নারী ও তার প্রেমের গল্প
নারীর মন
পরিচালক – মতিন রহমান
শ্রেষ্ঠাংশে – শাবনূর, রিয়াজ, শাকিল খান, প্রবীরমিত্র, খালেদা আক্তার কল্পনা, কাবিলা, আফজাল শরীফ প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য গান – জীবনে বসন্ত এসেছে, ঘুমিয়ে থাকো গো সজনী, মীরাবাঈ, মোস্তফা মোস্তফা।
মুক্তি – ৯ জানুয়ারি ২০০০
‘এই পৃথিবীর সেরা অবাক বিস্ময়
তুমি প্রেমিকা জননী আগুন পানি
তুমি সর্বভূমি’…♥
কথাগুলো যাকে নিয়ে সে হলো নারী। রহস্যময় চরিত্র এই নারী। অনেক রূপ তার, চিনে নিতে লাগে সাধনা। নারীর মনকে জানতে, বুঝতে তার প্রেমিক হতে হয়। সত্যিকার প্রেমিক তাকে জানতে পারে। সাফল্য, ব্যর্থতায় মোড়ানো নারীর মন নিয়ে প্রেমিকের ভালোবাসার গল্পের ছবি ‘নারীর মন।’ প্রেমদরদী নির্মাতা মতিন রহমান-এর ছবি। ঈদের ছবি ছিল।
কলেজ রোডের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে কিছু মুখ যাদের দুজন রিয়াজ ও শাকিল খান। কৃষ্ণচূড়া ফুলের পাপড়িতে ভরে গেছে কলেজ রোড। কেউ একজন গেট দিয়ে ঢুকবে। কে সে? মেয়েটি ঢুকল গেট দিয়ে খুব সযতনে ফুলের পাপড়িগুলোকে না মাড়িয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখে সেলুনে নাপিত চুল কাটতে গিয়ে মাথাটাই মুড়িয়ে ফেলল কাস্টমারের টের পেয়ে লোকটি বলল-‘ঐ আমার চুল কি করলি, আমার চুল ফিরিয়ে দে।’ ফিলিং স্টেশনে ডিজেল চলে যাচ্ছিল বাইরে। ভুলগুলো হয়ে গেল ঐ মেয়েটিকে দেখে। আবৃত্তি আসল-
‘ও কমল পদযুগল
চুমিয়ে দিতে ব্যর্থ হলো ঝরাফুল
অশ্রু ঝরালো।’
মেয়েটি ছিল শাবনূর। শাবনূরকে দেখে সবাই হা করে তাকিয়ে ছিল। ক্যাম্পাস লাইফে প্রেমের গল্প তো এভাবেই শুরু হয় অনেকের তাই ছবিতেও পরিচালক সেটাই রেখেছেন।
শাবনূর তো জানে না তাকে কে ভালোবাসে! নিজে বন্ধুত্ব করে মিশতে গিয়ে শাকিল খানকে ভালোবেসে ফেলে। শাকিল তো পরে জানতে পারে তার বন্ধু রিয়াজও ভালোবাসে শাবনূরকে। তখন তার আর কিছুই করার থাকে না। যে শাবনূরকে রেললাইনে পা আটকে যাওয়া মরণফাঁদ থেকে বাঁচিয়েছিল সে তাকে কি করে আর একজনের হাতে তুলে দেবে! হোক যতোই বন্ধু। নারীর মনের একটা দিক এখানেও দেখা যায়। নারীর মনের প্রেমের পরশ যে প্রেমিক পায় সে সহজে কাউকে তার প্রেমিকার ভাগ আর কাউকে দিতে পারে না হোক সে যতই আপন।
প্রেমের ছবিতে কি শুধুই প্রেম থাকতে হবে! মিনিটে মিনিটে গান বা ধাক্কা খাওয়া, চোখাচোখি এসব করেই আড়াই, তিন ঘণ্টা পার করতে হবে! নাহ, একদম না। প্রেমের ছবিতে দেখানোর মতো আরো অনেককিছু থাকে। রিয়াজ-শাকিলের বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে। রিয়াজ গরিবের ছেলে তাই শার্ট/প্যান্ট কিনতে গিয়ে যখন দামের কারণে ফেরত আসে স্টল থেকে সেটা শাকিল দেখে ফেলে। যে কাপড়গুলো রিয়াজ পছন্দ করেছিল সেগুলো শাকিল কিনে আনে। রিয়াজ প্রথমে স্বাভাবিকভাবে নিতে না পারলে বন্ধুত্বের কথা বলে শাকিল। বলে বন্ধু হলো মোস্তফা মানে বিশ্বাসী। তখনকার হাইপ তোলা গানের একটি শুরু হয়-
‘মোস্তফা মোস্তফা ডোন্ট ওরি মোস্তফা
আমি তোর বন্ধু মোস্তফা।’ (হিন্দি-র বাংলা ভার্সন ছিল)
ঘুড়ি ওড়ানোর সংস্কৃতি কি এখন আছে! নিতান্তই কম। এ ছবিতে ছিল। ছিল ক্যাম্পাস পলিটিক্সের মধ্যে প্রেমের বাণী। তুচ্ছ কারণে দুই কলেজের মধ্যে মারামারি হলে পুলিশ বলে-‘নারীর জন্য মারামারি না করে তাকে প্রেম দিয়ে জয় করো।’
নারীর মনকে বুঝতে না পেরে তাকে শুধু ‘মীরাবাঈ’-এর মতো বাঈজী ভাবলে ভালোবাসার অপমান হয়। জেমসের কণ্ঠে ‘মীরাবাঈ’ গানটি গভীরতা তুলে ধরে নারী ও প্রেমের। রিয়াজ শাবনূরকে নাচতে বলে আর তার প্রেমিককে খুশি করতে বলে। শাবনূর বলে-‘তোমরা পুরুষরা নারীকে বাঈজী মনে করো?’ এ অংশটা ছবির নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাবে যারা পুরুষতান্ত্রিক সেই সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটা ভাষা ছিল। প্রেমের ছবিতেও প্রতিবাদ করা যায় মতিন রহমান দেখান।
ত্রিভুজ প্রেম সবসময়ই বেদনার। শাবনূর তার মা-বাবা প্রবীরমিত্র ও খালেদা আক্তার কল্পনাকে জানায় তার দুই বন্ধুই তাকে ভালোবাসে। তাদের কাউকেই সে দুঃখ দিতে চায় না। মা-বাবা বোঝায় তারপরেও তাদের যেকোনো একজনকে তার গ্রহণ করতে হবে। ভালো বন্ধু মানেই ভালো স্বামী হবে এমনটা নয়। শাবনূর তাদের দুজনকে কবরস্থানে নিয়ে যায়। কবরে যারা অনন্তকালের জন্য ঘুমিয়ে আছে তাদের দেখিয়ে নিজের অবস্থা জানায়। নিজের দেহকে দুভাগ করে দিতে চায় দুজনকে। রিয়াজ তার ভালোবাসা জানায়নি, শাকিল জানিয়েছে। দুজনের সাফল্য, ব্যর্থতার অঙ্কে মাঝখানে চাপা পড়েছে শাবনূর। শাবনূর দেখায় তিনজনের জন্য তিনটা কবর। তারা মৃত্যুকে বরণ করে তিনজনই অমর হলে সেটাই ভালো। ছবি শেষ পর্যন্ত বলে দেয় নারীর মন বন্ধু, প্রেমিক ও জীবনসঙ্গীকে আলাদাভাবে খুঁজে নিতে চায়। ছবিতে আত্মহত্যাকে সমর্থন করা হয়নি এটা খুব ভালো মেসেজ ছিল। ভালোবেসে পেতেই হবে এমন ধারণাকেও নিরুৎসাহিত করেছে ছবিটি।
ছবির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তারুণ্য। ক্যাম্পাস লাইফে বয়সটাই এমন যে পুরো পৃথিবীটা নিজের মনে হয়। চঞ্চলতা, ভালোলাগা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, প্রেম এসব মিলিয়ে সময়টা কাটে। ‘নারীর মন’ ছবিকে তারুণ্যই আলাদাভাবে উপভোগ্য করে তোলে।
গান কত জনপ্রিয় হয় টাইম মেশিনে তখনকার সময়টাতে গেলে বোঝা যায়। ‘জীবনে বসন্ত এসেছে’ সুমধুর গান এ ছবির। গানে শাবনূর, রিয়াজ, শাকিল তিনজনের পারফরম্যান্সই পাগল করা। অসাধারণের থেকে বেশি কিছু। গানে পহেলা বৈশাখের উপস্থিতি ভালোবাসা আর সাংস্কৃতিক একটা মেলবন্ধন তৈরি করে যেটা ভিন্ন বিষয় ছিল। গানটি স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবখানে জনপ্রিয় ছিল, বাজানো হত বিয়েবাড়িতেও। তবে অনেকের ভুল একটা ধারণা আছে গানটি নিয়ে। অনেকে বলে গানটিতে বসন্তের কথা বলে পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতি দেখানো হয়েছে। এটা ভুল ধারণা। গানটিতে মানুষ যখন প্রেমে পড়ে বা জীবনে বসন্তের হাওয়া লাগে সেটাকেই বোঝানো হয়েছে সরাসরি বসন্তকালকে বোঝানো হয়নি। ‘ঘুমিয়ে থাকো গো সজনী ফুলেরও বিছানায়’ এ গানেও হাইপ ছিল। পিয়ানোর মধ্যে পায়রার হেঁটে যাওয়া দিয়ে গানের শুরু। গান মাঝপথে থেমে গেলে শাবনূরের সংলাপ-‘থামলে কেন গাও না জয়’ অপূর্ব। দ্বিতীয় অন্তরা তখন শুরু করে রিয়াজ-
‘এ ঘুম যেন নাহি ভাঙে
ও প্রাণ প্রিয়া রে।’
হাটে, মাঠে, বাজারে, চায়ের দোকানের ভিসিআরে এ গান বাজত তখন। বাংলাদেশী ছবি তখন ছিল মানুষের বিনোদনের বড় উৎস তাই যেটা ভালো লাগত সেটা নিয়ে মেতে থাকত।
সালমান শাহ-র অকালমৃত্যুর পরে ইন্ডাস্ট্রিতে রিয়াজ, শাকিলের আগমন তখনকার রোমান্টিক ছবির জন্য আশীর্বাদ ছিল। তারা ছিল তারুণ্যের ক্রেজ। শাবনূর অভিজ্ঞতায় ব্র্যান্ড ততদিনে। ‘নারীর মন’-এ তিনজনই অসাধারণ অভিনয় করেছে।
‘নারীর মন’ ছবি শুরুর আগে নির্মাতা মতিন রহমান বলে দেন-‘মুক্তোদানা খুঁজতে যেমন সাগরে যেতে হয় আমাদেরকেও তেমনি একটি বিদেশী গল্পের ছায়া অনুসরণ করতে হয়েছে।’ এ স্বীকারোক্তিটা আজকের দিনে নির্মাতারা অনেকেই স্বীকার করেন না। নজরুলের কবিতার ভাষায় যদি বলি –
‘কোনোকালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষী নারী’
একজন পুরুষ প্রেমিক হয়ে নারীর সেই প্রেরণাকে জয় করে নিতে পারে। ভালোবাসার মধ্যে যে শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হয় ছবিতে শাবনূর-রিয়াজ-শাকিলের ত্রিভুজ গল্পে দেখানো হয়।
এ যুগে ‘নারীর মন’ আর কে বানাতে পারে!