নিজের সময়ে সফল দেলোয়ার জাহান ঝন্টু
দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বহুল পরিচিত একজন পরিচালক। নিজের সেরা সময়ে তিনি কাজ বা চলচ্চিত্রে নিজের সেরাটা দিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে প্রজন্মভেদে মূল্যায়নের পার্থক্য আছে।
এখনকার সময়ে এসে সব বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সমালোচিত হন, রাগান্বিত অভিব্যক্তি দেন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ছবি নির্মাণের কথা বলেন না, তিনি অনেক ছবির গল্প, গান লিখেছেন এসব বলেন সেটা কখনো কখনো বিরক্তি আনে এবং সেটার সমালোচনা করা যায় ক্ষেত্রবিশেষে। কিন্তু এর জন্য তাঁর অবদানকে অস্বীকার করলেও চলবে না। তাঁর বেশ অবদান আছে ঢালিউডে।
ছোটবেলায় আমরা যখন শুক্রবারের দুপুরে বিটিভিতে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখতে বসতাম তখনকার প্রচারিত বেশিরভাগ ছবির পরিচালক, কাহিনিকার থাকতেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। এমনকি পরিচালনা, কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও গীত এর সবই তাঁর নামেই দেখাত। তার মানে প্রতিভা অনেকদিকেই ছিল। তাঁর ভাই আনোয়ার জাহান নান্টুও নামকরা সুরকার ছিলেন।
ঝন্টুর তাঁর ছবির ধরন নিয়ে যে সমালোচনা হয় যেমন- তাঁর ছবিতে নায়ক-নায়িকা অনেক বেশি স্মৃতি হারাত, সাপের ছবি বানানোর এক্সপার্ট ছিলেন ইত্যাদি। স্মৃতি হারানোর কথা যদি বলা হয় তবে যে সময় তিনি দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া বা স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়ে নায়ক/নায়িকাকে চেনানোর মতো ছবি বানাতেন সেগুলো তখনকার দিনে চলত তাই বানাত। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে আবার ফিরে পাওয়ার মতো গল্প তো উত্তম কুমারের ‘হারানো সুর’ ছবিতেও ছিল, কারণ তখনকার দিনে এ ধরনের গল্পের ছবি চলত এবং হিটও হত। ঝন্টুর ‘জজ ব্যারিস্টার’ ছবি এ ধরণের গল্পেই হয়েছে এবং ব্লকবাস্টার হয়েছিল।
যখন ‘নাগরাণী, নাচে নাগিন, নাগরাণী, রূপসী নাগিন, রূপের রাণী গানের রাজা, নাচ নাগিনা নাচ, বিষে ভরা নাগিন, দুই নাগিন’ ছবিগুলো বানিয়েছেন তখনকার দিনে এ ধরনের ফ্যান্টাসি ছবির চাহিদা ফ্যামিলি অডিয়েন্সের কাছে ব্যাপকভাবে ছিল। ঝন্টু সেজন্যই এসব ছবিতে সফল ছিলেন।
প্রেমগীত চলচ্চিত্রে লিমা ও ওমর সানী
ফ্যামিলি ড্রামা ঘরানার ছবির ক্ষেত্রে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু জনপ্রিয় পরিচালকই ছিলেন। বিশেষ করে গ্রাম-শহর দুই প্রেক্ষাপটেই এ ঘরানার ছবি নির্মাণে তাঁর ভালো জনপ্রিয়তা ছিল। ‘জজ ব্যারিস্টার, শিমুল পারুল, পরিবার, ঘরবাড়ি, মাটির কোলে, ভাই আমার ভাই, সুখশান্তি, ভাবীর সংসার, স্ত্রীর স্বপ্ন, নিঃস্বার্থ, ভাইয়ের আদর, গরিবের বন্ধু, বুকের ধন, গরিবের সংসার, বিশ বছর পর, নীল সাগরের তীরে, বাপবেটির যুদ্ধ’ এমন অনেক ফ্যামিলি ড্রামার সফল পরিচালক তিনি। রোমান্টিক ড্রামাতেও সফলতা দেখিয়েছেন ‘প্রেমগীত, হারানো প্রেম, প্রেম’-এর মতো ছবিগুলোতে রোমান্টিক ড্রামা ঘরানায় নিজের দক্ষতা দেখাতে পেরেছেন।
দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর কালজয়ী ছবিও রয়েছে। পালকি, প্রেমগীত, শশীপুন্নু, শিমুল পারুল, কন্যাদান, নিঃস্বার্থ ছবিগুলো তাঁকে একনামে চেনানোর মতো ছবি হয়ে উঠেছে। ডাকাত, জালিমের দুশমন, দেশী রংবাজ, ফাইভ রাইফেলস-এর মতো অ্যাকশন ছবি আবার ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে ‘হাতি আমার সাথী’-র মতো দারুণ কমেডি ছবিও নির্মাণ করেছিলেন।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ‘বীর সৈনিক’ (২০০৩) ছবিতে। মান্নাকে ডাবল রোলে ব্যতিক্রমীভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
ঝন্টু রাজ্জাক আমল থেকে শাকিব খান আমল পর্যন্ত দীর্ঘযাত্রার ক্যারিয়ার গড়েছেন। এটা অবশ্যই বড় অভিজ্ঞতা ও অর্জনের মধ্যে পড়ে।
ঝন্টুর সময়ের কোনো পরিচালকই সেভাবে এখন ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন। সময়ের চাহিদা মেটাতে না পারা ‘তুমি আছো তুমি নেই’ জাতীয় ছবি বানিয়ে কিংবা সমসাময়িক ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন ইস্যুতে ক্যামেরার সামনে রাগান্বিত প্রতিক্রিয়া দেয়া এভাবেই তিনি বর্তমানে আছেন। এটার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। তিনি যদি সময়মতো ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দিতেন তাঁর সময়ের পরিচালকদের মতো তাহলে সম্মান পেতেন। এখনো সময় আছে সম্মান বজায় রেখে ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেয়ার। তাতে করে তাঁকে নিয়ে সমালোচনা আর থাকবে না, ভবিষ্যত প্রজন্ম ঠিকই বলবে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু নামে একজন সফল পরিচালক ছিল।