Select Page

এ ‘নাজুক’ হাওয়া

এ ‘নাজুক’ হাওয়া

এক বোদ্ধা লিখছেন যারা গল্প জেনে গেলে সিনেমা দেখার আগ্রহ নষ্ট হয় মনে করেন তারা ‘নাজুক দর্শক’। তো, নাজুক দর্শক হিসেবেই ‘হাওয়া‘ দেখলাম…

‘হাওয়া’ দেখেছিলাম মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহে শেষ দিন শেষ শো’তে। স্টার সিনেপ্লেক্সের সীমান্ত সম্ভার আউটলেটে। সেদিন কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা ঘটনাক্রমে, তারা অনলাইনে টিকিট কেটে রেখেছিল নিজেদের জন্য। তারাই ধরে নিয়ে গেল। যা তোলপাড় কাণ্ড; ধারণা করেছিলাম, টিকিট পাবো না। সেটাই হতে যাচ্ছিল প্রায়। ভাগ্যক্রমে এক বালকের সঙ্গে দেখা, তার বাবা আসতে পারেনি, সেই টিকিটটা কিনে নিলাম। পরে ভাবছি, মানুষ কীভাবে পরিবার সমেত এ ছবি দেখছে। ডায়ালগ বা কিছু দৃশ্য অন্তত পরিবার বান্ধব নয়। কিন্তু এ নিয়ে সোসাইটির তত কথা বা বার্তা নাই। ‘অশ্লীল সিনেমা’ নিয়ে স্পর্শকাতর শ্রেণীটা সম্ভবত নিজের শ্রেণীর নির্মাতা হওয়ার কারণে বিষয়টা তত আমলে নেয় নাই। কারণ, ছোটলোক মূলত নোংরাই। তো ভালো ব্যাপার যে, হাউসফুল একটা শো’র অংশ হলাম। যদিও শুরুর প্রথম দশ মিনিট দর্শকরা ‘তাড়া নাই’ মেজাজ নিয়ে হলে ঢুকছিল। সিরিয়াসনেসের এ অবস্থা বিরক্ত হওয়ারই বটে।

নানা কারণে এ সিনেমা নিয়ে প্রচুর লেখা পড়তে হয়েছে। ফলে কাহিনি মোটামুটি জানা ছিল। সে সব জায়গায় কমনসেন্সের অভাব দেখছি প্রচুর। পরিচালক যেভাবে আড়াই ঘণ্টা ধরে রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলার চেষ্টা করছেন, আম বা বিশেষজ্ঞ রিভিউকার সবাই তা স্পয়লার করে দিচ্ছিল। বিশেষ করে গুলতি কেন ট্রলারে উঠে; এ টুইস্ট জানাতে অনেকে ব্যাকুল ছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই লাইনের প্রশংসার মধ্যে মাঝখানের এক লাইনে সেই গল্পও ফাঁস হতে দেখেছি। টুইস্ট রিভিল করার আপত্তির মাঝে দেখলাম, এক বোদ্ধা লিখছেন যারা গল্প জেনে গেলে সিনেমা দেখার আগ্রহ নষ্ট হয় মনে করেন তারা ‘নাজুক দর্শক’। তো, নাজুক দর্শক হিসেবেই সিনেমাটি দেখলাম।

মোটের উপর বলিউডের মতো করে ঢালিউডে বাণিজ্যিক সিনেমার যদি প্রপার বিবর্তন ঘটতো, এই টাইপের ছবি বোধহয় আমাদের আগেই পাওয়ার কথা। হ্যাঁ, ঢালিউড এখন তার হাইটে রায়হান রাফীকে পাইছেন। দেখে-শুনে এগোলে উনিও ভালো করবেন।

‘হাওয়া’র প্রথম অংশ বেশ ভালো, কাহিনী আগায় না, আমাদের নরমাল জীবনের মতো। দেখায় আরাম আছে, কোনো টেনশন করতে হয় না। দ্বিতীয় অংশ বোরিং, গল্পের মোড়ক খুলতে কেমন যেন আড়ষ্ট। এখানে লেখনির দ্বিধা স্পষ্ট। গল্প খেই হারিয়ে এক জায়গায় ঘোরে আর ঘোরে। বিশেষ করে গুলতিকে নৌকার মধ্যে রাখার বাহানা হিসেবে যে আলাপ সেটা খুবই আনাড়ি। সিনেমা হল থেকে বাইর হতে হতে সেটা বিরক্তিতে পরিণত হলো।

এ সিনেমায় ডায়ালগ বলে কোনো জায়গা নাই। জাস্ট রাখতে হয়, সেজন্য কাজ চালানোর মতো করে কিছু একটা লেখা। এ কথাটা ফেসবুকে এক লাইনে লিখতে একজন বলছিল, ‘সিনেমাটিক ছিল না। রিয়েল ডায়ালগ রাখছে বলে এটা মনে হচ্ছিল’। তখন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর কথা মনে হলো। এ সিনেমার কোনো ডায়ালগ আমার মনে নাই। সেভাবেও লেখা হয় নাই ডায়ালগগুলোও। কিন্তু সিচুয়েশন রিফ্লেক্ট করছিল, ছবি দেখার আরামটা ছিল। ওখানে ডায়ালগের ব্যবহার কম হলেও ‘হাওয়া’ অনেকটা ডায়ালগনির্ভর। কিন্তু এ জায়গাটায় আনাড়ি। অথচ এ সিনেমা দাঁড়ায়া থাকার কথা এ জায়গায়।

ধরেন অভিজ্ঞ মাঝি চান মিয়া বলতেছে, ‘আজ মনে হয় ঝড় আসবে’। তখন আবার বিদ্যুৎ চমক দেখাচ্ছে। এই রকম অভিজ্ঞ মাঝি রাখা হইছে সিনেমায়। কোন সিনেমায়? যেখানে শুরুতে এক ক্যানভাসার বলছে, ‘দরিয়ায় কোনো সায়েন্স খাটে না’। শিক্ষিত চিত্রনাট্যকার। সায়েন্স বিষয়টা যে আসলে কী সেটা তর্কের বিষয়। বা বিজ্ঞানবাদীরা বলবেন, সায়েন্স ছাড়া দুনিয়ায় কিছু আছে নাকি। ধরেন, নেশার ঘোরে একজন গুলতিকে বড় সুরমা মাছ আকারে দেখে। সেটা হয়তো রিয়েল পরিস্থিতি। আসলেই তা। কিন্তু পুরো সিনেমার সবাই যদি নেশার মধ্যে থাকে। পুরো সিনেমায় যা দেখা যায়, সেটা দেখা যাইতে পারে। এখানে সায়েন্সের কাজ কী! বা সায়েন্স আসলে কোথায় বাস করে। তো, প্রশংসা সহকারে শুনতেছিলাম, আহা কী ডায়ালগ। ‘দরিয়ায় কোনো সায়েন্স খাটে না’।

এমনিতেই সায়েন্সের দাবিতে সিনেমা নাকচের কিছু নাই। বাট সায়েন্সের উসিলায় যদি ডায়ালগ, গল্প বোরিং হয়, তাইলে বিষয়টা সুবিধার না। এ ছাড়া ‘দরিয়ায় কোনো সায়েন্স খাটে না’ সেটা দরিয়ায় দেয়া ডায়ালগ না, খুব জ্ঞানী কোনো ক্যানভাসার বা কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনদাতা আকারে যে বিক্রেতা হাজির তিনি দিতেছেন। তার কথা আমরা কেন বিশ্বাস করবো? সচরাচর বিজ্ঞাপনে আমাদের আস্থা থাকে না। সেক্ষেত্রে পরিচালক ছবির শুরুতে হাজির হয়ে ঘোষণা দিতে পারতেন। বরং একটা বাড়তি বাখোয়াজ হইছে। আরেকটা ডায়ালগ আছে; চাঁন মাঝি হেসে বলতেছে ‘ভয় পাইছস’। সেটা ট্রেলারে ইউজ হইছে। মনে হইতেছিল ‘আয়নাবাজি’র চঞ্চলকে দেখছি। ভাগ্য ভালো সিনেমাটি তেমন না, আবার চঞ্চল তার ‘গ্রাম্য নাটকের’ মতো বোরিং হয়ে উঠেন নাই। ‘হাওয়া’র প্রাণ তিনি। আর গুলতি চরিত্রটা শেষ পর্যন্ত ফোটে নাই তার ডায়ালগে ব্যর্থতার জন্য। হাঁটা-চলার ঋজুতা আর কতক্ষণই বা ধরে রাখা যায়। কারণ গল্পে চরিত্রটা তত সাহসী না, ক্ষয়িঞ্চু। গল্পে থাকা দ্বিধা পুরোটা গুলতিকে গিলে খাইছে। যেমন, গুলতি বা চঞ্চলের অতীতের গল্প যখন বলা হচ্ছিল, তা স্রেফ গালগল্পই মনে হয়। পর্দার বাস্তবতা অনুসারে বাস্তব লাগে না।

এ সিনেমাটা দেখতে সুন্দর। বিশেষ করে লোকেশন। সমুদ্র-আকাশ আমাদের যে ধরনের ভাবালুতার মধ্যে নিয়ে যাইতে পারে, সে রকম। যদিও সমুদ্রতল দুই-একবার যা আসছে, প্রায় মাছশূন্য হইয়া। এই শূন্যতা হলো এ ছবির মূল বিষয়। অনেক কিছু আছে, আসলে কিছু নাই। সত্যি? এ ছবিকে বলা হইতেছে, আধুনিক মিথ বা শহুরে মিথ। ‘আধুনিক মিথ’ আসলে কী জানি না। শহুরের লোকজন গ্রাম নিয়ে গালগল্প বানাইলে সেটা ‘আধুনিক মিথ’। কিন্তু মিথ তো বাইরে থেকে তৈয়ার না। যাপনের ভেতর থেকে আসে। এটা যাপনের ভেতর থেকে আসে না, ট্রলারের লোকজনের চরিত্রায়ণ থেকে বোঝা যায়। এই ছবির যা যা অনর্থ সবই বাইরে থেকে আরোপিত। এখানে, কানেক্ট করা যায় না বৃহত্তর মানব সমাজের সঙ্গে। অথচ মিথের কাজ কিন্তু সেটা। মিথ যা নিয়েই হোক আমাকে বা আপনাকে জীবন সম্পর্কে একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেবে। সেটা ছবিতে আছে, কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গির নির্ধারক কে, অনেক ক্ষেত্রে আমরা বিবেকের আশ্রয় পায় ওইসব গল্পে। বাট, আধুনিক মিথে কি বিবেক মারা গেছে? জাতির বিবেকের মতো।

আমার ধারণা এ সিনেমার দর্শকপ্রিয়তার জায়গায় এ রকম একটা ঘটনা আছে। সিনেমা দেখে যখন বাইর হইতেছিলাম, আমরাও বলাবলি করতেছিলাম কেমন লাগছে? অন্য দর্শকরাও তাই করছে? কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিতে পারতেছে না। খুবই কনফিউজিং অবস্থা। মানে ছবির ফিনিশিং তারা অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না। ভালো বা মন্দ বলতে পারছে না। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও একই পরিস্থিতি দেখছি। একবার মনে হলো, যে দেখছে সে ভাবতেছে আমি যখন ঠকছি অন্যরাও যেন ঠকে। না, জাস্ট জোকিং! এ সিনেমার বিক্রির মূল সম্পদ হলো, এর নেতিবাচকতা ও গল্প-চরিত্রের দিশেহারা অবস্থা। এক অর্থে যে গল্প লেখছে আর যে বানাইছে তারও। কারণ, এই ‘আধুনিক মিথ’ কোনো বিবেক হয়ে উঠার বা সেটা কল্পনা করার মতো সামর্থ্য হারাইছে। সে কারণে কিন্তু সিনেমায় কোনো ইতিবাচক চরিত্র দেখবেন না। একদম যে মাঝির চুরির বিরুদ্ধে কথা বলছে, সেটা কিন্তু এথিক্যাল অবস্থা থেকে না। শ্রেণীগতভাবে গরিবরে খারাপ দেখাইতে আবার ওস্তাদ। আবার গুলতির প্রতিশোধ দেখেন, এর সীমা-পরিসীমা নাই। প্রতিশোধও যে জুলুম হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই জুলুমকে ঢাল বানায়া আপনি যে কোনো কিছু আদায় করতে পারেন। যেমন; বাংলাদেশ। এ সিনেমায় যে কোনো দিশা নাই, কোনো অর্থ নাই, বা কোনো বিবেক নাই; সেটাই মূলত দর্শককে কানেক্ট করছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে কোনো দিশা, অর্থ, বিবেক পাইবেন না। সে অনুমান করতে পারে না, আসলে কাল কী হবে? তার ভূত-ভবিষ্যৎ কী? সবাই নৌকাটার মধ্যে খাবি খাচ্ছে। এ জায়গাটায় ‘হাওয়া’ আটকায়া রাখে। সমান্তরালে হিট হওয়া এই সময়ের ‘পরাণ’ দেখেন; শুধু নেতিবাচকতা বিক্রি হচ্ছে। শুধু তা নয়, কোথাও যাওয়ার নেই এমন একটা সময় এ জিনিসগুলো মানুষ পরিবার নিয়ে দেখছে; বোঝা যাচ্ছে, আমাদের সহনশীলতা কতটা পোক্ত হইছে।

আরেকটা দিক না বলে বোধহয় পারছি না। ‘হাওয়া’র বিক্রিভাট্টার ভালো দিক হলো, শালিক পাখি নিয়ে ক্যাচাল! এটা নিয়ে দুনিয়া গেল টাইপ একটা অবস্থা। যেন শিল্পকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, কিছু কওয়া যাবে না? বাংলাদেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মামলা হয়, অনেক ক্ষেত্রে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে সংক্ষুব্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে, অনেকগুলো ফেইক। সেটা আইন দিয়েই খারিজ হয়। কিন্তু আইনের আশ্রয়ে যাওয়ার বিষয়টা শিল্পের দোহাই দিয়ে কীভাবে আটকাবেন। শিল্প যেমন অবিচারকে প্রশ্ন করে, আবার পক্ষও নেয়। সেটা কি আমরা দেখে আসছি না। তাহলে কেন তাকে প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্ন ঠিক না বেঠিক হওয়ার আগে প্রশ্নটা তো করা দরকার। এ নিয়ে একটা বিপ্লবী অবস্থা হলো। কিন্তু যারা মন্ত্রীর বাসায় গিয়ে মিটিং করে রফা করার মতো ক্ষমতাবান তারা যখন কাঁটাতারের বেড়া বানায়া বলে ‘শিল্প রুদ্ধ’, তখন হাসি আসে। যেমন; কাঁটাতারের বেড়ার ওখানে শিল্পের স্বাধীনতা বিষয়ক ইশতেহার পাঠ করছেন ‘হাসিনা: আ ডটার্স টেলসের’ ছবির পরিচালক। এ বিষয়ে বাকি আর কোনো গল্প এ বেলায় না বলি।

এ ছবি প্রেক্ষাগৃহে ব্যাপক হারে দর্শক ফেরাইছে। এটা ইতিবাচক একটা ব্যাপার। বাংলাদেশের সিনেমার এমনিতে একটা কাহিল অবস্থা। একসময় এফডিসির বাইরের লোকজন সিনেমা হলে লোকে দেখে না টাইপ একটা এলিট অবস্থায় বসবাস করতো। সেটা কাটতেছে। কিন্তু কতটা কাটবে সেটা শঙ্কার বিষয়। এমনিতে হালের সিনেমায় নায়ক-নায়িকার অতিমানবীয় ইমেজটা সেভাবে দাঁড়াচ্ছে না, আবার ঢালিউডে পেশাদার প্রযোজক-নির্মাতা নাই বললেই চলে। এখন বছরে ২০টার মতো সিনেমা সরকারি অনুদান পায়। হিসাব করলে দেখা যাবে সম পরিমাণ ছবিতেও প্রযোজকরা লগ্নি করছে না। আবার দেখা যায়, অনুদানের বাইরে যে সব ছবি হয়, সেখানে পুলিশ, র‌্যাব এদের সিনেমাও থাকে। কিছু থাকে টিভি চ্যানেলের। কিছু থাকে ফেস্টিভ্যালের, যেগুলোর খুব কমই সাড়া পায় দেশে। সে ক্ষেত্রে ‘হাওয়া’র ধারাবাহিকতা পাওয়া কঠিন বটে। আশা করি, মেজবাউর রহমান সুমন আরো আরো মশহুর সিনেমা বানাইবেন।

এমনিতে একালে আমরা ভাবি, নানান দিকের জিনিসপত্র দেখে খাবি খাওয়া দর্শকদের যেকোনো অর্থে কানেক্ট করতে পারে তেমন ছবি কঠিন। কিন্তু ‘হাওয়া’ দেখাইছে সেটা ততটা কঠিন না। এটাও অনুমান করতে পারি, সিনেমা যদি শুধু নেতিবাচকতাকে প্রমোট করে, সেটাও খুব একটা কাজের বিষয় হিসেবে দাঁড়াবে না।  

*লেখার শিরোনাম মেঘদল ব্যান্ডের গান ও একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে অনুপ্রাণিত।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বিএমডিবির সহপ্রতিষ্ঠাতা

মন্তব্য করুন