Select Page

মাকে নিয়ে মাস্টারপিস

মাকে নিয়ে মাস্টারপিস

মায়ের অধিকার
পরিচালক – শিবলি সাদিক
অভিনয় – সালমান শাহ, শাবনাজ, আলমগীর, ববিতা, হুমায়ুন ফরীদি, নাসির খান, ফেরদৌসী মজুমদার, দিলদার প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য গান – পিঁপড়া খাবে বড়লোকের ধন, তুই ছাড়া কে আছে, তুমি একটা চোর, পালকিতে চড়াইয়া ফুলবধূ সাজাইয়া
মুক্তি – ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৬

কম কাজ করে বিরল সাফল্য পাওয়া ক্ষণজন্মা অমর নায়ক সালমান শাহ। তাঁর ছবিগুলোর মধ্যে ভেরিয়েশন আছে অভিনয় ও বিষয় দুদিক থেকেই। প্রেমের ছবি যেমন করেছে, বিরহের, রাজনীতির, সামাজিক মূল্যবোধের ছবিও করেছে। পরিবারে সন্তানের অাত্মপরিচয় গঠনে মায়ের যে অশেষ ভূমিকা সেই মাকে নিয়ে সালমান শাহ-র ছবি ‘মায়ের অধিকার।’ মাকে নিয়ে যত ছবি হয়েছে আমাদের দেশে তার মধ্যে অনায়াসে এ ছবিকে আলাদা করা যায় ছবির বিশেষত্বের কারণেই।

নব্বই দশক ও ২০০০ পরবর্তী কিছু সময় টেপকর্ডারের একটা রমরমা অবস্থা ছিল। সিনেমাহল, টিভির পাশাপাশি ক্যাসেটে ছবি বের হত মার্কেটে। ছবি অডিও আকারে মার্কেটে ছাড়া হত। ‘মায়ের অধিকার’ ছবিরও ক্যাসেট ছিল। আমরা শুনতাম আর মুখস্থ করতাম সংলাপ, সিকোয়েন্স, গান।

ইসলাম ধর্মের কথা বললে সোজা বলা আছে-‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত।’ এ কথার গুরুত্ব অসীম। মা সন্তানকে পেটে ধারণ করে জন্ম দেয়া পর্যন্ত কষ্ট সহ্য করে। জন্মের পরও অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়। মা কোনো না কোনো ভাবে কারো প্রেয়সী থাকে তার ভালোবাসার দিনগুলোতে। ভালোবাসা থাকলে স্বপ্ন থাকবেই। সেই স্বপ্ন থেকে ছবিতে ববিতা একটা সুন্দর সংসার চেয়েছিল তার প্রেমিক আলমগীরের কাছে। কিন্তু স্বপ্নটা দুঃস্বপ্ন হয় আলমগীরের মা ফেরদৌসী মজুমদারের কারণে। ববিতা জাহান মণ্ঞ্জিলে যাবার পর অহংকার আর বংশ মর্যাদার দাপটে শ্বাশুগি তাঁকে বাড়িছাড়া করে কৌশলে। পরে ববিতা হুমায়ুন ফরীদির আশ্রয়ে এলে ভাইবোনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ‘গরিবের বস্তি’-তে চলে আসে। সেখানে সালমান শাহ-র জন্ম। অতঃপর তার জীবনে প্রেম এবং মায়ের বাস্তবতা জানার পর কৌশলে দাদীর জাহান মণ্ঞ্জিলে যায় নিজের মায়ের অধিকার আদায়ের জন্য। নানা নাটকীয়তা চলতে থাকে ক্লাইমেক্স পর্যন্ত।

ভাবছেন গল্পটা সোজাই তো! এত সোজাও না। এ গল্পকে সেলুলয়েডে ভরতে পরিচালক শিবলি সাদিক-কে অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। হাসিকান্না দুটোই আছে সেখানে। বিভিন্ন চিন্তাভাবনার মিশ্রণ আছে। দেখুন কি কি ছিল সেগুলো-
* সামাজিক অবস্থান :
ববিতার সামাজিক অবস্থান ছিল গরিব ঘরের মেয়ে। আনোয়ার হোসেন তার বাবা। তাঁকে ভালোবেসে ফেলে আলমগীর। তার আগে ববিতা দুর্ঘটনা থেকে উদ্ধার করে আলমগীরকে। বিয়ে করে। জাহান মণ্ঞ্জিলে যাবার পর আলমগীরের মা ফেরদৌসী মজুমদার কৌশল ঘটায়। প্রথমে মেনে নেয়ার ভান করলেও পরে ববিতাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সিঁড়িতে পা দিয়ে উপরে উঠতেই ববিতাকে থামিয়ে দেয়-‘দাঁড়াও ওখানেই দাঁড়াও। সামনের সিঁড়িগুলো পার হয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করো না।’ সামাজিক অবস্থান আলাদা করে দেয় ফেরদৌসী মজুমদার। পরে এই বাস্তবতাই সালমান শাহ বুঝিয়ে দেয় তাকে একই সংলাপে।
* বংশ মর্যাদা বাস্তবসম্মত :
বাংলা ছবি মানেই বংশ মর্যাদা, ধনী-গরিবের প্রেম এ ধরনের স্টেরিওটাইপ চিন্তা থেকে যারা বাংলা ছবির প্রতি নাখোশ তাদের জন্য কিছু কথা বলা জরুরি। সমাজে কি উঁচুনিচু ভেদ নেই? তারা কি অস্বীকার করতে পারবে? নিজে শহরে যে বাসায় থাকেন বাসা থেকে বের হয়ে রাজপথে আসতে যখন একটা রিকশা ভাড়া করেন তখনই সামাজিক ভেদাভেদটা নিজচোখেই দেখতে পান। এটাই ঘটেছিল অতীতে নইলে বড় জাত, ছোট জাত এ ধরনের বিষয়গুলো থেকে স্থান-কাল-পাত্র বা ‘আশরাফ-আতরাফ’ এ শব্দগুলোও অাসত না। ফেরদৌসী মজুমদার যে বংশ মর্যাদার বড়াই করেছে সেটা অত্যাচারী সমাজের একজন প্রতিনিধি হয়ে করেছে যারা ক্ষমতাকে কাজে লাগায়। এজন্য ক্ষমতার উৎসকে পরিবারকেই ধরা হয় যার প্রমাণ পেতে হাতের নাগালে ‘জীবন থেকে নেয়া’ দেখলেই পাবেন। চাবির গোছাটা যখন ফেরদৌসী মজুমদারের হাতে তখন তাঁর অহংকার বা ক্ষমতা বেশিই থাকবে। ববিতা নিম্নশ্রেণির প্রতিনিধি তাই তাকে সহ্য করতে হয়েছে কারণ সেটাই ঘটে সমাজে।
* রাষ্ট্রচিন্তা :
ছবিতে সূক্ষ্ম একটা রাষ্ট্রচিন্তা অাছে। ভাবছেন কি করে সম্ভব! সম্ভব। মন দিয়ে ভাবুন ছবির স্ট্রাকচার কি দিয়ে সাজানো। তিনটি স্টেজ আছে। একটা অত্যাচারী, একটা অত্যাচারিত আর একটা প্রতিবাদী। এই তিন তিনটি বিষয়কে একখানে করলে পাবেন একটা রাষ্ট্রীয় কাঠামো আর কে না জানে রাষ্ট্রকে তো ‘মা’ বলাই হয়। আপনার মায়ের উপর যখন অত্যাচার বা অবিচার হয় আপনি কি হাতে চুঁড়ি পরে ঘরে বসে থাকেন! না, আপনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। ফেরদৌসী মজুমদারের অন্যায়, অবিচারের বিপরীতে সালমান শাহ ও হুমায়ুন ফরীদি দাঁড়িয়ে যায়। সমাজ যে অন্যায়গুলো ঘটায় সমাজই সে অন্যায়ের প্রতিবাদের পথ তৈরি করে। বলতে পারেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। সালমান সেটা করে। ‘গরিবের বস্তি’ নামে যে জায়গাটির মালিক থাকে ফরীদি সেখানেও রাষ্ট্রচিন্তা আছে। স্বপ্ন দেখার একটা প্ল্যাটফর্ম সেটা। ঐ স্বপ্নটা ছোট থেকে বড় হয়। যারা স্বপ্ন দেখে তারা সবাই অত্যাচারিত বড়লোকের মাধ্যমে তাই তাদের প্রতিবাদের ভাষাও থাকে।
* প্রতিবাদের ভাষা :
প্রতিবাদ এসেছে কয়েকভাবে। প্রতিবাদ করার বিভিন্ন পদ্ধতি থাকে। গরিবের বস্তিতে সমবেত গানে ‘পিঁপড়া খাবে বড়লোকের ধন’ গানটি ধারালোভাবে দেখিয়ে দেয় কিভাবে শাসক আর শাসিতের মাধ্যমে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য চলে। অত্যাচারী সমাজের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে গানে গানে সালমান যখন বলে-
‘বড়লোকের ক্ষুধা এমন
হিংস্র বাঘের ক্ষুধা যেমন
শিকার ধরে করে নিবারণ।’
অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আর শাসিত মানুষেরা করুণ বাস্তবতার মধ্যে দিন কাটায় তাদের বাস্তবতা থাকে এমন-
‘দুধের লাইগা শিশু কান্দে
মায়ে বুকে পাথর বান্ধে
এই তো মোদের ভাগ্যেরও লিখন।’
হুমায়ুন ফরীদি থাকে প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার এবং শোষিতের প্রতিনিধি। ‘গরিবের বস্তি’-র লোকজন নিয়ে ফেরদৌসী মজুমদারের প্রাসাদে যখন হানা দেয় ঐ সিকোয়েন্সটি ছিল ছবির অন্যতম সেরা প্রতিবাদ। সবাই জাহান মণ্ঞ্জিলে ঢুকে সুস্বাদু সব খাবার খাচ্ছে আর মজা করছে। কেউ সোফাতে দুলছে, কেউ ইজি চেয়ারে বসে আরাম করছে। ফেরদৌসী মজুমদার ‘ছোটলোকের বাচ্চা’ বলে গালি দিলে ফরীদি চিৎকার করে ‘বেগম মমতাজ জাহান’ বলে। তারপর বস্তি দখল করার চিন্তা থেকে সরে আসতে বলে কারণ শোষিত মানুষের উপর শোষণের মাত্রা ছাড়ালে তারা এভাবেই প্রতিবাদী হবে সেটা কাগজে-কলমে বুঝিয়ে দেবার জন্য তাদেরকে নিয়ে আসে জাহান মণ্ঞ্জিলে। তাছাড়া হুমায়ুন ফরীদি-র মুখে ‘ভদ্রলোকের বাচ্চা’ কথাটা স্যাটায়ার হয়ে আসে নাসির খানের জন্য। সেটাও ছিল প্রতিবাদ। শাবনাজের সাথে প্রেম হয় সালমানের এবং বিয়ের রাতেই শাবনাজ গাড়ি থেকে নামার আগে সিঁড়ির উপর চলে যায় সালমান। শাবনাজ সিঁড়িতে পা রাখার সময় সালমানের কণ্ঠে আগের সেই সংলাপের পুনরাবৃত্তি-‘দাঁড়াও, ওখানেই দাঁড়াও। সামনের সিঁড়িগুলো পার হয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা কোরো না।’ দরাজ কণ্ঠের ডায়লগ ডেলিভারিতে সিকোয়েন্সটি অনবদ্য হয়ে ওঠে সালমানের অভিনয়ে। মায়ের বাস্তবতা নিজের স্ত্রীকে দিয়ে বুঝিয়ে দেয় দাদীর দর্পচূর্ণ করতে। এটি ছিল ছবির চূড়ান্ত প্রতিবাদ যেখানে অহংকারীর ঘরেই প্রতিবাদী সন্তান সালমান।

গল্পে রোমান্স, খুনসুটি, কমেডি সব আছে। রোমান্সে সালমান-শাবনাজ ফোনে কথা বলার সময় কথাগুলো দারুণ –
সালমান : আমি যে মেয়েটিকে ভালোবাসি তাকে ফোনে পাচ্ছি না।
শাবনাজ : মেয়েটা তো মরে গেছে।
সালমান : আহারে খুব ভালো ছিল মেয়েটা জানেন।
কমেডির জায়গায় কলেজ ক্যাম্পাসে সালমান-শাবনাজ খুনসুটিতে সহপাঠীদের কথাগুলো মজার। পাঁচ টাকা বের করে দেয় সালমান সাইকেলের চশমা কেনার জন্য। সহপাঠী বলে-‘রবিন, পাঁচ টাকায় চশমার একটা ডান্ডাও পাওয়া যাইব না।’
সালমানকে হেনস্থা করতে শাবনাজের সম্মানহানির মিথ্যে নাটক সিনেমাতে ড্রামার অপশনটা জমিয়ে তুলেছে।

অভিনয়সমৃদ্ধ ছবি। সালমান শাহ পুরো ছবিতে দাপটের সাথে অভিনয় করেছে। ববিতা-সালমান শাহ, সালমান শাহ-শাবনাজ, সালমান শাহ-আলমগীর, সালমান শাহ-ফেরদৌসী মজুমদার, সালমান শাহ-হুমায়ুন ফরীদি এরকম আলাদা আলাদা অপশনে সালমান পারফর্ম করেছে এবং সবগুলো অসাধারণ। আলমগীরের সাথে বস্তিতে ইংরেজি চমৎকার উচ্চারণে তর্কযুদ্ধটা ছিল অসাধারণ সিকোয়েন্স। আলমগীরের মতো বাঘা অভিনেতার সাথে তখনকার ক্রেজ সালমানের অভিনয় ছিল সেয়ানে সেয়ানে টক্কর। মামা-ভাগ্নে ইমেজে সালমান-ফরীদি অভিনয় মজার ও সিরিয়াস দুটোই ছিল যেমনটা ছিল জাঁদরেল অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের সাথেও। মা-ছেলের মধুর সম্পর্কে সালমান ববিতার ছেলের ভূমিকায় অসাধারণ। সালমান, হুমায়ুন ফরীদি, আলমগীর, ববিতা ও ফেরদৌসী মজুমদার সবাই ছিল অভিনয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী তাই ছবিটি অভিনয়সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। শাবনাজও নায়িকার জায়গায় নিজের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করেছে।

গানের মধ্যে ‘পিঁপড়া খাবে বড়লোকের ধন’, ‘তুই ছাড়া কে আছে আমার জগত সংসারে’, ‘তুমি একটা চোর আমি একটা চোর’, ‘পালকিতে চড়াইয়া ফুলবধূ সাজাইয়া’ গানগুলো মন ভরায় এবং অবশ্যই প্রথমটি সেরা গান। দিলদারের ‘করম আলির চানাচুর’ ছিল মজার গান। সব কটা গানে মধ্যে ভেরিয়েশন আছে।

ছবিটি টলিউডে রিমেক করা হয় প্রসেনজিৎকে নায়ক করে। দুই ছবির কোয়ালিটি বিচার করলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির তখনকার স্ট্রং পজিশন বোঝা যাবে।

‘মায়ের অধিকার’ ছবিটি পরিবার, সমাজকে তুলে ধরে সূক্ষ্ম পরিসরে রাষ্ট্রের আবেদন তুলে ধরে। মা বিষয়টাই জন্মদাত্রী মা ও দেশমাতা দুই ইমেজে বাণিজ্যিক ছবির জগতে আলাদা মাত্রায় চলে যায়। সালমান শাহ-র ছবির তালিকায় ‘মায়ের অধিকার’ বিষয়, নির্মাণ ও অভিনয়ে মাস্টারপিস হয়ে আছে ছবির গুণেই।


মন্তব্য করুন