নূর ছড়িয়েছে ‘নূর জাহান’
নূর জাহান
পরিচালনা : অভিমন্যু মুখার্জি
অভিনয় : পূজা চেরি রায়, আদৃত, খরাজ মুখার্জি, অপরাজিতা আঢ্য, নাদের চৌধুরী, ওমর আয়াজ অনি ও চিকন আলী।
রেটিং : ৩/ ৫
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘নূর জাহান’ নাকি ভারতের মারাঠি ছবি ‘সাইরাত’-এর নকল; মুক্তির আগে তেমনটিই শুনেছিলাম। অবশ্য আসল-নকল নিয়ে আমি যতটা না চিন্তিত থাকি, তার চেয়ে বেশি ভাবনা আমার বিনোদন প্রাপ্তি নিয়ে।
কেয়ামত সে কেয়ামত তাক, সানাম বেওয়াফা, দিল, দিওয়ানা, আধাভান আমাকে যতটা বিনোদন দিয়েছিল কেয়ামত থেকে কেয়ামত, দেনমোহর, আমার ঘর আমার বেহেশত, বিয়ের ফুল, শিকারি- ঠিক ততটুকুই কিংবা কিছু ক্ষেত্রে বেশি বিনোদন দিয়েছে। আর তাই নূর জাহান সাইরাত-এর কাট-কপি-পেস্ট কিনা এ নিয়ে ছবি দেখবার আগে যতটা না ভেবেছি, তার চেয়ে বেশি ভেবেছি ৪ কোটি রূপি বাজেটের সাইরাত যেমন ১১০ কোটি রূপি আয় করেছিল, ‘নূর জাহান’ কি ঠিক তেমন কোনো ইতিহাস রচনা করতে পারবে?
সাইরাত-এর নায়িকা রিংকু রাজগুরু যেমন প্রথমবার অভিনয় করেই ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঝুলিতে ভরেছিল, আমাদের শিশু তারকা পূজা কি নায়িকা হিসেবে তার প্রথম ছবি দিয়ে সে রকম কোনো ঝড় তুলতে পারবে? উচ্চাশা করতে ভয় পাই। আর তাই প্রত্যাশার পারদ শূণ্যে নামিয়ে ‘নূর জাহান’ মুক্তির প্রথম দিন প্রথম শো দেখতে প্রেক্ষাগৃহে হাজির হই।
নায়িকা বাংলাদেশের পূজা, নায়ক ভারতের আদৃত। প্রাপ্তবয়স্ক চরিত্রে দুজনেরই প্রথম ছবি; এমনকি ছবির প্রথম দৃশ্যেও হাজির তারা দুজন। নূর (আদৃত)-কে এ দৃশ্যে বখাটে সহপাঠীদের হাত থেকে উদ্ধার করেন জাহান (পূজা)। নবাবগঞ্জের ক্ষমতাসীন দলের চেয়ারম্যান আমিনা বেগমের একমাত্র সন্তান বলে কথা। পূজার নামেই কাঁপে পুরো ক্যাম্পাস। দুই শ্রেণীর, দুই সন্তানের এই পরিচয়পর্ব পরবর্তীতে কিভাবে প্রণয়, পরিণয় এবং সবশেষে পরিণতির দিকে রূপ পেল-সেটি নিয়েই ‘নূর জাহান’।
ছবি সংশ্লিষ্টরা বেশ জোর গলায় বলেছিলেন, ‘নূর জাহান’ ‘সাইরাত’-এর নকল নয়। ছবির প্রথম দৃশ্য দেখে আমিও তাই ভেবেছিলাম। যদিও শেষ অব্দি দেখে আমার উপলব্ধি নাগরাজ মানজুলের লেখা ‘সাইরাত’এর নকল নয়, তবে ২ ঘন্টা ৫৪ মিনিট ব্যাপ্তির দক্ষিণ ভারতের ছবি থেকে ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা নিয়েই কাহিনীকার ও পরিচালক অভিমন্যু মুখার্জি ২ ঘন্টা ২৫ মিনিটের ‘নূর জাহান’ সৃষ্টি করেছেন।
অবশ্য রোমিও-জুলিয়েটের নির্যাস নিয়ে অতীতে টাইটানিক, কেয়ামাত সে কেয়ামাত তাক, রামলীলা, আমাদের দেশের ‘গহীন বালুচর’সহ অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘নূর জাহান’ সেই ধারাতেই বিয়োগান্তক প্রেমের ছবি।
অভিমন্যু মুখার্জি নূর ও জাহানের প্রেমের মুহূর্তগুলো বেশ সময় নিয়ে পর্দায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ বিষয়টি আমাকে আনন্দ দিয়েছে। আরো আনন্দ দিয়েছে নবাগত পরিচালকের নির্মাণ। ঠিক এই চিত্রনাট্যই একজন আনাড়ি পরিচালক গুলিয়ে ফেলতে পারতেন। অভিমন্যু মুখার্জি তা করেননি। খুব সাধারণ দৃশ্য: যেমন ছেলে মায়ের অগোচরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে কিংবা মেয়ে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে এসব দৃশ্যেও বাহুল্যতা বর্জন করে খুব সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আবেগ তৈরি করেছেন। বাংলাদেশের মূল ধারার বানিজ্যিক ছবিতে খুব সম্ভবত এবারই প্রথম সমকামী চরিত্র দেখলাম। সঠিক চরিত্রায়ণের অভাবে এ চরিত্রটি বিকশিত হয়নি। নায়কের বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করা জনৈক অভিনয়শিল্পীর কমেডিও এতটুকু জমেনি।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে ‘নূর জাহান’ ছবির সবচাইতে বড় প্রাপ্তি হিসেবে আমি উল্লেখ করবো পূজা চেরি রায়ের নাম। পূজা ছোটবেলা থেকেই চোখ দিয়ে অভিনয় করেন। মুখের চেয়েও তার চোখ বেশি কথা বলে। স্বাভাবিকভাবেই পূজা নায়িকা হিসেবেও তাক লাগিয়ে দেবেন-এমনটি প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু এতটা ভালো করবেন-আমি অন্তত ভাবিনি। ‘নূর জাহান’ ছবির প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত পূজা একাই টেনে নিয়ে গেছেন। আরো রূঢ়ভাবে বললে, এ ছবিটি থেকে পূজাকে সরিয়ে নিলে পুরো ছবিই প্রাণ হারাবে।
শিশু তারকারা প্রাপ্তবয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করলে প্রায়ই বেমানান মনে হয়। শিশু চরিত্রের লেবাস অনেকেই ছাড়তে পারেন না। পূজা পেরেছেন। তার সংলাপ প্রক্ষেপণের ভঙ্গি, হাঁটা, নাচ-সবকিছুতেই নায়িকা সুলভ আবেদন স্পষ্ট। অথচ কী সহজ, কী স্বাভাবিক! ইদানিংকালের অনেক নায়িকার মত ন্যাকামোও নেই তার ব্যক্তিত্বে। তবে বেশ কিছু দৃশ্যে ওপার বাংলার মতো করে সংলাপ বলেছেন পূজা (কিরুম লাগলো আমাদের কলেজ কিংবা এরুম মাঝ রাস্তায় কেন দাঁড়িয়ে থাকো)। এই বিষয়টি বাদ দিলে পূজা এ বছরের এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। বাংলা চলচ্চিত্রে এরকম একজন নায়িকা উপহার দেবার জন্য প্রযোজক জাজ মাল্টিমিডিয়াসহ ওপার বাংলার প্রযোজকদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ। সঠিক পরিচর্যা, সঠিক মূল্যায়ন, সঠিক পদক্ষেপ পূজাকে শীর্ষ জনপ্রিয় তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে-এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
পূজার নায়ক আদৃত প্রথম ছবি হিসেবে ভালো করেছেন। পূজার সাথে আদৃতের জুটি বেশ মানিয়েছে। গুণী অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য মন্দ চরিত্রে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। তবে একটা সময় পর তার চোখ রাঙানি অভিনয় বেশ একঘেয়ে লেগেছে। একই কথা প্রযোজ্য সুপ্রিয় দত্ত’র ক্ষেত্রে। সব ছবিতে তার একই ধাঁচের অভিনয়। নাদের চৌধুরী কিংবা চিকন আলী অভিনয় করবার সুযোগ পাননি। তবে ওমর আয়াজ অনি ছোট্ট চরিত্রে চোখে পড়েছেন। বিশেষ করে তার কণ্ঠস্বর ও ব্যক্তিত্ব ব্যবহার করতে পারে ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।
‘নূর জাহান’ ছবিতে গান রয়েছে মাত্র ৩টি। এর মধ্যে আব্দুল গফুর হালির ‘সোনা বন্ধু’ নতুনভাবে সংগীতায়োজন করেছেন স্যাভি। গানের চিত্রায়ণের সাথে হিন্দি ‘সাথিয়া’ ছবির ‘অ্যয় উড়ি উড়ি’ গানের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তবে গানটি গল্পের সাথে মানানসই-ই মনে হয়েছে। ‘মন বলেছে’ এবং শিরোনাম গানের আবহ সংগীত ছবি জুড়ে ব্যবহার করায় এই দুইট গান পর্দায় বিশেষভাবে মন ছুঁয়েছে আমার। ইমরান ও কনার গাওয়া ‘মন বলেছে’ গানের চিত্রায়ণও দারুণ।
শুধুমাত্র দুটি গেটআপে পূজার সাজ ভালো লাগেনি। তবে এ ছবির শব্দগ্রহণ অসাধারণ লেগেছে। পূজার রূপসজ্জা, পোশাক, এ ছবির শিল্প নির্দেশনাতেও যত্নের ছাপ পেয়েছি। এসব কারণ যোগ করেই বলবো, ‘নূর জাহান’ আমাকে বিনোদন দিতে পেরেছে।
পূজার অভিনয় দেখতে হলেও দর্শকদের ‘নূর জাহান’ দেখা হোক। তবে একটি কথা বিশ্বাস করি, ‘নূর জাহান’ ছবির বক্স অফিস ফলাফল যাই হোক, নায়িকা হিসেবে পূজার ভবিষ্যত কিন্তু বেশ উজ্জ্বল। আমরা যারা ছবিটি দেখেছি, অন্তত তারা এমনটিই বিশ্বাস করি।
*রিভিউটি দৈনিক সমকালের ২২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত।