নিজের প্রত্যাশা পূরণে কতোটা সফল তৌকীর আহমেদ: প্রসঙ্গ স্ফুলিঙ্গ
ভূমিকা : সময়টা ১৯৯৬/৯৭, তৌকীর আহমেদ তখন একের পর এক নাটক উপহার দিয়ে যাচ্ছেন দর্শকদের; নিজেও হয়তো জানতেন না অভিনেতা নাম ছাপিয়ে তার নাম উঠবে সফল নির্মাতার খাতায়। আমার চোখে তৌকীর আহমেদ এই উপমহাদেশের অনেক গুণি পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম একজন তাই তার কাছে আমার প্রত্যাশাও কিছু বেশি। যারা তার পরিচালনায় ‘হালদা’ সিনেমাটি দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন। ‘জয়যাত্রা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে তার পরিচালনার ক্যারিয়ার শুরু, একে একে নির্মাণ করেছেন অজ্ঞাতনামা, দারুচিনি দ্বীপ, রূপকথার গল্প ও ফাগুন হাওয়ায়। ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র ফাগুন হাওয়া’র গান এবং সংলাপ ইতিমধ্যে আধুনিক প্রজন্মকে বেশ স্পর্শ করে গেছে যেটা ইউটিউবে সার্চ করলেই বোঝা যায়। ‘আমি বার বার হাজারবার তোমাকে চাই’ গানটি দুই বছরে লক্ষবার শোনা হয়ে গেছে স্রোতাদের।
নামকরণের সার্থকতা: ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রযোজিত “স্ফুলিঙ্গ”। পরিচালক তৌকীর আহমেদ যথেষ্ট আশাবাদী হয়ে বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ এবং চেতনার সাথে তারুণ্যের মেলবন্ধন রচনা করাই স্ফুলিঙ্গ– এর প্রয়াস। এতে তিনি কতোটা সফল হয়েছেন সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলাপে যাব; তার আগে সিনেমার নামকরণ নিয়ে বলতেই হচ্ছে – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকে যদি আমরা বিবেচনা করি তবে ১৯৭১ সালে অবশ্যই ছাত্রদের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু স্ফুলিঙ্গ দেখেছিলেন, নয়তো এই দেশের জন্মই হতো না আবার যদি বর্তমান প্রজন্মের কথা বিশ্লেষণ করতে যাই তাহলে তো অবশ্যই এদের ভেতর এমন লুক্কায়িত আগুন আছে যেটা দেওয়াশলাইয়ের সংস্পর্শে এলেই জ্বলে উঠতে পারে, ছড়িয়ে পড়তে পারে স্ফুলিঙ্গ। তবে সেটা যে সব সময় আলোকঝটিকা হয়ে সাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে তাতো নয় , তাহলে দুটো স্ফুলিঙ্গ একই হবে এমন কোন কথা নেই। তবে অর্থের ভিন্নতা থাকলেও প্রকাশে নামকরণ যথপোযুক্ত হয়েছে বলেই আমি মনে করি।
চরিত্রায়ন: শুরুতেই বলে রাখি; ফজলুর রহমান বাবু এই সিনেমায় শেষ অব্দি অভিনয় করতে পারেননি । তারকা শিল্পীদের মধ্যে যাদের নাম মনে পড়ছে – মামুনুর রশীদ, আবুল হায়াত, শহীদুল আলম সাচ্চু, রওনক হাসান, জাকিয়া বারী মম, পরী মনি এবং শ্যামল মওলা। আবুল হায়াত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যিনি সর্বদা ব্যস্ত থাকেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে কথা বলতে, পার্থকে (শ্যামল) তিনি কথায় কথায় অপদস্থ করেন এবং তাকে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবার মতো কুটিল কাজটিও তিনি বেশ দক্ষতার সাথেই করেন। নিঃসন্দেহে এমন চরিত্রে আবুল হায়াত একটি অন্যতম কাস্টিং। মামুনুর রশীদ ও শহিদুল আলম সাচ্চু এই দুজন জাত অভিনেতা যখন ক্যামেরার সামনে আসেন তখন মনে হয় পু্রো ফ্রেমটাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে; তাদের চোখের অভিব্যক্তি এবং সংলাপ ছুঁড়ে দেবার নৈপুণ্যের পেছনে কোন দক্ষ জাদুশিল্পী আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
ব্যরিস্টার আসিফ চরিত্রে রওনাক হাসান তৌকীর আহমেদের দূর্দান্ত নির্বাচন বলেই আমার বিশ্বাস, তার body language , তীক্ষ্ম অভিব্যক্তি দারুণভাবে একজন উকিলকেই প্রদর্শন করতে সফল হয়েছে। স্ক্রিনে কম উপস্থিতি নিয়ে পর্দায় রিমান্ড অফিসার হিসেবে আবির্ভাব হয়েছেন এ কে আজাদ সেতু , ছাড়া ছাড়া কয়েকটি দৃশ্ , বলিষ্ঠ কণ্ঠ, রুঢ় আচরণ চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দেয় রিমান্ডে এমনই নির্যাতন করা হয় আসামিদের।
পরী মনি ও জাকিয়া বারি মম; তাদের যতোটা চরিত্রের জন্যে করার ততোটাই করেছেন বলেই আমি মনে করি। বাকি যারা আছেন সবার নাম এ মুহূর্তে মনে না পড়লেও কোন চরিত্র অতিরঞ্জিত বা আরোপিত বলে দেথার সময়ে মনে হয়নি। তবে ব্যান্ড নারী শিল্পীর চরিত্রে অপর্ণা ঘোষ বেশি খাপ খেত বলে আমার ধারণা ।
শ্যামল মওলাকে নিয়ে কিছু কথা আছে, কথাটা তার অভিনয় দক্ষতা নিয়ে নয়, তিনি বেশ পারদর্শিতার সাথেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমান প্রজন্মের পার্থকে synch করতে পেরেছেন। কিন্তু তৌকীর আহমেদ প্রত্যাশা করেছেন, এখান থেকে নতুন প্রজন্ম সিনেমার সাথে রিলেটেড হবে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। শ্যামল মওলা কতোটা নতুনদের সাথে পরিচিত সেটা নিয়ে আরো ভাবা দরকার ছিল , একজন আধুনিক ব্যান্ড শিল্পীর সাথে তার বাহ্যিক অবয়ব যায় কিনা সেটার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হতো। যে গান জানে এবং ভালো অভিনয় করতে পারে এবং সেই সাথে বর্তমানের চেনা মুখ এমন তরুণ অভিনেতা পাওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়।
এই সিনেমায় জাফর চরিত্রে হাসনাত রিপনকে রাখা হয়েছে যে কিনা বেশ সাবলীলভাবে দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, সিনিয়র ভোকালিস্টের একটি চরিত্রে পার্থ বড়ুয়াকে কাস্ট করলে ব্যান্ডপ্রেমীরা আরো বেশি মুগ্ধ হতেন বলে আমার ধারণা। একটা নির্দিষ্ট বয়স পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা ছাত্রী চরিত্র তুলে ধরবার জন্য শুধু শরীরের ওজন কমালে হবে না, বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম তাকে কতোটা গ্রহণ করতে পারছে সেটাও ভাব্বার একটা অবকাশ থেকে যায়। সবাইকে এক সাথে খুশি করা যাবে না, তবে সবার মগজে ঢোকা যায় এমন চরিত্রায়ন একজন সফল নির্মাতার যোগ্যতা।
সংলাপ ও সংগীত: তৌকীর আহমেদের লেখা চিত্রনাট্য, বেশ উপভোগ্য ছিল সংলাপ। মুহূর্তে মুহূর্তে দর্শক সারিতে হাসির রোল উঠেছে। এই সিনেমার একমাত্র উপজীব্য হচ্ছে ব্যান্ডের গান, সবগুলোই এক কথায় দারুণ। মিউজিক কম্পোজিশন এবং গানের কথা আধুনিক, সব বয়সীদের স্পর্শ করে যাবার মতো। মাঝে মাঝে হলের সিটে বসে আছি নাকি কনসার্টে আছি সেটা নিয়ে নিজের মধ্যে প্রায়শই সংশয় কাজ করেছে। পিন্টু ঘোষ এবং রোকন ইমনের ‘বুঝি না’ বা ‘তোমার নামে’ নতুন প্রজন্মকে হলমুখি করবে কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না তবে ইউটিউবে গানগুলো দারুণ চলছে।
পোশাক-মেকআপ ও সেট ডিজাইন: আশির দশক ধরে ব্যান্ডের শিল্পীরা যে ধরনের পোশাক পরে আসছেন তৌকীর আহমেদ সেই ধারাবাহিকতা সিনেমাতে বজায় রেখেছেন, তবে শ্যামল মওলাকে কখনোই মনে হয়নি ব্যান্ডের শিল্পী, তিনি রেগুলার শিল্পী না হলেও ভোকালিস্ট হিসেবে তাকে ব্যতিক্রম পোশাকে আবির্ভূত করা যেত যদিও তার বাবা স্কুল শিক্ষক; এখানে সে পরিচয়ে তিনি পরিচিত নন। অন্যদিকে আইরিন চরিত্রে মমর পোশাক পুরো ঠিকঠাক, ট্যাটু বেশ মানিয়েছে কেবল ঠোঁটের নিচে চকচক করা বিষয়টি আমার ভালো লাগেনি, আরোপিত মনে হয়েছে। সাধারণ নারী পোশাকে দিবা চরিত্রে পরী মনি সব সময়কার মতোই গর্জিয়াস। আর শহীদুল আলম সাচ্চু নাইট গাউন কেন সবসময় পরেছিলেন সেটা পরিষ্কার না।
টিকিট কেটে কনসার্ট দেখার মতোই মঞ্চের ডিজাইন হয়েছে, পার্থর ঘর, কবির বাড়ির গাছ ভর্তি বারান্দা, উকিলের দপ্তর, কোর্টের ভেতর অংশ, সূর্যমুখী, নৌকো-নদী সব কিছুই দৃষ্টিনন্দন ছিল। শিল্প নির্দেশনা বেশ উপভোগ্য ছিল, দেয়ালে-দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ক্ষণে ক্ষণে আবির্ভাব নতুনত্ব এনেছে। আর গান চর্চা করবার ঘরটা ছিল বেশ বিশ্বাসযোগ্য।
কাহিনিতে স্ফুলিঙ্গ: এবার মূল আলোচনায় আসা যাক; তৌকীর আহমেদ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর কিছু ভাষণ এবং যুদ্ধের কিছু খণ্ডচিত্রের সাথে বর্তমান সময়কে synchronize অর্থাৎ সমন্বয় করেছেন। এমনভাবে গল্প বলার ধরণ অবশ্য ভারতে এবং অনেক ইংরেজি সিনেমায় দেখা যায় যদিও এই চর্চাটা বাংলাদেশে আগে হয়েছে কিনা জানা নেই আমার। চেষ্টাটা ভালো, যদি একই ঘটনা দুই ক্ষেত্রে একই রকম ঘটে, তবে আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বলে ১৯৭১ সালের তরুণ ছাত্রদের হৃদয়ে যে স্ফুলিঙ্গ কাজ করেছিল সেই একই স্ফুলিঙ্গ এখনকার ছাত্রদের মনে ফোটে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট গবেষণা দরকার। তাদের বেড়ে ওঠা, মন মানসিকতা, জীবন বৈচিত্র এবং ভাবনা সব কিছুই আলাদা। তাই synch করতে গেলে কিছু অসংলগ্নতা চলে আসবেই।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাসের যাত্রিদের যে তল্লাশি করা হয়েছে তার সাথে যোগ করে পরিচালক দেখিয়েছেন গাড়িতে করে পার্থ ও তার বন্ধু মদের বোতল নিয়ে যাচ্ছেন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে। দু্’সময়কার পুলিশিও জেরার তোপে মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমানের চোরাই মদ পাচারকারী। কী করে সমন্বয় হলো বোঝা গেল না!
রেপ কেসে রিমান্ডে আটকে পড়া পার্থের আঙুল ভাঙতে দেখা যায় অফিসারকে যা খুবই অযৌক্তিক লেগেছে এই দেশের প্রেক্ষাপটে, তার সাথে synch করতে গিয়ে পরিচালক দেখিয়েছেন পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধার আঙ্গুল ভেঙে দেওয়াকে। কী অর্থে এই সংযোগ হলো!!
নার্সের বেশে পরী মনিকে সেই সময় দেখা যায় যার সাথে synch করা হয় বর্তমানের দিবাকে। আইরিনকে synch করে দৃশ্যপটে ভাসে মুক্তিযুদ্ধে অবস্থানরত মম, এমন অনেকগুলো দৃশ্য দিয়ে synchonize করে পরিচালক হয়তো কোন কিছু আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন যেটা দর্শক হিসেবে আমরা ধরতে পারিনি। সব এখানে লিখে দিলে দর্শক হলে গিয়ে কী দেখবেন!!
বিজয় দিবসের গান লিখতে হলে তো নিজের দেশকে অনুধাবন করতে হবে, গ্রামে চলে যেতে হবে, মাটির গন্ধ নিতে হবে, শহরের বিছানায় শুয়ে আর ল্যাপটপ দেখে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়ে দেশের গান গাইতে উদবুদ্ধ হতে আমি কাওকে আজ অব্দি দেখিনি। মাটির গান লিখতে হলে শেকড়ে যেতে হবে, শেকড়টা বহু গভীরে।
২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর সিনেমার শুটিং শুরু হয়, বড় বাজেটের একটা সিনেমা শেষ করতে মাত্র ২৩ দিন লেগেছে। রাজেন্দ্রপুর নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্টে শুরু হয়েছে সিনেমার কাজ, মুক্তি পেয়েছে ২৬ মার্চ, ২০২১ সালে। সব মিলিয়ে পরিচালক সিনেমাটিতে বেশ কম সময় দিয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের সত্যিকারর স্ফুলিঙ্গ তুলে আনা এতো কম সময়ে কখনোই সম্ভব নয়, তাদের ভাবনার দৌড়; তাদের চিন্তা ধরতেই কয়েক বছর লেগে যাবার কথা। Home work হয়তো অনেক আগ থেকেই, তবে Execute করার সময়টা অতি অল্প।
ফাগুন হাওয়ায় তার স্বাভাবিক উপস্থাপন শক্তি দিয়ে নতুনদের যতো্টা আগ্রহী করেছে হলে যেতে, স্ফুলিঙ্গ তা পারেনি অর্থাৎ তৌকীর আহমেদ নিজেই নিজের সাথে এবার competision-এ চলে আসলেন। বাকি দিনগুলোর হল আপডেট বলে দেবে সিনেমার সাফল্য।
সিনেমার একেবারেই শেষ দৃশ্যে গিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি যে এতোক্ষণ বাংলা সিনেমা দেখছিলাম। গল্পের শেষে ব্যারিস্টার আসিফ দিবাকে নিজ গাড়িতে করে পার্থের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যান এবং পার্থ জেলে কাটানো দূর্বিসহ সময় ভুলে, বাবার মৃত্যূর কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আইরিনকে মঞ্চে ডাকেন গান করতে। নায়কের এমন মহানুভবতা একমাত্র বাংলা সিনেমায় দেখানো সম্ভব।
পরিশেষে , স্ফুলিঙ্গ সিনেমার সমালোচনা সম্পূর্ণ আমার নিজেস্ব ভাবনা, এখানে অন্য কারো কোন ধরনের influence নেই।
রোদেলা নীলা
গল্পকার ও নাগরিক সাংবাদিক