিমধুর গান, দৃষ্টিনন্দন নৃত্য এবং অন্যান্য রসের একটা উপভোগ্য সমন্বয় তাহলে দর্শকের মনটাই ভরে যায়। এগুলিই পায় স্বার্থক কাহিনী চিত্রের তকমা। এগুলিই পাওে নাটকের সাথে সিনেমার পার্থক্য গড়ে দিতে। আর যখন কোন সিনেমাতে উপরোল্লেখিত উপাদান না থাকবে তখন তাকে দর্শক লম্বা নাটক বলবে না তো কি বলবে ?
বেশ কয়েকবছর থেকে আমি অনেককে দেখছি কিছু আদমসন্তান প্রথমে কোন নাটক বা সিনেমার সেটের চারপাশে ঘুরঘুর করে। কয়েকদিন পর থেকে এরা কোনরূপ প্রাতিষ্ঠানিক বা হাতেকলমে শিক্ষা গ্রহন না করেই হঠাৎ একদিন কোন নাটক বা সিনেমা বানাননোর কাজে হাত দিয়ে বসেছে। যখন তাদো প্রশ্ন করেছি এটা কিভাবে সম্ভব? তারা দাঁত কেলিয়ে জবাব দিয়েছে “একখান মালদার পার্টি পাইছি ভাই। তাই একটু রিস্ক নিলাম”। তখন অনুভব করেছি এভাবেই এধরনের অদক্ষ লোকের কারনেই আমাদের সিনেমার মান নিচুতে নেমেছে। প্রজোযক হারিয়েছেন মুলধন। ফলে প্রকৃত মেধাবী ও দক্ষদেরও নতুন ভাল কিছু করার রাস্তা বন্ধ হয়েছে। তাই শ্রদ্ধেয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা তারা যেন আগে ক্যামেরার ভাষা, আলোক সম্পাতের কৌশল এবং সম্পাদনার উপর প্রয়োজনীয় প্রঞ্জা লাভ করে তারপর আমাদের মায়াবী যাদু (সিনেমা) দেখানো শুরু করেন।
০৯/০৯/১৩ইং
ধন্যবাদ ।