নির্বাসনে সাবিনা ইয়াসমিনের এক ঝোলা গানই শেষ মিনতি
সেদিন বৃষ্টির রঙ ছিল সাদাকালো, সেই ঝিরঝির ছবি আমাদের অন্য পাড়ার এক সমিতির ঘরে, সাদাকালো টেলিভিশনে, ব্যাটারি চালিত টেলিভিশন। শুক্রবারের বিকেল। ভেজা গন্ধরাজের পাপড়িতে আহত সৌরভ, সেই বৃষ্টিময় এক সিনেমাবেলা। টেলিভিশনে অপূর্ব এক নায়িকা ববিতার টানা চোখের কেমন কেমন ইশারা। ঠোঁটে গান ‘আমি ধন্য হয়েছি ও গো ধন্য, তোমারই প্রেমেরই জন্য’। সেই কণ্ঠ ও গায়কীর কাঁপন লেগে যায় আমাদের চুপ করে থাকা প্রতিটা বুকের গভীরে। সেই উনিশশ ছিয়াশি সালে, সেই উত্তর পাড়ার সমিতি ঘরে, এক বৃষ্টির বিকেলে, সিনেমা দেখা শুক্রবারে। সেই থেকে সাবিনা ইয়াসমিন আমাদের হয়ে যান। আমরা সাবিনা ইয়াসমিনকে নিজের করে নিই।
সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে আমি দেখা করতে যাই না। যদি শুনি কখনও সাবিনা ইয়াসমিন এসেছেন আমাদের গানের কোনও চেনা মহল্লায়, আমি চলে আসি সেদিক থেকে। সাবিনা ইয়াসমিন এক ঘোরগ্রস্তের নাম। কোনোকালে আমি এই ঘোর থেকে বেরুব না বলেই স্থির করেছি। আমি খাঁটি একজন দুঃখবিলাসী। ইচ্ছে করেই বলতে শখ করেই দুঃখের ভেতর বুঁদ হয়ে যাবার মধ্যে ভীষণ আনন্দ খুঁজে পাই। পৃথিবীতে সম্ভবত আমিই একমাত্র ওই গানের একমাত্র শ্রোতা যে নিয়ম করে প্রতিদিন দুইবার কিংবা তিনবার শুনি, শুনতে হয়, না শুনে থাকতে পারি না। এমনও রাত এসেছে জীবনে, আমি ওই গান না শুনে ঘুমিয়ে গেছি, ঘুম ভেঙে গেছে, উঠে গেছি আমিও। তারপর অবিরাম সেই গান, সেই ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে, কত সাধনায় এমন ভাগ্য মেলে’।
কবে কোনকালে কবেকার এক পৌষ মাসে বিপর্যস্ত শীতের রাতে বুকের খাঁচা ভেঙে কেড়ে নিয়ে গেলো প্রেমিকাকে, সেই কত শত বছর আগে যেন, দিন তারিখ ভুলে যাই। শুধু মনে পড়ে, মনে পড়ে আজকের এই বিশেষ দিনে, কোকিল পাখির জন্মদিনে খুব করে মনে পড়ে তাঁর মুখ। সেই যে প্রেমিকা আমার অন্যের হয়ে গেলো, চলে গেলো রঙিন বাসরের দিকে, সেদিন সেই রাতে সেই পৌষ মাসের কুয়াশাবদ্ধ রাতে সে কি গেয়েছিল সেই গান? আমি যে গান তাকে গুনগুন করে শেখাতাম। যখন তাকে বলতাম ‘যতটা পারো, সাবিনা ইয়াসমিন হয়ে থাকো’। এদেশে একটিমাত্র পাখি অনিন্দ্য দুঃখের কথা বলতে জানেন, তাঁর উজাড় উড়াল গানের পাখনায় ভর করে ভালো থাকা যায়, খুব ভালো রাখা যায় নিজের সংসার। সেদিন সেই প্রেমিকা আমার মাথা নেড়ে বলেছিল গুনগুন, শোনাবো, রাতভর শোনাব সাবিনা ইয়াসমিন। তারপর সেই সেদিনের পর এক দীর্ঘ রাত। পৌষ মাসের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা রাত। সে চলে গেলো ভিন্ন বাসরে। সারারাত বহুদুরের এক সর্ষে ক্ষেতের ধারে বসে কেবল দেখেছিলাম, উচ্চারিত হচ্ছে কি এমন গান ‘দুঃখ আমার, আমার বাসর রাতের পালঙ্ক, নিন্দা আমার প্রেম উপহার, সাতনরী হার কলঙ্ক’।
প্রেমিকার বিরহ কাটিয়ে উঠেছি তখন। জীবন গিয়েছে জীবনানন্দের হাত ধরে বহুদূর প্রায় কুড়ি কুড়ি বছরের ওপারে। শিখেছি কৌশল, স্বার্থ আর শিখেছি বড্ড হিসেব নিকেশ। ততদিনে নাগরিক হয়তো। তবু ব্যস্ততার ফাঁকে এই কংক্রিট জঞ্জালে ফোঁস করে উঠেছে আবেগ। ফেলে আসা সেই আবেগ। ঝাপসা থেকে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছেন প্রিয় সাবিনা ইয়াসমিন। তাগাদা শুরু হয়েছে সংসারের। কীভাবে যেন বানের নয়া জলের মতো স্বপ্ন আসে আস্তে আস্তে। একদিন এমন রাত আসুক, ঘোরের মধ্যে কেউ গেয়ে শোনাক ‘এ কি শোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে, ও গো বন্ধু কাছে থেকো’।
মন টেকে না সংসারে। ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে সমূহ ইচ্ছে, স্বপ্ন, শখ ইত্যাদি, ইত্যাদি। কী করে যে বদলে যায় চলমান চাকা এই জীবনের, কেউ জানে না। আমরা ডুবে থাকি কাজের মধ্যে। ইচ্ছে করেই এই চাপ নিই, চাপ নিতে হয়। হঠাৎ জানালা খুলে যায়। পর্দা সরে যায়। নতুন বাতাস এসে ভাবিয়ে তোলে। কোথায় কোনও এক বিকেলে সমুদ্দুরের হাওয়ায় প্রেমিকার কাঁধের পাশে পড়ে থাকা আহত চুলে হাত বুলাতে গিয়ে সে হয়তো তাকালো এদিকে। পৃথিবীতে তখন সেই দৃশ্যের নেপথ্যে বাজতে থাকবে একটি মাত্র গান। সাবিনা ইয়াসমিন গাইছেন দূরে কোথাও, কোনও এক বালিয়াড়ির দিকে – সন্ধ্যার ছায়া নামে এলোমেলো হাওয়া, ভালো লাগে জীবনের এই গান গাওয়া।
জীবনে কোথাও মেলে না কিছুই মনের মতো। শুধু যখন যেমন দুঃখ চেয়েছি, পেয়ে গেছি তার অধিক। ভালোবাসায় সবচেয়ে বড় অর্জন কিংবা প্রাপ্তির উপলব্ধি শিখিয়ে গেছে নানান জাতের দুঃখেরাই। বিরহের চাষবাস করতে করতে একদিন জেনে গেছি দুঃখ আমার সমস্ত অভিধান। এখানে আর কোনও শব্দের জায়গা নেই। চিরকালীন দুঃখের এই বসতভিটায় দাঁড়িয়ে আকাশে ওড়াতে থাকি সারাবেলা সারাদিন – দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়, আগুনে মন পুড়ে অলঙ্কার বানাতে হয়।
সাবিনা ইয়াসমিন আমার জীবনের অনেককিছুই দখলে নিয়ে নিলেন আমার অলক্ষ্যেই। আমাকে যদি বলা হয় যেতে হবে নির্বাসনে। আমি শেষ মিনতি জানাব। যেন সাবিনা ইয়াসমিনের এক ঝোলা গান দিয়ে দেয়া হয় আমার কাঁধে। আমি সেই গান সারাদিন শুনব। সাররাত শুনব। সাবিনা ইয়াসমিনের গান শুনতে শুনতে আমি একদিন উড়ে যাব দূর নক্ষত্রের দেশে। সাবিনা ইয়াসমিনের গানের সঙ্গে আমি আমার জীবন বদলে ফেলতে চাই নির্দ্বিধায়।
আজ প্রিয় পাখির জন্মদিন। অঢেল শুভেচ্ছা প্রিয় সাবিনা ইয়াসমিন ❤