
নির্মাতা শিক্ষা দিতে না চাইলেও নাটক-সিনেমা ডেজায়ার তৈরির মেশিন
বলিউডের তারকা ও এতদঞ্চলের ছোটখাট গড রণবীর কাপুর সাহেব বলেছেন, “অ্যানিম্যাল এর মতো সিনেমা আমি ১০০ বার করবো। সমাজ সিনেমা থেকে নৈতিকতা শিখবে এই ধারণাটাই ভুল।”

আমি দেখছি এই কথা আরো অনেকে বলেন। হুমায়ূন আহমেদ নামক নন্দিত লেখক বলতেন প্রায় এরকম কিছু, তার চিরাচরিত টিটকারি মার্কা ভাষ্যে, যা মধ্যবিত্তের খুব প্রিয়। আমার নাটকে শিক্ষামূলক কিছু নাই। শিক্ষার জন্য স্কুল আছে, নাটক ফিলিম কেন।
আবার, কাজল আরেফিন অমি নামক এক পপুলার নাটক নির্মাতা আছেন, তার কথাবার্তাতেও এটা আসে। কারণ তারে সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার নাটকে এত গালাগালি, বাজে অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি কেন, তখন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করেন।
আপাত দৃষ্টিতে, শিল্পের জন্য শিল্পের যুক্তিতে মনে হয়, কথাটা তো ঠিকই কইছেন তারা। শিল্পরে আটকাইয়া রাখলে তো হবে না। শিল্প সমাজরে প্রশ্ন করবে, চিন্তা করতে উসকানি দিবে। তার তরিকা কখনো হইতে পারে মোলায়েম, কখনো তীক্ষ্ম।
কিন্তু, তারা যেইভাবে দায় এড়াইয়া যাইতে চান, যে লজিকে এটা ভুল। কারণ, মিস্টার অমি, বা মিস্টার রণবীর ধরা যাক তার নাটক ফিলিম থেকে কোন শিক্ষা দিতে চান না, কিন্তু মানুষ তো এখান থেকে নানা কিছু নেবে। প্রকৃতিগতভাবে মাধ্যমটা হইল ডেজায়ার তৈরির মেশিন। তা না হইলে বি গ্রেড বাংলা ফিলিম আলেকজান্ডার বো এনাদের ফিল্ম আইন করে, অভিযান করে বন্ধ করা হইছিল কেন! ওইগুলা যেমন সফট পর্নো ছিল, তেমনই রণবীর সাহেবের এনিমেল ভায়োলেন্স পর্নো। যেমন জন উইকও।
আমার ধারণা, অমি যে তার নাটকে সুন্দর, পরিষ্কার, সাজানো গোছানো রুম দেখান, এটা মানুষের ভেতর এইরকম ঘর সাজাইয়া রাখার ডেজায়ার তৈরি করবে। এখন, যদি অমিরে জিজ্ঞেস করি, মিস্টার অমি, আপনার নাটক তো ফিফটি ফিফটি থেকে অনুপ্রাণিত অনেকটা, ওইখানে সেট ছিল আগলি, আপনার এইখানে সুন্দর, যত সিজন আগাইছে আপনি সেট আরো সুন্দর করে গেছেন – এই দেখার ভঙ্গিটা তো আপনারই রুচি – তা দর্শকরে দেখাইয়া আপনে প্রভাবিত করতেছেন কি না? সরাসরি স্কুলি শিক্ষা দিবেন, ছাত্ররা আইসা পরীক্ষা দিবে, আপনারা মাস্টর হইয়া পাশ মার্ক দেবেন – ওইটারেই খালি শিক্ষা দেয়া ভাবতেছেন নাকি!
আপনে রুচি প্রভাবিত করতেছেন – এবং এভাবেই যারা শিল্প সাহিত্যের দুনিয়ায় কাজ করেন, তাদের শিল্পের কোয়ালিটি যেমনই হোক – জনপ্রিয়তা পাইলে ওইটা বিশাল সংখ্যক মানুষরে তো প্রভাবিত করেই, কালচাররেও প্রভাবিত করে।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকের ক্ষেত্রেই দেখেন, ফালতু কাহিনীর নাটকের সাথে অনেক গভীর মানবিক মূল্যবোধের নাটকও তিনি বানাইছেন। মধ্যযুগে দ্য ফিলোসফার বলতে যে একজন ব্যক্তিরে বোঝানো হইত, সেই এরিস্টটল বলছিলেন শিল্প মানুষের আবেগরে শুদ্ধ করে। হুমায়ূন আহমেদের কিছু নাটকের ক্ষেত্রে এমন তো হইছে, এমন কিছু ক্যারেক্টার তিনি আনছেন, বাস্তবের ওই ধরনের লোকের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন হবে- হওয়া উচিৎ – এসব জায়গায় তিনি ছাপ ফেলে গেছেন। শুধু সাময়িক না, কালচারেও, যেমন বাকের ভাই চরিত্রের কথা বলা যায়।
অমির লজিকের আরেকটা বিষয় আমি খেয়াল করছি, তিনি বলতে চান, রিয়ালিটি যেমন – এজ ইট ইজ তিনি আনতে চান। ব্যাচেলর পোলাপানরা যেমনে থাকে, কথা কয় – ইত্যাদি। কিন্তু, তার দর্শকেরা মনে করেন তিনি যে জায়গাতে ব্যাচেলররা থাকে, যেভাবে থাকে দেখাইতেছেন, যেমন কাপড় চোপড় পরে, এইগুলা বাস্তবে হয় না। এই জায়গাতে তার কথার লগে কাজের অমিল।
এবং এই অমিল স্বাভাবিক। কারণ রিয়ালিটি এজ ইট ইজ দেখানো পরিচালক বা লেখকের কাজ না, অমি এটা কথা বলার সময় বোঝেন নাই। তিনি রিয়ালিটি দেখেন, এইটা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তার দুনিয়া তৈরি করেন। এইখানে তিনি নানা কিছু আনেন ও বাদ দেন। এখানে তার কিউরেশন থাকে, সচেতনে নেয়া ও বাদ দেয়া। যেমন হয়ত অমি ব্যাচেলরদের বুলি নিছেন, কিন্তু বসবাসের তরিকা কম নিছেন। নানা জায়গায় নিজস্ব মালমসলা দিছেন। ফলে, কখনোই রিয়ালিটি এজ ইট ইজ আনি – এই কুযুক্তি দেয়া যাবে না, কারণ এইটা কিছু মিন করে না। আপনি যখন নিজে ক্রিয়েটিভ কিছু বানাইতেছেন তখন ওইটা আপনারই সৃষ্টি। এর দায়ও নিজের।
উদাহরণ হিশেবে, আয়নার কথা ভাইবেন। আয়নার সামনে আপনে খাড়াইলেন, আয়নায় এক অসাধারণ দৃশ্য দেখা গেল। কোনটা রিয়াল? খাড়ানো আপনে। আর আয়নার ভিতরেরটা দৃশ্য।
তখন, আপনার মনে হইল, চুল ঠিক নাই, চুল হাত দিয়া ঠিক করলেন। আয়নায় তা দেখাও ছিল।
এটা কীভাবে হইল?
আয়নার দৃশ্য আপনারে কিছু দেখাইছে, সেখান থেকে আপনে বিবেচনা করে দেখছেন চুল ঠিক নাই, হাত দিয়া ঠিক করছেন। এর মাধ্যমে রিয়ালিটিতে দাঁড়ানো আপনার চুল বদলাইয়া গেল।
রিয়াল থেকে শিল্পী লেখক, নেন, নিজেরা বদলান, সৃষ্টিশীলতা, কল্পনাশক্তির প্রয়োগ ঘটান। ক্রিয়েটিভ আর্ট তৈরি করেন, পরে ওই আর্ট আবার রিয়ালিটিরেও প্রভাবিত করতে পারে।
শেষ পর্যায়ে দুইটা নাটকের কথা বলব আপনাদেরকে, ওই সময়ের ইহুদিবিদ্বেষ দুইটাতেই প্রধান ছিল। একটা মার্লোর দ্য জ্যু অব মাল্টা। আরেকটা এর বেশ কয়েকবছর পরে প্রকাশিত শেক্সপিয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিস। দুই নাটকই এলিজাবেথিয়ান এরার।
মার্লো একরৈখিকভাবে ভিলেন ইহুদি দেখাইছেন, দর্শকের বাহবা পাইছেন। কিন্তু শেক্সপিয়র দেখাইছেন এক জটিল ইহুদি ভিলেন শাইলক। ভেনিসে তখন ইহুদিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিশেবে রাখা হতো, গেটোতে বাস করতে বাধ্য করা হতো, তাদের টাকা ধার দেয়া ছাড়া অন্য কোন পেশায় যাইতে দেয়া হইত না, নায়ক এন্টোনিও বুড়া শাইলকের মুখে থুতু মারছিল প্রকাশ্যে। শাইলকের মেয়ে জেসিকা খ্রিস্টান ছেলের সাথে পালিয়ে যায় তার সম্পদ চুরি করে। অর্থাৎ, ভিলেন শাইলক কেন ভিলেন – এটাও দেখাইছেন শেক্সপিয়র।
এই কমপ্লেক্সিটির জন্য তার নাটকটি এখনো সমাদৃত, এর বিভিন্ন ধরণের রিডিং হয়। তিনি শাইলকরে নায়ক দেখান নাই, ভিলেনই দেখাইছেন। তার নাটকটিও ইহুদি বিদ্বেষী, কিন্তু তার উপস্থাপন রিয়ালিস্টিক, চরিত্রগুলা এত রিয়াল যে, খারাপরে মনে হয় বেশী খারাপ, আবার তার মানবিক আপিলটাও পাবলিকরে টাচ করে, যখন বুড়া শাইলক বলে- “একজন ইহুদির কি চোখ নেই? একজন ইহুদির কি হাত নেই, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই, আকার নেই, ইন্দ্রিয় নেই, অনুভূতি নেই, আবেগ নেই? আমরা কি একই খাবার খেয়ে বেঁচে থাকি না, একই অস্ত্রে আহত হই না, একই রোগে ভুগি না, একই ওষুধে সুস্থ হই না, একই শীত ও গ্রীষ্মে ঠান্ডা ও গরম অনুভব করি না – ঠিক একজন খ্রিস্টানের মতোই? তোমরা যদি আমাদের খোঁচা দাও, আমাদের কি রক্ত ঝরে না? তোমরা যদি আমাদের সুড়সুড়ি দাও, আমরা কি হাসি না? তোমরা যদি আমাদের বিষ খাওয়াও, আমরা কি মরি না? আর যদি তোমরা আমাদের উপর অন্যায় করো, তাহলে আমরা কি প্রতিশোধ নেব না?”
বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনের কারণে শাইলক, শাইলকিং একটা খারাপ শব্দ হিশাবেই আছে – কিন্তু মার্লো আরো বেশি খারাপভাবে বারাবাসরে দেখাইছেন, সেই চরিত্রের কোন প্রভাব নাই এখন।
এই গল্প নাটকের বাস্তব দেখানো এজ ইট ইজ বাস্তব না, এখানেই লেখক আর্টিস্টের প্রতিভা ও বুদ্ধির জায়গা – তিনি কী দেখাবেন ও কীভাবে দেখাবেন।