নিপাট ভদ্রলোক থেকে ‘মেগাস্টার’ উজ্জ্বল
পুরো নাম আশরাফ উদ্দিন আহমেদ, যাকে আমরা উজ্জ্বল নামেই চিনি— আরেকটু ভালোভাবে বললে ‘মেগাস্টার উজ্জ্বল’ নামেই তিনি বেশি পরিচিত আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রে। খুব বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি… তারপরও দর্শকদের অগুনতি ভালোবাসায় তিনিই পেয়েছিলেন এ খেতাব, বলছি সত্তর ও আশির দশকের জনপ্রিয় নায়ক উজ্জ্বলের কথা।
উজ্জ্বল জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ২৮ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ সদরের আমলাপাড়ায়। পৈতৃক বাড়ি পাবনা জেলার জন্তিহার গ্রামে হলেও পিতা ইয়াসিন উদ্দিনের কর্মক্ষেত্র হিসেবে সিরাজগঞ্জেই স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের চিকিৎসক। মা সাবেরা বেগম ছিলেন গৃহিনী। ছয় ভাই বোনের মধ্যে উজ্জ্বল ছিলেন পঞ্চম, উজ্জ্বল প্রথমে ১৯৬২ সালে শান্তাহার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি…পরে রংপুরের একটি কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন, অধ্যয়নরত অবস্থায় একটি চাকরি করতেন এবং বেতার-টেলিভিশনে টুকটাক অভিনয় ও কণ্ঠ দিতেন। মঞ্চ নাটকেও সুযোগে অভিনয় করতেন তিনি এবং সেই সুবাদে ১৯৬৭/৬৮ সালের দিকে মঞ্চ নাটক ‘অনুবর্তন’ নাটকে অভিনয় করেন এবং বেশ সুনাম অর্জন করেন, নাটকটিতে তার সহকর্মী হিসেবে ছিলেন এই সময়ের তূমুল জনপ্রিয় চিত্র তারকা সুজাতা।
সত্তর দশকের একেবারে শুরুর দিকে অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, কাহিনীকার, গীতিকার, চিত্রকর্মকার গুণী ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্তের পরিচালনায় অভিনেত্রী কবরীর বিপরীতে ‘বিনিময়’ (০৩/০৭/১৯৭০) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উজ্জ্বল রূপালি পর্দায় কর্ম জীবন শুরু করেন। প্রথম ছবিতেই কবরীর মতো তারকা অভিনেত্রীর সাথে অভিনয় করে বেশ প্রশংসা কুড়ান তিনি, পরের ছবিতেই আরেক গুণী তারকা শাবানার সাথে ‘সমাধান’ (১১/০২/১৯৭২)— তাদের রসায়ন দর্শকদের মনে ধরে যায়, সেই সাথে মনে ধরে যার শান্ত স্বভাবের মিষ্টি হাসির তরুন অভিনেতা উজ্জ্বলকেও। করতে থাকেন বেশ কিছু ছবি, যার মধ্যে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘স্বীকৃতি’, ‘বলাকা মন’, ‘ইয়ে করে বিয়ে’, ‘পায়ে চলার পথ’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘অপরাধ’, ‘ভাড়াটে বাড়ী’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘সন্ধিক্ষন’, ‘সমাধি’, ‘গরমিল’, ‘অনুরোধ’, ‘অনুভব’, ‘পিঞ্জর’, ‘দম মারো দম’, ‘অচেনা অতিথি’, ‘বন্ধু’, ‘দুটি মন দুটি আশা’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘ফকির মজনু শাহ্’, ‘মহেশখালির বাঁকে’ উল্লেখ্যযোগ্য।
উজ্জ্বলের একটি ব্যাপার নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়। তা হলো তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার নিয়ে, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে উজ্জ্বলের চলচ্চিত্রগুলো যেন দুই ভাগে ভাগ করা— অর্থাৎ সত্তর দশকের এক উজ্জ্বল, তো আশির দশকের যেন আরেক উজ্জ্বল। উপরের উল্লেখিত যতগুলো ছবির নাম বললাম তা সবই ছিলো সত্তর দশকের, একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে সেখানকার প্রায় সব ছবিগুলোই সামাজিক ঘারানার, অর্থাৎ অ্যাকশন চরিত্রে তেমন কোন ছবিতেই তাকে দেখা যায়নি। এমনও হয়েছে আমাদের আরেক জনপ্রিয় নায়ক বুলবুল আহমেদের মতো তাকেও নিপাট ভদ্রলোক বলেই ডাকা হতো, কিন্তু তিনি সেই ধারণা একেবারে পাল্টে দিলেন আশির দশকের একেবারেই শুরুর দিকে এসে এসএম শফির ‘বেদ্বীন’ ছবিটির মাধ্যমে। একেবারে রাফ অ্যান্ড টাফভাবে হাজির হলেন তিনি নতুন আঙ্গিকে, ছবিটিতে তার সহকর্মী হিসেবে ছিলেন সুপারস্টার ওয়াসিম, ড্যাশিং হিরো সোহেল রানা, চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবালদের মতো তারকা অভিনেতারা। ছবিটিতে দর্শকরা যেন নতুন এক উজ্জ্বলকে আবিষ্কর করলো, আর এই ভিত আরো মজবুত হলো নিজের প্রযোজিত মমতাজ আলী পরিচালিত ‘নালিশ’ ছবিটির দারুন সাফল্যের মধ্য দিয়ে।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন ‘নসিব’ (১৮/০৫/১৯৮৪) ছবিতে বশিরা চরিত্র দিয়ে। ছবিতে তার দুর্দান্ত অভিনয় ও অ্যাকশনে যেন মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলো সারা দেশের সিনেমা পাগল দর্শক। অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিলো ছবিটি, স্থান করে নিয়েছিলো সেরা দশ ছবির একটিতে, সাথে দর্শকদের অফুরন্ত ভালোবাসায় উজ্জ্বলও স্বীকৃতি পেলেন মেগাস্টার খেতাবে। মূলত এই ছবিটির পর থেকেই উজ্জ্বলকে মেগাস্টার বলে ডাকা হতো, ব্লকবাস্টার হিট এই ছবিটি দেখতে এমনও হয়েছে সকালের শোর টিকিট অনেককেই বিকেলে কিনতে হয়েছে, ছবিটি দেখা নিয়ে এক সিএনজি চালকের সাথে আলাপকালে জেনেছিলাম… তিনি সকালের শোতে টিকিট না পেয়ে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে নাকি দুপুরের শোর টিকিট কেটেছিলেন। আরেকজন তো ছবিতে ব্যবহৃত শাবানা-আদিলের সেই বিখ্যাত গান ‘এসো না ভাব করি প্রেমে ডুবে মরি’ গানটি বারংবার দেখার লোভে ছবিটির টিকিট কেটেছিলেন কয়েকবার, ভাবা যায় একবার? কতটা ভালোবাসা ভালোলাগা কাজ করতো তখনকার একেকজন দর্শকদের মনে? যা এখন চিন্তাতেই আনা যায় না, আসলে তখনকার ছবির গল্প সাথে তারকাদের অভিনয়-নাচ-গান সব মিলিয়েই একটি প্রাণবন্ত চিত্ররূপ তৈরি হতো, যা এখনকার সময়ে কল্পনাতেও আনা যায় না।
এই যখন উজ্জ্বলের রমরমা ক্যারিয়ার তখন তিনি পুরো আশির দশকটা অ্যাকশন চরিত্রেই কাটিয়ে দিলেন। এই দশকে তিনি মোট ১৫টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যার মধ্যে ‘বেদ্বীন’, ‘আমির ফকির’, ‘দোস্তী’, ‘কুদরত’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘নালিশ’, ‘লাল কাজল’, ‘রাজ সিংহাসন’, ‘নসিব’, ‘আমিই ওস্তাদ’, ‘নিয়ত’, ‘উসিলা’ অন্যতম।
আশির দশকের মতো নব্বই দশকেও উজ্জ্বল অ্যাকশনে ছিলেন আলোকিত। এই দশকে মোট নয়টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি, যার মধ্যে ‘কারণ’, ‘চোর ডাকাত পুলিশ’, ‘বিশাল’, ‘জ্বলন্ত বারুদ’, ‘শক্তি পরীক্ষা’ অন্যতম।
অভিনয়ের পাশাপাশি উজ্জ্বল প্রযোজনাতেও নাম লেখান ১৯৮২ সালে ‘নালিশ’ (১০/০৯/৮২) ছবিটির মধ্য দিয়ে, পরিচালক ছিলেন মমতাজ আলী। এখানে একটু যোগ করতে হয়… এই মমতাজ আলীই কিন্তু উজ্জ্বলকে অ্যাকশন চরিত্রে প্রতিষ্ঠা করার পেছনে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার দক্ষ নির্মাণের সবটুকুই উজাড় করে দিয়ে বানিয়েছিলেন ‘ঈমান’, ‘কুদরত’, ‘নালিশ’, ‘নসিব’, ‘উসিলা’, ‘কারণ’, ‘নিয়ত’, ‘বিশাল’-এর মতো সব চলচ্চিত্র।
উজ্জ্বল তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে খুব বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি, মাত্র আশির অধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। সংখ্যাটি আরো দীর্ঘ হতে পারতো যদি তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে আরো বেশি সচেতন হতেন। তারপরও এত কম সংখ্যক ছবিতে অভিনয় করেও তিনি দেশের সেরা সব তারকা অভিনেত্রীদের সাথেই কাজ করেছেন। যার মধ্যে শাবানা, শবনম, ববিতা, কবরী থেকে শুরু করে রোজিনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষ, জিনাতদের মতো তারকা অভিনেত্রীরা ছিলেন। ছিলেন পাশের দেশ জয়শ্রী, ইন্দ্রানী হালদার ও শতাব্দী রায়দের মতো তারকারাও। এত সব অভিনেত্রীর মধ্যে শাবানার সাথেই সর্বাধিক জুটি হয়ে ১২টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।