নিখোঁজ: গুম বেশ সহনীয়
বাংলাদেশে নির্যাতন, বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের গুরুতর অভিযোগের ব্যাপারে জাতিসংঘের উদ্বেগের বিষয়ে সরকারের অর্থপূর্ণ জবাব দেওয়া উচিত বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সংস্থাটি জানায়, ২০২২ সালের ৩ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার অফিস নির্যাতনের অভিযোগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিক্রিয়া জানাতে আহ্বান জানিয়েছিল। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সরকার তার জবাব দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ ব্যক্তিকে নিরাপত্তা বাহিনী গুম করেছে। তবে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক নিয়মিত গুমের অভিযোগ বাংলাদেশ সরকার বারবার অস্বীকার করে আসছে।
স্পয়লার অ্যালার্ট: এ লেখার খাতিরে গল্প যতটুকু না বললেই নয়, তা উল্লেখ করা হলো। বিষয়টি মাথায় রেখে বাকিটুকু পড়ুন।
বৃহস্পতিবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দেওয়া বিবৃতির অংশ এ লাইনগুলা। একই দিন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে রিলিজ হয় রিহান রহমান পরিচালিত ছয় পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘নিখোঁজ’। অভিনয় করেছেন একঝাঁক নামি-দামি তারকা। আছেন নব্বই দশকের নস্টালজিয়া আফসানা মিমিও।
নির্মাণ ও অভিনয় মিলিয়ে ‘নিখোঁজ’ আরেকটু পরিপাটি হলে ভালো লাগতো, তবে শেষ পর্যন্ত দেখতে আগ্রহ ধরে রাখে। এটা কৃতিত্বের বটে। এ ছাড়া গল্প তার বিষয়ের কারণে দর্শকের মাঝে কৌতুহল তৈরি করেছে। নিঃসন্দেহে চরকির অরিজিনালের মধ্যে অন্যতম একটি কাজ।
এক ব্যাংক কর্মকর্তা ফারুক আহমেদের গুম হওয়া নিয়ে কাহিনি। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে ধরে নিয়ে যায়, কিন্তু তারা কোথাও এ ঘটনা স্বীকার করে না। উল্টো কয়েকদিন পর ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে পুলিশ তার বাসায় তল্লাশি চালায়, পরে তাকে ‘পলাতক’ দেখায়। খুব পরিচিত লাগছে গল্প?
‘গুম’ বা হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া মানুষ ও তাদের পরিবারের আকুতি নিয়ে চরকির এটা দ্বিতীয় কাজ। এর আগে হারিয়ে যাওয়া এক এমপি’র গল্প নিয়ে রায়হান রাফী করেন ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’। তবে এইচআরডব্লিউ’র বিবৃতির অংশ উল্লেখ করছি বলে ভাববেন না, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ বা ‘নিখোঁজ’-এর সঙ্গে মানবাধিকার সংস্থার বয়ানের সম্পর্ক আছে! বরং ভিকটিমের যে কনসেপ্ট ও তাকে অপরাধী হিসেবে দাগানোর গল্প দেখি আমরা। এক অর্থে খারাপ মানুষের মানবাধিকার লাগে না। কাকতালীয়ভাবে গুম হওয়া দুই মানুষের যেন ‘গুম হওয়ার দরকার’টাই ছিল।
সিনেমা, নাটক বা গান বা সাহিত্যসহ আরও আছে যা যেমন মানবিক হয়ে উঠার ব্যাপার নিয়ে কাজ করতে পারে, তেমনি আবার এর বিপরীত বয়ানকে সত্য সত্য বলে তুলে ধরে পারে। একপক্ষীয় গল্প শুনিয়ে পুরো গল্প শোনানোর ভান করে। যেমন; ভারতে হালে আলোচিত দ্য কাশ্মীর ফাইলস। … কিন্তু দেখেন, আমাদের কিন্তু সাংবাদিক কাজলের গল্প আছে। আরও অনেক ফিরে আসা মানুষের গল্প বা না ফেরা মানুষের তো অবশ্যই।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমরা সব সময় বলি, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। যেখানেই গুম হচ্ছে, সেখানেই আমরা কিছু দিন পরেই তাকে পাচ্ছি। নানা কারণে আত্মগোপন করে থাকে, সেগুলোকে গুম বলে চালিয়ে দেয়।’
এমনকি ভূমধ্যসাগরে মারা যাওয়া লোকদের মাঝে ‘গুম’ হওয়ারা আছে বলেও শুনি আমরা! যদিও দুই অভিযোগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে নাই।
‘নিখোঁজ’ বা ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ সরকারি এ বয়ানকে অস্বীকার করে বটে। তবে তারা অন্য বয়ানও হাজির করে, সেটাই আমরা বলেছি আগে। ঘটনাচক্রে দুটো ফিকশনই হাইপ্রোফাইল বোমা হামলার দিকে নির্দেশ করে। এ বিষয়ে আমরা খুব একটা দ্বিমত করি না বোধহয়। যদিও সবার বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু কল্পিত বাস্তবতা হলো, তাদেরআর ক্ষমা নাই! শাস্তি তাদের পাইতে হবে। সেটা বিচারবহির্ভূত হতেই পারে।
‘নিখোঁজ’ মুক্তির আগে একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়, সংবাদপত্র ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। গুম হওয়া ফারুক আহমেদের খোঁজ চাওয়া হচ্ছিল সেখানে। তখন বিরক্ত হইছিলাম। স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এ কেমন রসিকতা! কিন্তু সিরিজটি দেখার পর মনে হচ্ছে বিষয়টা আসলে ঠিক আছে। হারিয়ে যাওয়াটা আমাদের জন্য সহজ-সহনীয় এবং তাদের যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।