Select Page

নান্দনিক এক অধ্যায় বিপাশা

নান্দনিক এক অধ্যায় বিপাশা

ক্যালেন্ডারের হিসেবে সময়টা ১৯৮৩ সাল। সেই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিটিভিতে ‘খোলা দুয়ার’ নামের একটি নাটকে আবুল হায়াতের মেয়ের চরিত্রে ১২-১৩ বছরের একজনকে প্রয়োজন। নাটকের রচয়িতা মামুনুর রশীদ তার লেখা গল্প এবং চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে অবশেষে যাকে সেই নাটকের জন্য চূড়ান্ত করলেন তিনি সত্যিই আবুল হায়াতেরই বড় মেয়ে, যার নাম বিপাশা। এই নাটক দিয়েই অভিনয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠলো পরবর্তীতে দেশের কিংবদন্তি অভিনেত্রী খেতাব পাওয়া বিপাশা হায়াতের। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই জনপ্রিয় অভিনেত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে এই বিশেষ ফিচার।

অভিনেত্রী হিসেবে বাংলাদেশের টেলিভিশন এবং অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্র দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এই মানুষটি ক্যারিয়ারের নানা সময়ে শিল্পের বিভিন্ন জায়গায় নিজের দক্ষতা এবং জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। অভিনয়, গান, চিত্রশিল্পী, গায়িকা, লেখক সব মিলিয়ে এটা বলাই যায় যে বিপাশা হায়াত যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। তার অসাধারণ সৌন্দর্য, বাচনভঙ্গি, অভিনয় দক্ষতা, মিষ্টি হাসি সব মিলিয়ে তিনি অনন্য এক নাম।

বাবা দেশের অন্যতম গুণী এবং শক্তিশালী অভিনেতা হিসেবে সম্মানিত এক নাম। তাই হয়তো বাবার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ দেখে নিজেও সংস্কৃতির এই মাধ্যমে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় মঞ্চে বিপাশার যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। দেশসেরা নাট্যদল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে অভিনয় শিল্পী হিসেবে অভিনয় শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন তিনি। তবে একটা পর্যায়ে অভিনয়ের পাশাপাশি সেট ডিজাইনার হিসাবেও ছোটখাটো কাজ করতে থাকেন বিপাশা। এরই মধ্যে ১৯৮৯ সালে বিটিভিতে অভিনয় শিল্পী হিসেবে নিবন্ধিত হন তিনি। বিপাশা হায়াত প্রথমবার দর্শকদের নজরে আসেন হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ নাটকে ‘লবঙ্গ’ চরিত্রে অভিনয় করে। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পাওয়া এই নাটকে আরও অনেক চরিত্রের সাথে ‘লবঙ্গ’ রূপে বিপাশা হায়াত জনপ্রিয় অভিনেত্রী বনে যান।

এরপরে পুরো নব্বই দশকটা বিপাশা-শমী-মিমিতে ডুবে থাকা বাংলাদেশের টিভি দর্শকদের কাছে ভালো নাটক মানেই এই তিনজন। বিপাশা অভিনীত তুমুল জনপ্রিয় হওয়া নাটকগুলোর মাঝে ‘রূপনগর’, ‘একজন অপরাধিনী’, ‘নাইওরি’, ‘হারজিত’, ‘ছোট ছোট ঢেউ’, ‘বোধ’, ‘প্রত্যাশা’, ‘দোলা’, ‘হাসুলি’, ‘দ্বৈরথ’, ‘প্রতি চুনিয়া’ অন্যতম। নাটকে অভিনেত্রী হিসেবে জনপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি সেই সময়টাতে ‘তৌকির-বিপাশা’ এবং ‘জাহিদ হাসান-বিপাশা’ জুটি দুটিও জনপ্রিয় ছিল সাধারণ দর্শকদের কাছে।

বাংলাদেশের প্রথম প্যাকেজ নাটকের নায়িকা ছিলেন বিপাশা হায়াত। কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত চরিত্র ‘মাসুদ রানা’ অবলম্বনে সেই নাটকের নাম ছিল ‘প্রাচীর পেরিয়ে’। দেশসেরা মডেল নোবেলের সঙ্গে জুটি বেঁধে সেই নাটক দিয়েই বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকে অন্য যুগের সূচনা হয়েছিল। সঙ্গে বিশ্বখ্যাত জনপ্রিয় ব্র‍্যান্ড লাক্সের মডেল হিসেবে এই দশকেই তার আগমন ঘটে। এর আগে জনি প্রিন্ট শাড়ির বিজ্ঞাপনে কাজ করলেও লাক্স তার ক্যারিয়ারে আলাদা মাত্রা যোগ করে। পরবর্তীতে আরও অনেক পণ্যের বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে এই জনপ্রিয় তারকাকে।

১৯৯৭ সালে ‘শুধু তোমাকে জানি’ নামের একটি সিরিয়াল লেখা শুরু করেন। তবে ইচ্ছে করেই তিনি তার নাম প্রকাশ করেননি তখন। ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন, যাতে করে শুধুমাত্র তার নামের কারণে নাটকটি জনপ্রিয়তা না পায়। কিন্তু টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর যখন সিরিয়ালটি তুমুল জনপ্রিয় হয়, তখন বিপাশা হায়াত তার লেখক সত্তা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ‘ভালোবাসা জেগে থাকে প্রাণে’, ‘ডাইনোসর’, ‘মরা জোছনা’, ‘মধ্যরাত ও ঝরা পাতার গল্প’, ‘ছায়া’, ‘এ কী খেলা’ এ রকম প্রায় অর্ধশত জনপ্রিয় নাটকের রচয়িতা হিসেবেও বিপাশা হায়াত তার দক্ষতা দেখিয়েছেন।

সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত কালজয়ী ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের অফার পেয়েছিলেন বিপাশা। তবে বাণিজ্যিক সিনেমার প্রতি তার কোনোকালেই সেরকম আগ্রহ না থাকায় তিনি এই অফার ফিরিয়ে দেন। তবে তার পরের বছরেই হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’তে রাত্রি চরিত্রে তার অভিনয় মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। যার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রথম সিনেমা দিয়েই লাভ করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অনেক বছর বাদে তৌকির আহমেদের পরিচালনায় ‘জয়যাত্রা’ সিনেমাতে সন্তান হারিয়ে ফেলা এক মা হাওয়া বিবি চরিত্রে আরও একবার আমাদের চমকে দেন তিনি। এই সিনেমাটিও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছিল।

এ ছাড়া আবৃত্তিকার হিসেবেও বিপাশা হায়াতের সুনাম রয়েছে। বিপাশার অনেক নাটকের আবহ সংগীতের কাজ তিনি নিজেই করেছেন। বাংলাভিশন চ্যানেলের হয়ে ‘বিপাশার অতিথি’ নামে একটা টক-শো উপস্থাপনা করেছেন তিনি, যেটি সেই সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

এত কিছুর মাঝেও বিপাশা হায়াতের আরেকটি পরিচয় যা তার ব্যক্তিসত্তার অংশ হিসেবে আমাদের কাছে আলোচিত এবং প্রশংসিত সেটি হচ্ছে একজন চিত্রশিল্পী বিপাশা হায়াত। ১৯৯৮ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে এমএফএ পাশ করেন তিনি। সেই সময়টা অভিনয় নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকলেও আঁকাআঁকিটা তিনি কখনো একেবারে ছেড়ে দেননি। ১৯৯৬ সালে গ্যালারি টোনে তিনি মিনিয়েচার পেইন্টিং এক্সিবিশন করেন। ১৯৯৮ সালে গ্রুপ এক্সিবিশন করেন হোটেল সোনারগাঁওয়ের ডিভাইন আর্ট গ্যালারিতে। ২০০১ সালে জয়নুল গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী করেন ৯ জন তরুণ শিল্পীর সঙ্গে। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও ইতালিয়ান রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতেও অংশ নেন বিপাশা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও অরনীর আয়োজনে ২০১০ ও ২০১১ সালের দুটি আর্ট ক্যাম্পেও অংশ নেন বিপাশা। ২০১৬ সালে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত প্রদর্শনীতে সম্মাননা লাভ করেন। সেখানে ৫৪টি দেশের ২৯৮ জন চিত্রশিল্পী তাদের ৪৩৪টি ছবি প্রদর্শন করেছিলেন। বইমেলায় প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবেও সরব উপস্থিতি রয়েছে বিপাশার। পাশাপাশি সিনেমার পোস্টারেও নিজের নামের মর্যাদা রেখেছেন এই গুণী মানুষটা।

এত পরিচয়ের মাঝে গায়িকা বিপাশা হায়াতকে মনে না করাটা অন্যায় হবে। হানিফ সংকেতের সঞ্চালনায় জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে গেয়েছিলেন ‘আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা’ এ ছাড়া আব্দুন নূর তুষারের সঞ্চালনায় আরেকটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘শুভেচ্ছা’তে গেয়েছিলেন ‘নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক’ গানটি। বিটিভিতে ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ বা বিশেষ বৈশাখী সংগীতানুষ্ঠানে গেয়েছেন ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া ‘আজি বাহাল করিয়া বাজান গো দোতরা সুন্দরী কমলা নাচে’ গানটি। সংস্কৃতির এই মাধ্যমে তিনি সময় দিতে পারেননি তেমনভাবে, দিতে পারলে হয়তো গায়িকা হিসেবেও বিপাশা হায়াত জনপ্রিয় গায়িকা হিসেবেও নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারতেন।

ক্যারিয়ারে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন প্রথমদিকেই। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে ১৯৯৮, ১৯৯৯ আর ২০০০ সালে টানা তিনবার জনপ্রিয় বিভাগে শ্রেষ্ঠ টিভি অভিনেত্রী নির্বাচিত হন তিনি। এ ছাড়া বাচসাস পুরস্কার, যায় যায় দিন পুরস্কার, অন্যদিন-ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পুরস্কার, ইউনেসকো পুরস্কার, কালচারার রিপোর্টার্স পুরস্কার, ঢালিউড পুরস্কারও অর্জন করেছেন বিপাশা হায়াত তার অভিনয় দক্ষতার জন্য।

একটা সময় মনমতো গল্প বা বয়স অনুযায়ী ব্যতিক্রমী চরিত্র না পাওয়ায় কিছুটা ক্ষোভ থেকেই অভিনয় থেকে বিরতি নেন এই গুণী অভিনেত্রী। বিশেষ দিবস বা নিজের কাছে ভালো লেগেছে এমন স্ক্রিপ্ট পেলেই হঠাৎ করে দু-একটা কাজে দেখা গেছে বিপাশাকে। তবে তা যেন তৃপ্ত করেনি তার ভক্তদের। সেই সময়টায় আঁকাআঁকিতে মনোযোগী হয়েছেন। সেটাও সংস্কৃতির আরেকটা মাধ্যমকে সমৃদ্ধ করেছে তাও বা কম কি!!

এখন ওটিটির কল্যাণে ভিন্নধর্মী এক্সপেরিমেন্টাল অনেক কাজ দেখার সুযোগ মিলছে আমাদের। পাশের দেশে নব্বই দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিত বা রাভিনা ট্যান্ডন এখন এই ওয়েব দুনিয়াতে হাজির হচ্ছেন বয়সের সঙ্গে মিল রেখে ব্যতিক্রমী চরিত্রে৷ সামনের দিনে আমাদের দেশেও এই মাধ্যমে বিপাশা হায়াত, শমী কায়সার বা আফসানা মিমিকে নিয়ে নতুন ভাবে ভাববেন আমাদের নির্মাতা এবং লেখকেরা এটুকু আশা করাই যায়।

ব্যক্তিজীবনে বিশিষ্ট অভিনেতা আবুল হায়াত এবং মা শিরিন হায়াতের বড় কন্যা হিসেবে বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছেন বিপাশা। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ জন্মগ্রহণ করা এই সফল এবং গুণী অভিনেত্রী পার করছেন জীবনের ৫১ তম বসন্ত।

ছোট বোন নাতাশা হায়াত ও অভিনয় মাধ্যমে কাজ করেছেন অল্প সময়। নাতাশার স্বামী শাহেদ শরীফ খান একটা সময়ে অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। বিপাশা হায়াত নব্বই দশকের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা তৌকীর আহমেদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৯৯ সালে। কন্যা আরিশা আহমেদ এবং পুত্র আরিব আহমেদকে নিয়ে সুখেই সংসার করছেন এই তারকা দম্পতি। সম্প্রতি সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় থিতু হলেও শিগগিরই আবারও ফিরবেন অভিনয় জগতে এমনটাই আশা তার অগণিত ভক্তদের।


About The Author

আফজালুর ফেরদৌস রুমন

শখের বশে চলচ্চিত্র ও নাটক নিয়ে লিখি

Leave a reply